সমকালীন প্রসঙ্গ-বুয়েটে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কয়েকটি দিক by বদরুদ্দীন উমর

বুয়েটে এখন যে আন্দোলন চলছে এটা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে দুর্নীতি চলছে তার বিরুদ্ধে সব থেকে দীর্ঘস্থায়ী, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী আন্দোলন। এই আন্দোলনের গণতান্ত্রিক চরিত্রও বেশ উল্লেখযোগ্য। এহেন এক আন্দোলনের সঙ্গে বাস্তবত বিএনপির কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও এটা বিএনপির উস্কানিতেই শুরু হয়েছে_ একথা


বলে বিএনপিকে এক বড় কৃতিত্বই দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বলা হয়েছে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের নজিরবিহীন
এক আন্দোলন বিএনপির উস্কানিরই পরিণতি!

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বুয়েট) ছাত্ররা তাদের আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়ে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন সেটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে তাদের দীর্ঘ আলোচনার পর মন্ত্রী তাদের বলেন যে, তারা উপাচার্যের অপসারণ বাদ দিয়ে বুয়েটের উপ-উপাচার্যকে অপসারণসহ অন্যসব দাবি পূরণ করবেন। এ আশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছাত্রদের ক্লাসে যোগদানের কথা বলেন। তিনি আরও বলেন যে, উপাচার্যকে এই মুহূর্তে অপসারণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব না হলেও অদূরভবিষ্যতেই তারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। ছাত্ররা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে এই আলোচনার পর ক্লাসে ফেরত যাওয়ার বিষয়ে সম্মত হন, যদিও তারা বলেন যে, উপাচার্যের অপসারণ এখনও তাদের দাবির অন্তর্গত এবং এই মুহূর্তে না হলেও অল্পকালের মধ্যেই তাকে অপসারণ করতে হবে।
লক্ষ্য করার বিষয় যে, শিক্ষামন্ত্রীর সাক্ষাৎ এবং তার আশ্বাসের পরও ছাত্ররা এখন পর্যন্ত ক্লাসে যোগদান করেননি। এ ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান খুব পরিষ্কার। তারা বলছেন, শিক্ষামন্ত্রীর আশ্বাসের প্রতি তারা আস্থাশীল হলেও বাস্তবত এই আশ্বাসের ভিত্তিতে যতক্ষণ পর্যন্ত না উপ-উপাচার্য অপসারণসহ অন্যান্য শর্ত কার্যকর করা হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ক্লাসে যোগদান থেকে বিরত থাকবেন। স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশে সরকারবিরোধী শিক্ষক ছাত্রদের আন্দোলন থেকে নিয়ে শ্রমিক আন্দোলন পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্রেই আজ পর্যন্ত এই ধরনের সিদ্ধান্ত দেখা যায়নি। যা দেখা গেছে তা হচ্ছে, আন্দোলনের মুখোমুখি হয়ে সরকার আন্দোলনকারীদের তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি, এমনকি আশ্বাস দেওয়ার পরই আন্দোলনকারীরা তাদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে ঘরে ফিরেছেন, কিন্তু সরকার তাদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পরে আর পালন করেনি। নানা অজুহাত দেখিয়ে ও গড়িমসি করে তারা আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার পরিবর্তে অগ্রাহ্য করে আগের মতোই বসে থেকেছে এবং এ কারণে আন্দোলনকারীদের আবার নতুন করে একই ইস্যুতে এবং একই দাবি-দাওয়া সামনে রেখে আন্দোলনে নামতে হয়েছে। শিক্ষক ও শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এটা বারবার দেখা গেছে। আন্দোলনের মুখে দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর তারা আর কিছুই করেনি। অর্থাৎ সরকার আন্দোলনকারীদের আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির নামে ধাপ্পা দিয়েছে। বলাবাহুল্য যে, অতীতে বিভিন্ন আন্দোলনের মুখে সরকারের এই নিয়মিত ধাপ্পাবাজির কথা মনে রেখেই বুয়েটের ছাত্ররা বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন যে, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার সময় মন্ত্রী যে আশ্বাস তাদের দিয়েছেন সে আশ্বাস অনুযায়ী কাজ যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ক্লাসে যোগদান করবেন না।
উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য, বিশেষত দ্বিতীয়োক্ত ব্যক্তির নানা ধরনের বেপরোয়া ও লাগামবিহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েই ছাত্ররা তাদের অপসারণ দাবি করেছেন। শুধু ছাত্ররাই নয়, বুয়েটের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীরা একজোট এবং ঐক্যবদ্ধ হয়েই এই আন্দোলন করেছেন। বাস্তবত এ ধরনের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কোনো দৃষ্টান্ত আজ পর্যন্ত অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা যায়নি। সব থেকে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন এখন ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে তিক্ত ও তীব্রভাবে বিভক্ত থাকা সত্ত্বেও বুয়েটের এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বাইরে থেকেই ছাত্ররা আন্দোলন করেছেন। এর থেকেও বোঝা যায়, বুয়েটের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্য কী পরিমাণ দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা এই বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে করেছেন।
