৪০,০০০,০০০,০০০ টাকা আত্মসাতের সহজ উপায়... by শফিক রেহমান

গাজীপুরে মেইন রোডের পাশে শালবন পেরিয়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে একটি অতি আধুনিক দোতলা বাড়ি। জেনারেটর চলছে। মেইন রোডে চলাচলকারীদের বোঝার বা জানার উপায় নেই শালবনের পেছনে এই বাড়িটির অস্তিত্ব। বনজঙ্গলের ফলে মেইন রোডে জেনারেটরের শব্দ শোনা যায় না।

বাড়ির চার পাশে উঁচু দেয়াল। চকচকে স্টেইনলেস স্টিলের মেইন গেইটে সার্বক্ষণিক পাহারা দিচ্ছে নেভি ব্লু রংয়ের ইউনিফর্ম পরা স্মার্ট সুস্বাস্থ্যবান সিকিউরিটি গার্ডরা। গেইটের সামনে ছোট নেইম প্লেট। বাড়ির নাম সুবন্ধু হাউজ।
সুবন্ধু হাউজের সামনে-পেছনে বাগানে ফুটে রয়েছে বহু রকমের ফুল। ফুলগাছের শোভা বাড়ানোতে সাহায্য করছে এক ডজন পানির ফোয়ারা। শাদা মার্বেলে তৈরি নারীমূর্তির দেহ থেকে ঝরে পড়ছে পানি। এসব ফোয়ারা ইটালি থেকে আমদানি করা এবং সার্বক্ষণিক চলমান।

এই বাড়ির ডাইনিং রুমের ডিনার টেবিলে সুন্দরভাবে প্লেস করা জাপানিজ নরিটাকি (Noritake) ব্র্যান্ড বোন চায়না প্লেট, কাপ ও পিরিচ, সোনালি কাজ করা ইটালিয়ান আরসিআর দা ভিঞ্চি কালেকশন (RCR da Vinci Collection)-এর কাট গ্লাস এবং ইংলিশ ম্যাপিন অ্যান্ড ওয়েব (Mappin & Webb)-এর সিলভার কাটলারি। প্রায় নিঃশব্দে জেনারেল স্পিট এসি চলছে। দেয়ালে ছাপ্পান্ন ইঞ্চির স্যামসাং ফ্যাট স্কৃন টেলিভিশনে চলছে বাংলাদেশী একটি নিউজ চ্যানেল। কিন্তু সাউন্ড অফ করা। এর উল্টো দিকের দেয়ালে স্পিট স্কৃনের সিকিউরিটি মনিটর চলছে, যাতে দেখা যাচ্ছে এই বাড়ির বাইরে ও ভেতরের বিভিন্ন স্থানে কি ঘটছে।
কাল : লাঞ্চ টাইম, সেপ্টেম্বর ২০১২।

পাত্র : সুবন্ধু হাউজের মালিক মি. ভূমিদস্যু যিনি এই লাঞ্চের হোস্ট এবং নিমন্ত্রিত পাচ গেস্ট, যথাক্রমে মি. মিগদস্যু, মি. উলফাদস্যু, মি. শেয়ারবাজারদস্যু, মি. মালটি লেভেল মার্কেটিং সংক্ষেপে এমএলএমদস্যু এবং মি. কুইকরেন্টালদস্যু।

এরা সবাই টেবিলের চার পাশে বসে খাচ্ছেন ও কথা বলছেন। নীরবে খাবার ও পানীয় পরিবেশন করছেন ইউনিফর্ম পরা দু’জন পুরুষ ওয়েটার। তাদের সুপারভাইজ করছেন সুট টাই পরা হাউজ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ ম্যানেজার।
সতর্কীকরণ: সকল চরিত্র, সংলাপ ও ঘটনা সম্পূর্ণ কাল্পনিক।

ভূমিদস্যু (সামনের খালি গ্লাসে একটা চামচ ঢুকিয়ে টুং টাং করে নাড়লেন) : জেন্টলমেন। এত শর্ট নোটিশে আপনারা সবাই যে দয়া করে এই গরিবখানায় এসেছেন সেজন্য প্রথমেই আমি আপনাদের হাজার ধন্যবাদ জানাতে চাই। থ্যাংক ইউ। নিমন্ত্রণের সময়ে আমি ফোনেই আপনাদের জানিয়েছি আজ এখানে সমবেত হবার কারণ। আমরা লাঞ্চ খেতে খেতে আমাদের সমস্যা বিষয়ে আলোচনা করব এবং পরিশেষে আমাদের করণীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।

মিগদস্যু (ভীত স্বরে): ২৪ নভেম্বর ২০০৬-এর উত্তরা ষড়যন্ত্রের মতো কোনো বিপদ হবে না তো? পুলিশ, র‌্যাব, এনএসআই, ডিজিএফআইয়ের ঝটিকা উপস্থিতি ঘটবে না তো?

