‘বিলাসি’ শাওন এবং মৃত্যুঞ্জয়ী হুমায়ূন by মুশতাক ইবনে আয়ূব

মৃত্য কাউকে কাউকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। তার কারণ আছে। যতক্ষণ কেউ বেঁচে আছে ততক্ষণ তার সম্ভাবনাগুলোও আমাদের আশ্বস্ত করে। যখন সে থাকে না তখন মূলত সম্ভাবনাগুলোর মৃত্যু ঘটে। যা আছে তা হারানোর বেদনা আমরা সহ্য করতে পারি কিন্তু যা থাকতে পারতো তা না পাওয়ার বেদনা অনেক অসহনীয় এবং দূরপ্রসারী।

হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুটা ঠিক এমন। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তার লেখাযোখাগুলো আমাদের আনন্দ দিয়েছে। যদিও আমরা কখনো কখনো বিষয় বৈচিত্র্যহীনতায় তার লেখায় বিরক্তি প্রকাশ করেছি। আর  তার বই কিনবো না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। কিন্তু তারপর ঠিকই বইমেলা থেকে তার বই কিনেই বাড়ি ফিরেছি। কিংবা কোথাও তার একটা বই আছে দেখেলেই হাতে নিয়ে চারপাশ ভুলে ডুবে গিয়েছি তার মোহনীয় লেখায়। এই ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ।

এখন তিনি যখন নেই তখন হঠাৎ একটা বিরাট শূন্যতায় পড়ে গেছি আমরা। এখন হঠাৎ আমরা উপলব্ধি করেছি তিনি কী দিয়েছেন আমাদের এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরও কতকিছু দেয়ার সম্ভাবনা ছিল তার। বাতাসের মধ্যে থেকে বাতাসের গুরুত্ব বুঝা কঠিন। বাতাস সরিয়ে নিলে বুঝা যায় জীবনের জন্য কত অপরিহার্য তা। হুমায়ূন আহমেদ যেন সেরকমটাই বুঝিয়ে গেলেন আমাদের।

অনেকদিন ধরেই অসুস্থ তিনি। তারপরও আমরা সবাই আশা করে ছিলাম- ঠিকই এ যাত্রায় বেঁচে যাবেন। আবার লিখবেন। আরো ভালো লিখবেন। বিশেষত মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে জীবনের যে অপরূপ রূপ উপলব্ধি হয় তা তার লেখায় নতুন মাত্রা দেবে। আমরা আরো বৈচিত্র্যময় লেখা পাবো তার কাছ থেকে। যখন এমন প্রাপ্তির আশায় মগ্ন আমরা তখনই খবর এলো সম্পূর্ণ উল্টো ধরনের। আমাদের মাঝে আর নেই তিনি। চলে গেছেন আমাদের নাগালের বাইরে। এবং সবচেয়ে বড় কথা- আর কখনোই কোনো নতুন লেখা পাবার সুযোগ হবে না তার কাছ থেকে।

আমাদের প্রত্যাশার সাথে এমন সাংঘর্ষিক পরিণতিতে হুমায়ূণ আহমেদ তাই ভীষণ আলোড়ন তৈরি করে গেলেন সবার মাঝে। তার মৃত্যু মেনে নেয়াটা কঠিন হয়ে গেল আমাদের জন্য। হঠাৎ করেই যেন অক্সিজেনশূন্য লাগতে শুরু করলো আমাদের সাহিত্যজগত। মনে হলো হুমায়ূন আহমেদের অনুপস্থিতিতে আমরা যেন ঠিকমতো নিঃশ্বাস নিতে পারবো না। আমাদের দীর্ঘশ্বাস, হাসি আনন্দ যেন আর ঠিকমতো প্রকাশিত হবে না বইয়ের পাতায়। আর তাই তাকে হারানোর বেদনাটা আরো গভীর হয়ে বিঁধলো আমাদের হৃদয়ে। যে মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না সে মৃত্যুর জন্য কাউকে না কাউকে দোষারোপ করতে হয়। আমরাও পেয়ে গেলাম তেমন একজন- মেহের আফরোজ শাওন। শোকে আমরা আরো বিবেচনাহীন হলাম। শোক মানুষকে বিবেকহীন করে বই কি।