সরকারি দল আওয়ামী লীগের মুখপাত্ররা এখন বলতে শুরু করেছেন যে, বুয়েটের এই আন্দোলনে বিএনপির উস্কানি ছিল! এ কথার অর্থ কী দাঁড়ায় এটা কি তারা ভেবে দেখেছেন? অবশ্য ভেবেচিন্তে কথা বলার জন্য সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ কোনো সরকারি মুখপাত্রকে কেউ দায়ী করতে পারবেন না। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রথম কথা হলো, বুয়েটের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যে রাজনৈতিক কোনো বিবেচনা সম্পর্কিত নয় এটা আন্দোলনকারীরা তো বটেই, অন্য সবাই জানেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারি মুখপাত্ররা যখন বলেন যে, এই আন্দোলনে বিএনপির উস্কানি ছিল তখন এর মধ্যে দেখা যায়_ হয় বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অপার অজ্ঞতা, নয়তো তাদের দুষ্ট অভিসন্ধি। এর কোনোটি থেকেই সরকারের লাভবান হওয়ার কথা নয়। উপরন্তু এর দ্বারা সরকারের বিরুদ্ধে শুধু বুয়েটের আন্দোলনকারীই নয়, জনগণেরও বিক্ষুব্ধ হওয়ার কথা।
এ তো গেল একদিক। আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততা ও তাদের উস্কানির কথা বলে সরকার যে বিএনপিকে আসন্ন ভোটযুদ্ধ সামনে রেখে বেশি নম্বর দিয়ে ফেলছেন এ চিন্তার ক্ষমতাও তাদের নেই। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা তাদের মস্তিষ্ককে অতিরিক্ত উত্তপ্ত রাখার কারণে দিকটি খেয়াল করার মতো অবস্থা তাদের নেই। বুয়েটে এখন যে আন্দোলন চলছে এটা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে দুর্নীতি চলছে তার বিরুদ্ধে সব থেকে দীর্ঘস্থায়ী, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী আন্দোলন। এই আন্দোলনের গণতান্ত্রিক চরিত্রও বেশ উল্লেখযোগ্য। এহেন এক আন্দোলনের সঙ্গে বাস্তবত বিএনপির কোনো সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও এটা বিএনপির উস্কানিতেই শুরু হয়েছে_ একথা বলে বিএনপিকে এক বড় কৃতিত্বই দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে বলা হয়েছে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের নজিরবিহীন এক আন্দোলন বিএনপির উস্কানিরই পরিণতি! আওয়ামী লীগের মুখপাত্রদের এই বক্তব্য যে রাজনৈতিক শক্তির দাঁড়িপাল্লায় বিএনপিকেই বেশি ওজনদার হিসেবে জনগণের কাছে উপস্থিত করে, এ ধারণা তাদের থাকলে এ রকম অর্বাচীন বক্তব্য তাদের পক্ষে উপস্থিত ও প্রচার করা সম্ভব হতো না।
বুয়েটে উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যকে তাদের পদে অধিষ্ঠিত রাখার জন্য সরকারের আপ্রাণ চেষ্টার কারণ তারা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মকানুনের কোনো পরোয়া না করে নিজেদের দলের লোককে নিয়োগ দিয়ে বসিয়ে রেখেছেন। এদের মাধ্যমে সরকার প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের দলীয় রাজনীতির মাধ্যমে দলীয় স্বার্থ চরিতার্থ করছে। এর ফলে প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন পরিস্থিতি খুব উত্তপ্ত। যে কোনো দিন এগুলোতে আন্দোলন বিস্ফোরণের আকার ধারণ করতে পারে। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি এদিক দিয়ে বিশেষভাবে সংকটজনক। এ কারণে বুয়েটে আন্দোলনের এক পর্যায়ে কোনো কোনো সরকারি মুখপাত্র বলেছিলেন যে, বুয়েটে সরকার আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে নিলে অন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মহামারী শুরু হবে? মহামারী শুরু হওয়ার অর্থ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বুয়েটের মতো আন্দোলন বিস্তার লাভ করা। এই আশঙ্কাতেই সরকার ও তাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন উদ্বিগ্ন। কিন্তু তারা উদ্বিগ্ন হলেই যে আন্দোলন তারা ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হবেন পরিস্থিতি তেমন নয়। কাজেই অদূরভবিষ্যতেই ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ইত্যাদি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অপসারণসহ অন্য দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলন শুরু হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।
৮.৯.২০১২

বদরুদ্দীন ওমর :সভাপতি, জাতীয়
মুক্তি কাউন্সিল
 

No comments

Powered by Blogger.