ভূমিদস্যু (মৃদু হেসে) : না। সে ভয় নেই। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য যেখানে যত দরকার সেখানে সে টাকা খরচ করা হয়েছে। যে প্রভাব বিস্তার করা দরকার তা করা হয়েছে। আমার নিজের একসেলেন্ট সিকিউরিটি ফোর্স গাজীপুর চৌমাথা থেকে নজর রাখছে। যে শালবন আপনারা পেরিয়ে এসেছেন, সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা বহু গাছে ফিট করা আছে। তাই এখানে বসেই ওই মনিটরে (আঙুল তুলে দেখিয়ে) আপনারা দেখতে পাচ্ছেন কোথায় কি ঘটছে। তা ছাড়া শুধু একজন বাদে আমাদের সবারই হাতে বিভিন্ন ধরনের মিডিয়া আছে। আমার তিনটি বাংলা-ইংরেজি দৈনিক ও একটি অনলাইন নিউজ সার্ভিস আছে। (মিগদস্যুর দিকে আঙুল দেখিয়ে) যদিও মিডিয়াতে আগমন ইচ্ছা সত্ত্বেও আপনার উপস্থিতি হয়েছে বিলম্বিত, তবুও এখন আপনার আছে একটি বাংলা দৈনিক। (উলফাদস্যুর দিকে তাকিয়ে) আপনার আছে একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিক, একটি বাংলা সাপ্তাহিক এবং একটি রেডিও স্টেশন। (শেয়ারবাজারদস্যুর দিকে তাকিয়ে) আপনার আছে একটি নিউজ টিভি চ্যানেল, একটি ইংরেজি দৈনিক এবং একটি অনলাইন নিউজ সার্ভিস। (এমএলএমদস্যুর দিকে তাকিয়ে) আপনার আছে একটি টিভি চ্যানেল ও একটি বাংলা দৈনিক। (কুইকরেন্টালদস্যুর দিকে তাকিয়ে) আপনি এখনো মিডিয়াতে আসেননি বলে জানি। তা সত্ত্বেও মিডিয়াতে আমাদের সম্মিলিত উপস্থিতি খুবই স্ট্রং। আমরা যদি সবাই একাট্টা থাকি তাহলে কেউ আমাদের চুলও ছুতে পারবে না।

উলফাদস্যু (অভিযোগের স্বরে): আমরা মিডিয়াতে পারস্পরিক সহযোগিতায় বিশ্বাসী। আপনিই আমাদের পিছু লেগেছিলেন এবং এখনো মাঝে মাঝে আমার বাংলা পত্রিকার সম্পাদকের পেছনে লাগেন। তার এবং আমার ছবিসহ পোস্টার ছেপে ঢাকা চিটাগাং সয়লাব করেছিলেন।

ভূমিদস্যু: আপনার এ অভিযোগ সত্য নয়। আপনারাই আমার পেছনে লেগেছিলেন। পরিণতিতে ওয়ান-ইলেভেনের আগেই আমাকে সপরিবারে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। তখন আপনি ও আপনার দুই সম্পাদক মহা আনন্দে ছিলেন। সরকার পরিবর্তিত হবার পরে আমি ফিরে আসতে পারি। আপনার বাংলা সম্পাদকের দ্বৈত চরিত্র সম্পর্কে সাবধান থাকবেন। তিনি কিন্তু এক সময়ে ধনিক বণিক গোষ্ঠীর লুটপাটের বিরুদ্ধে লিখতেন। এখন নিজেই ধনিক বণিকের কাগজ সম্পাদনা করছেন। সমাজতন্ত্রের পক্ষে কাজ করে এখন ধনতন্ত্রের পক্ষে কাজ করছেন। যাক সে সব কথা। অতীতের কথা ভুলে যান। বর্তমানে আসুন। বর্তমানে আমাদের বিপদ হয়েছে এবং ভবিষ্যতে মহাবিপদ আসছে। এসব বিপদ সম্মিলিতভাবে সামলাতে হবে। নইলে আরেকটা ওয়ান-ইলেভেন হলে আমরা সবাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। (উলফাদস্যুর দিকে তাকিয়ে) এবার আপনিও রেহাই পাবেন না। সুতরাং আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