যে লেখক আমাদের এত প্রিয়, তার প্রিয় একজন মানুষকে আমরা নিদারুণ কষ্ট দিতে মোটেও কার্পণ্য করছি না। শাওন এখন হুমায়ূন আহমেদের প্রেয়সী থেকে তার মৃত্যুদূত হিসেবেই চিত্রিত হচ্ছেন অনেকের কাছে। বেশ কয়েকটি পত্রিকা এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যম রীতিমতো আটঘাট বেধে নেমেছে শাওনকে হেনস্তা করতে। ভুলেই যাচ্ছে, যাকে নিয়ে এ প্রপাগাণ্ডা সে হুমায়ূন আহমেদেরই প্রিয় একজন মানুষ। জীবিত হুমায়ূন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত তার কাছেই ভালোবাসার আশ্রয় খুঁজেছিলেন।

কিন্তু লোকাচারের কাছে, আমাদের অনুমানের কাছে হুমায়ূন আহমেদের সাথে শাওনের ভালোবাসার দিনগুলো কোন আবেদনই তৈরি করছে না। আমরা যার যেমন খুশি গল্প বানাচ্ছি। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করছি অনেক চিত্রনাট্য। সবগুলোতেই শাওন খল চরিত্রের এক অভিনেত্রী মাত্র। তিনি আর হুমায়ূন আহমেদের  প্রেয়সী নন। যিনি হুমায়ূন আহমেদের ভালোবাসার স্মারক দুই সন্তানের জননী তিনি এখন এক লোভী তরুণী কেবল। আমরা এতদিন ধরে নিয়েছিলাম  হুমায়ূন আহমেদের যশ এবং বিত্তের ভালোবাসায় তার কাছে ছিলেন শাওন। আর এখন দেখলাম এমনকি তার লাশেরও লোভ ছাড়লেন না তিনি। শাওন তাই কেবল্ই একজন লোভী চরিত্র। জানি না সামনে আরো কত রটনা শুনতে হবে তাকে ঘিরে।
কিন্তু এই প্রতিষ্ঠিত চিত্রের বাইরেও আছে এক নিদারুণ বেদনার ছবি। সে ছবিটি দেখার চেষ্টা নেই কারো। সে ছবিটিও দেখা দরকার।

কিছু কিছু মৃত্যু কাউকে ভিতরে বাইরে একেবারে সর্বস্বহীন করে ফেলে। যেকোন বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু শাওনের জন্য সে পরিণতিরই নামান্তর। হুমায়ূন আহমেদেকে বিয়ে করার পর থেকেই আর কিছুই নেই তার। কেবল  আছেন হুমায়ূন আহমেদ। যারা হুমায়ূন আহমেদকে ভলোবাসতেন আর যারা তাকে ভালোবাসতেন না নির্বিশেষে সবাই অপছন্দ করতেন শাওনকে। তাদের কাছে শাওন এক সুখি সংসার ধ্বংসকারী প্রগলভা নারী। এই বিপুল গোষ্ঠীর বাইরে কেবল একজন ভিন্নভাবে দেখেছে শাওনকে। তিনি হুমায়ূন আহমেদ। কেবল হুমায়ূন আহমেদের কাছেই তিনি ছিলেন ভালোবাসার একজন। এখন যখন নেই তিনি, তখন শাওন সর্বস্বহীন। শাওনের অজানা থাকার কথা নয় সে বিষয়।

কিন্তু তারপরও বাঁচতে হবে শাওনকে। কারণ তার আছে দুটো শিশুপুত্র। তারা তার কাছে সদ্যপ্রয়াত স্বামীর সবচেয়ে বড় স্মৃতিচিহ্ন। হুমায়ূন আহমেদ নেই। কিন্তু এই নিষাদ কিংবা নিনিত হুমায়ূন আহমেদের ভালোবাসার প্রতীক হয়ে আছে তার কাছে।

