স্মরণ- অবিস্মরণীয় শাফায়াত জামিল by মনজুর রশীদ খান

দুই বছরেরও কম সময়ে আমার দুজন অতি ঘনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু পরপারে চলে গেলেন। প্রথমে গেলেন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, বীর বিক্রম। এবার টিভিতে অলিম্পিকের অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়লেন কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম।


অনেক দিন তাঁর সঙ্গে কথা হয়নি। বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম, আমার লেখা আমার সৈনিক জীবন-পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ বইটি উপহার দিতে বাসায় যাব। নিজের অসুস্থতার কারণে যাওয়া হয়নি—আর দেখাও হলো না। এই আফসোস ও মনোব্যথা আমাকে বয়ে বেড়াতে হবে আর যে কয়েক দিন বেঁচে থাকব। বইয়ের অনেকটা জুড়ে রয়েছে আমাদের প্রশিক্ষণজীবনের ছোট-বড় ঘটনা, যার স্মৃতিচারণা শাফায়াতকে হয়তো আনন্দ দিত। প্রশিক্ষণ সময়ে আড়াই বছর পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমি, কাকুলে আমরা ছিলাম খুবই ঘনিষ্ঠ। একই কোম্পানি ও একই প্লাটুনে। প্রথম দিকে আমরা ছিলাম রুমমেট। শাফায়াত ছিলেন খুবই সিরিয়াস, পরিশ্রমী, চৌকস ক্যাডেট। পাসআউট তালিকায় তাঁর অবস্থান ছিল চতুর্দশ। ১৯৬৪ সালের ১৮ এপ্রিল পাসআউট হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয় ১৯৭৩ সালের ২২ ডিসেম্বর উত্তরা গণভবনে। ওই দিনটি আমার জন্য দুটি কারণে খুবই স্মরণীয় হয়ে থাকছে। প্রথমত, সেই প্রথম জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ এবং দ্বিতীয়ত, ঘনিষ্ঠ বন্ধুবর মুক্তিযোদ্ধা শাফায়াত জামিলের সঙ্গে মিলন। শাফায়াত তখন রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার। আমি সবেমাত্র পাকিস্তান থেকে ফিরে বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) যশোরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যোগ দিই। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে সভায় উত্তরা গণভবনে আমাদের সমাবেত হতে হয়েছিল। (বিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে উক্ত বইয়ে)
পাকিস্তানে বসে যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারীদের কথা শুনতাম, তখন উৎসাহে মনটা খুব ভরে উঠত। নিজ দেশের সেই চরম দুর্দিনে নিজেদের অক্ষমতার মধ্যে চরম আগ্রহে জানার চেষ্টা করতাম, আমাদের সহকর্মী ও পরিচিতজনদের মধ্যে কারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। যেদিন শুনলাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে শাফায়াতও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন, তখন মনটা গর্বে ভরে ওঠে। আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলাম যে আমাদের মাতৃভূমিকে তাঁরা স্বাধীন করেই ছাড়বেন। আজ সেই শাফায়াত আর নেই। যাঁরা শত্রুমুক্ত করে একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছিলেন, তাঁরা এক এক করে বিদায় নিচ্ছেন। শাফায়াতের মৃত্যুতে আমি শোকাহত।
শাফায়াত ছিলেন একজন শৃঙ্খলাপরায়ণ, ন্যায়নিষ্ঠ আদর্শ চরিত্রের সৈনিক। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে তাঁর মানবতাবোধের একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থিত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি অফিসার ও সেনারা যখন বিদ্রোহ করেন, পাকিস্তানি অফিসার ও সেনাদের আটক করে রাখেন, তখন চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতেও শাফায়াত তাদের নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। ঢাকায় এলে দেখা করতে তাঁর অফিসে যেতাম। ব্যস্ততার মধ্যেও আমার সঙ্গে গল্প করতে বসতেন। অনেক কথা হতো, যার বেশির ভাগই ছিল স্বাধীনতা-উত্তর দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা ও পুনর্গঠন বিষয় নিয়ে।
শাফায়াত বঙ্গবন্ধুর খুবই আস্থাভাজন ছিলেন। তাঁকে ঢাকায় অবস্থিত ৪৬ ব্রিগেডের দায়িত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যে নিহিত ছিল বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবার ও বিশিষ্টজনসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক-বেসামরিক চক্রের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কারণে নৃশংসভাবে নিহত হলে তা শাফায়াত জামিলের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে তিনি সোচ্চার হন। মূলত তাঁরই অব্যাহত চাপে পরবর্তী সময়ে ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ষড়যন্ত্রের মূল হোতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। বঙ্গভবনে অবরুদ্ধ খোন্দকার মোশতাক ও তাঁর সহযোগী সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে তিনিই প্রধান ভূমিকা রাখেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেই অভিযান ব্যর্থ হয় এবং খালেদ মোশাররফসহ কয়েকজন নিহত হন। শাফায়াত জামিলকে কিছুদিন আটক থাকতে হয় ও পরে তিনি চাকরিচ্যুত হন। একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা—যিনি দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন, তিনি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হলেন তাঁরই কিছু সহযোগী-সহকর্মীর হাতে। জানতাম, তিনি মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তবে তাঁকে সবচেয়ে বেশি মর্মপীড়া দিত বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজনদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। তাঁদের নিরাপত্তা রক্ষার ব্যর্থতাকে তিনি মেনে নিতে পারতেন না। নভেম্বরে তাঁদের অভ্যুত্থানের বিপক্ষে যারা পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায়, তাদের ষড়যন্ত্র ছিল আরও ন্যক্কারজনক। এমন রটনা হলো যে খালেদ-শাফায়াত ভারতপন্থী। দেশের প্রতি যাঁর ভালোবাসা প্রশ্নাতীত, সেই শাফায়াতকে এই অপবাদ খুবই মর্মাহত করত। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে যাঁরা প্রথম মুহূর্তেই বিদ্রোহ করেছিলেন এবং ১৫ আগস্টের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়েছিলেন, তাঁদের জন্য এমন অপবাদ অসহনীয় ছিল। এই ঘটনার পর থেকেই তিনি অনেকটাই নিভৃতচারী হয়ে পড়েন।
শাফায়াত ছিলেন মনেপ্রাণে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও নিবেদিতপ্রাণ সেনা কর্মকর্তা। তিনি ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অমায়িক, বন্ধুুপ্রিয় এবং পরিবারের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান ও স্নেহশীল। তাঁর মৃত্যুতে আমি খুবই ব্যথিত। মনে করছি, তাঁর স্ত্রী রাশিদা শাফায়াতের মনোবেদনার কথা, যিনি সৈনিক জীবনের শুরু থেকেই তাঁর সুখ-দুঃখের সাথি ছিলেন। তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করছি মহান আল্লাহ তালার কাছে, যাঁর দরবারে একদিন আমাদের সবাইকে হাজির হতে হবে। আর তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলেসহ সব আত্মীয়স্বজনকে জানাই আমাদের অতি আন্তরিক শোকানুভূতি। এই সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি রইল আমার সশ্রদ্ধ স্যালুট।
মেজর জেনারেল (অব.) মনজুর রশীদ খান: লেখক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা।

No comments

Powered by Blogger.