বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন, বাড়াবাড়ি চলতে থাকলে রাষ্ট্রেরই ক্ষতি

একজন বিচারপতির মন্তব্যকে কেন্দ্র করে জাতীয় সংসদের স্পিকারের দেওয়া রুলিং নিয়ে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন বিভাগ (জাতীয় সংসদ) ও বিচার বিভাগের মুখোমুখি অবস্থানে চলে যাওয়াকে রাষ্ট্রের কল্যাণ ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞসহ দেশের বিশিষ্টজনরা। সমস্যার দ্রুত সমাধান দাবি করে তাঁরা বলছেন, এ নিয়ে বাড়াবাড়ি কারো কাম্য নয়।


সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি যে পর্যায়ে গেছে, তাতে এখনই মিটমাট হওয়া দরকার। এ নিয়ে বিতর্ক বা বিরোধ রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর নয়। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি হলে রাষ্ট্র এবং গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গতকাল এক অনুষ্ঠানে আইন প্রতিমন্ত্রীও বলেছেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর মধ্যে এ ধরনের মতপার্থক্য কাম্য নয়।
হাইকোর্টের একজন বিচারপতির বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকারের রুলিং আইনগত ভিত্তিহীন ও অকার্যকর বলে সম্প্রতি হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত রাখা এবং ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি চেয়ে সরকার আবেদন করেছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর এ আবেদনের ওপর আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গতকাল সকালে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. কামরুল ইসলাম এমপি এক অনুষ্ঠানে বলেন, হাইকোর্টের একটি আদেশ নিয়ে সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সাময়িক ঝড় তথা আলোড়নের সৃষ্টি হয়। বল এখন উচ্চ আদালতের কোর্টে। আদালত এমন একটি নির্দেশনা দেবেন, যাতে সাময়িক ঝড় থেমে যাবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের মধ্যে সংসদ বিভাগ আইন প্রণয়ন করবে। নির্বাহী বিভাগ তা প্রয়োগ করবে। নির্বাহী বিভাগ কার্যক্রম ঠিকমতো প্রয়োগ করছে কি না, তা দেখবে বিচার বিভাগ। একই সঙ্গে সংবিধানের রক্ষক হিসেবে কাজ করবে বিচার বিভাগ। এসব বিভাগের মধ্যে মতপার্থক্য কোনোমতেই কাম্য নয়। বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সহকারী জজ, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের ১১৬তম প্রশিক্ষণ কোর্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী এ কথা বলেন।
যোগাযোগ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, বিচার বিভাগ ও আইন প্রণয়ন বিভাগ নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশেই মামলা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এ নিয়ে মামলা চলছে। ব্রিটেনেও এ নিয়ে মামলা চলে এখন সমাধান হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে বিষয়টি নতুন। এই প্রথম স্পিকারের রুলিং চ্যালেঞ্জ করে মামলা হয়েছে। সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক বিকাশের জন্য এ নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। তবে তা হতে হবে সাংবিধানিক সীমার মধ্যে থেকে। কারণ কেউ সংবিধানের বাইরে নয়। এটা যাতে কোনোভাবেই সংঘাতের দিকে না যায়, তা দেখতে হবে।'
হাইকোর্ট বিভাগের সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আমীরুল ইসলামও এ ধরনের উদ্বেগ ব্যক্ত করে কালের কণ্ঠকে বলেন, সংবিধানের রক্ষক সুপ্রিম কোর্ট। সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট স্বাধীন। তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। মামলা হয়েছে। এর সমাধানও হয়েছে। এর পরও বলব, বিচার বিভাগ ও আইন প্রণয়ন বিভাগের মধ্যে একটি সহাবস্থান থাকা দরকার। তিনি বলেন, বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন। এ মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীনও মনে করেন, বিষয়টির দ্রুত সমাধান হওয়া উচিত। তিনি বলেন, একজন বিচারপতির আচরণের কারণে জাতীয় সংসদে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তা যদি কার্যকর করা হয় তবে বিচার বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকবে না। তিনি বলেন, সংসদে বলা হচ্ছে, বিচারক নিয়োগের বিষয়ে ১৯৭২ সালের সংবিধানে যেরূপ বিধান ছিল, সেটা বহাল করা হবে। কিন্তু পঞ্চম সংশোধনী মামলায় বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বহাল রাখা হয়েছে।
মানবাধিকার এবং পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) করা এক মামলায় সড়ক ভবন ও শিশু একাডেমীর জায়গা সুপ্রিম কোর্টের সম্পত্তি বলে রায় দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এ রায়ের পর তা পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় সড়ক ভবন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ দাখিল করা হয়। এ বিষয়ে শুনানিতে গত ১৪ মে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের দেওয়া আদেশ নিয়ে গত ২৯ মে সংসদে আলোচনা হয়। এ আলোচনায় জাতীয় সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ কিছু মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, 'দেশের মানুষের বিচারের ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লেগে যাবে আর নিজেদের বিষয় বলে বিচার বিভাগ ঝটপট সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে, এটি ভালো দেখায় না। আদালতের রায়ে ক্ষুব্ধ হলে জনগণ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে পারে।' ৫ জুন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ স্পিকারের এ বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেন। হাইকোর্ট বলেন, 'এটা হলো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তাঁর বক্তব্য আদালত অবমাননাকর। ওই পদে থাকার অধিকার তাঁর নেই।' আদালতের এ মন্তব্যের পর ওই দিন সন্ধ্যায়ই সংসদে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন সরকারদলীয় কয়েকজন সংসদ সদস্য। তাঁরা বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তাঁকে অপসারণের দাবি জানান।
এ অবস্থায় বিষয়টি নিয়ে ১৮ জুন স্পিকার আবদুল হামিদ রুলিং দেন। তিনি বিচারপতির বিরুদ্ধে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি প্রত্যাহারের জন্য সংসদ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, 'একজন বিচারপতি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন করেছেন।' তিনি বলেন, 'একই সঙ্গে বলব, আদালতের এ ধরনের আচরণে কী করণীয় থাকতে পারে, মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে।'
এ অবস্থায় রুলিংয়ের ওই দুটি অংশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সাবেক বিচারপতি এ কে এম শফিউদ্দিন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। গত ১৮ জুলাই এ রিট আবেদনের ওপর বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ খুরশিদ আলম সরকারের বেঞ্চ শুনানি গ্রহণে বিব্রতবোধ করেন। এরপর রিট আবেদনটি বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে উপস্থাপন করে শুনানি করা হয়। এই আদালত গত ২৪ জুলাই রিট আবেদন নিষ্পত্তি করেন। তবে এ বিষয়ে গত ২৭ আগস্ট চূড়ান্ত রায় প্রকাশিত হয়। এতে আদালত বলেন, স্পিকারের রুলিং সংবিধানের ৯৬(৫) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এ রুলিং সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির সঙ্গেও অসংগতিপূর্ণ।
রায়ে আরো বলা হয়, রাষ্ট্রের কোনো অঙ্গ যাতে সংবিধানে দেওয়া তার ক্ষমতার সীমা লঙ্ঘন না করে, তা দেখার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের। বিশেষ অধিকারের সীমা সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে। এই ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র সুপ্রিম কোর্টের এখতিয়ারাধীন। জাতীয় সংসদ তার এই বিশেষ অধিকার নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিচারক হিসেবে নিজেকে দাবি করতে পারে না। এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করার অনুমতি চেয়ে গত ৩ আগস্ট আবেদন করেছে। ৩০ সেপ্টেম্বর এ আবেদনের ওপর আপিল বিভাগে শুনানি হবে।

No comments

Powered by Blogger.