পত্রিকাগুলো নুহাশ, শিলা, কিংবা নোভার ক্রন্দনরত ছবি ছাপিয়ে বাবার প্রতি তাদের ভালোবাসার প্রকাশ দেশবাসিকে দেখিয়ে দিয়েছে। এরা প্রত্যেকেই হুমায়ূন আহমেদের অভাবনীয় পিতৃস্নেহ পেয়েছে তাদের শৈশবে। কিন্তু নিষাদ আর নিনিতের সারাটা জীবন বেড়ে উঠবে তাদের পিতাকে ছাড়া। তাদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ হয়তো নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন খুঁজেছিলেন। তাদের সাথে ঘাসের মাঝে বসেছিলেন। দোলনায় দুলেছিলেন। তাদের ছোট ছোট হাতের ততোধিক ছোট আ্ঙ্গুলে নিজের রোগজর্জর হাতদুটো ধরিয়ে হয়তো ভেবেছিলেন- এরা আমাকে ছেড়ে দেবে না। এই দুই শিশু-বাবার আদর কেমন তা বুঝার আগেই পিতৃহীন হয়েছে। তারা হয়তো এখনও বুঝেই উঠেতে পারেনি কী অসামান্য ঐশ্বর্য তারা হারিয়েছে তাদের অবোধ শৈশবে।

শাওন এই দুই শিশুপুত্রের মা। তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন এরা তার চোখের সামনে বেড়ে উঠুক তাদের পিতার ভালোবাসা হয়ে। ঘাষফুল হয়ে উঠুক বৃক্ষবাসী পুষ্প।

শাওন লোভী ছিল হয়তো। তিনি লোভ করেছিলেন একজন অসামান্য মানুষের ভালোবাসার পাত্রী হবার। তিনি তা পেরেছেন। এ দেশের অনেক তরুণীই নিশ্চয়ই হুমায়ূন আহমেদকে ঘিরে এমন লোভ পোষণ করেছেন। তারা পারেননি। শাওন পেরেছেন। সেটা তার যোগ্যতা। অথবা সেটা শাওনের প্রতি হুমায়ূন আহমেদের অবোধ্য  প্রশ্রয়। যাই ঘটুক না কেন- জীবনের শেষ সময়টা পর্যন্ত শাওনই ছিলেন তার পাশে। তাকে সাহস দিয়েছেন, গান শুনিয়েছেন, তাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।

শাওনের এই ভালোবাসার টানে হুমায়ূন আহমেদ যদি সুস্থ হয়ে ফিরে আসতেন আমরা কেউ নিশ্চয় শাওনের প্রশংসা করতাম না। কিছু কিছু মানুষের ভাগ্যই এমন-তারা কখনোই প্রশংসা পান না। কিন্তু তাদেরকে যেকোনভাবে হেনস্তা করতে পারলে, যেকোনভাবে দুর্নামের অংশ করতে পারলে আমরা যেন স্বস্তি পাই। শাওন সেরকমই হয়ে গেলেন আমাদের কাছে।

আমরা কিছুতেই মনে করছি না রাতের পর রাত হুমায়ূন আহমেদের বেদনাঘন মুহুর্তগুলোতে কে তাকে উষ্ণ রেখেছে। কে তাকে নতুন করে বাঁচার কথা শুনিয়েছে। কার গানে চোখে জল এনেছেন এই ভীষণ শক্ত হৃদয়ের মানুষটি।

শাওনের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। তিনি প্রবাসীদের জানাননি হুমায়ূন আহমেদের গুরুতর অসুস্থতার খবর এবং পরবর্তীতে তার মৃত্যুর খবর। তিনি দেরিতে গিয়েছেন ফিউনারেল হোমে। যত লোক হওয়ার কথা হুমায়ূন আহমেদের জানাজায় তত লোক হয়নি জ্যমাইকায়। এ দোষও শাওনের। অথচ কেউ বোঝার চেষ্টা করছেন না হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তার দুই শিশুপুত্রকেও দেখতে হয়েছে তাকে। সামলাতে হয়েছে তাদের শোক। তিনি কেবল একজন স্ত্রীই নন, তিনি একজন মা-ও।

কেউ বললেন-বিমানে তাকে নাকি যথেষ্ট শোকাকুল দেখা যায় নি। যেন তার চোখে কালসিটে দেখলেই প্রমাণ হবে তিনি শোকগ্রস্ত। আর না হলে না। কিন্তু আমরা ভাবছি না বিমানের দীর্ঘ যাত্রায় তার ভেঙে পড়লে চলতো না। তার সন্তানদের তখন কে দেখবে? মায়ের কান্না দেখাদেখি তারাও যদি বিমানেই কান্না জুড়ে দেয় তখন কে তাদের সামলাবে? আর শোক কেন কেবল জনসমুখেই করতে হবে? তার এত দায়িত্ব পড়েছে হুমায়ূন আহমেদের জন্য তার ভালোবাসা জাহির করার? এত বছরের সংসারে তিনি কী তার যথেষ্ট পরিচয় দেন নি?

দিয়েছেন বই কি। কিন্তু আমরা তা শুনবো না। আমরা হুমায়ূন আহমেদের জন্য যত না কাতর তার চেয়ে বেশি আক্রমণাত্মক হয়েছি শাওনকে ঘিরে। হুমায়ূন আহমেদ যদিও ভালোবেসেই ঘর করেছেন তার সাথে কিন্তু তার মৃত্যুর জন্য আমরা শাওনকেই দায়ী করবো।

এ অবশ্য আমাদের নতুন বৈশিষ্ট্য নয়। জনপ্রিয়তায় যাকে ছড়িয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ সেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যয় লিখে গেছেন ‘বিলাসী’ গল্প। দেখিয়েছেন সমাজের কাছে কীভাবে মূল্যহীন হয় ভালোবাসা। লোকাচারের কাছে. মিথ্যা বিশ্বাসের কাছে কীভাবে হেরে যায় নিঃস্বার্থ প্রেম। কী অদ্ভুত মিল! বিলাসীর মতোই মৃত্যুঞ্জয়রূপী হুমায়ূন আহমেদের সেবা শুশ্রুষায় পাশে ছিলেন শাওন। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যুর জন্য যেভাবে বিলাসিকে দায়ী করেছে সমাজ, অন্নপাপের খেসারতে মরতে হয়েছে মৃত্যুঞ্জয়কে-একথাই যেভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাদের মনমগজে তেমনিই ঘটলো হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রেও। তিনি মারা গেলেন আর হই হই করে শেষ পর্যন্ত কাঠগড়ায় দাড় করানো হলো শাওনকেই। এতসব প্রশ্ন হাজির হয়েছে যার জবাব বোধকরি স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদও দিতে পারতেন না, শাওন তো দূরের কথা।

সময়য়ের সাথে পুরষতান্ত্রিক সমাজে মৃত্যুঞ্জয়দের অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তারা মৃত্যুর পর সত্যিই মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে ওঠে কিন্তু বিলাসীদের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। তারা তখনো কাঠগড়ায় ছিল। এখনো আছে। হুমায়ূন মুত্যুঞ্জয়ী হয়েছেন। জীবিত হুমায়ূনের চেয়ে মৃত হুমায়ূন আমাদের আরো প্রিয় হয়েছেন। কিন্তু ‘বিলাসী’ শাওন আমাদের আরো অপ্রিয়। তাদের ভাগ্যের কোনো হেরফের হলো না।
  
মুশতাক ইবনে আয়ূব: শিক্ষক ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
                      ইমেইল: clingb@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.