মিগ, শেয়ারবাজার, এমএলএম ও কুইকরেন্টালদস্যু (সমস্বরে): তা ঠিক। তা ঠিক।


ভূমিদস্যু: আজ যত সময়ই লাগুক আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সর্বসম্মতিক্রমে। (একটু থেমে) আপনারা সবাই নামাজ রোজা করেন। হজে গিয়েছেন। আমিও। (টেবিলে পরিবেশিত খাবারের দিকে ইঙ্গিত করে) এখানে সবই হালাল।

শেয়ারবাজারদস্যু (লম্বা শাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে মৃদু স্বরে) : জীবনে অনেক হারাম কাজ করেছি। আর কত?

ভূমিদস্যু: তবুও আমাদের সবাইকে হয়তো শেষ একটা হারাম কাজ করতে হবে। কারণ এই দেশের সবচেয়ে বড় হারামি, সবচেয়ে বড় পাপীষ্ঠ, সবচেয়ে বড় জালিয়াত আজ আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে। যেকোনোভাবেই হোক না কেন, এই জালিয়াতকে আমাদের কনট্রোল করতেই হবে। তাকে শাস্তি দিতেই হবে। তাকে ফিনিশ করতেই হবে।


এমএলএমদস্যু (গম্ভীর স্বরে): নইলে আমরাই ফিনিশ হয়ে যাবো। যে টাকা দেশে আছে আগামীতে সেনা সমর্থিত সরকার এলে সেই সব টাকা তারা জব্দ করবে। ফৃজ করবে। বিদেশে পাচার করা টাকাও কোনো কাজে আসবে না। কারণ আমাদের সবাইকে জেলে ভরা হতে পারে।

কুইকরেন্টালদস্যু: সে তো পরের কথা। ২০১৩-র শেষ দিক অথবা ২০১৪-র প্রথম দিকের কথা, যখন পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে সারা দেশে সহিংসতা শুরু হয়ে যেতে পারে। আওয়ামী লীগ যেটা ২০০৬ সালে করেছিল এবং এবার যেটা বিএনপি করতে পারে। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে আমাদের সমস্যা হলো আমাদের সব মানসম্মান ডুবতে বসেছে। আমাদের শত্রু ও সমালোচকের সংখ্যা বাড়ছে। এমনকি আওয়ামী সরকারপ্রধানের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও সরকারের মধ্যেই আমাদের নিয়ে অনেকে উপহাস করছে। সবাই বলছে, আমরা কি করলাম এত দিন? ওই জালিয়াত কি নির্ঝঞ্ঝাটে চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিল অথচ সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। অর্থমন্ত্রী তো বলেই দিলেন, ‘চার হাজার কোটি টাকা কোনো ব্যাপারই না। সরকার তো বছরে চল্লিশ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়। এ তো মাত্র ওয়ান পার্সেন্ট।’ এক সাংবাদিক তাকে ভুল ধরিয়ে দিলে তিনি তাৎক্ষণিক সংশোধন করেন যে এটা টেন পার্সেন্ট!

তিনি স্বীকার করেন, ওয়ানের পরে একটা জিরো বসবে অর্থাৎ টেন হবে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী জানেন না, তীর এবং কথা একবার ছুড়লে তা আর ফেরানো যায় না। অর্থমন্ত্রী হলেও তার এই ভুলটিতে প্রমাণিত হয় যে তিনি অংকে কাচা।

মিগদস্যু: জিরো নিয়ে আওয়ামী লীগের দলগত সমস্যা ১৯৭২ থেকেই আছে। তিন লক্ষ ত্রিশ লক্ষ হয়ে গিয়েছিল। তখন সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল দশ গুণ। এখন অর্থমন্ত্রী সংখ্যা কমিয়ে দিলেন দশ গুণ।

এমএলএমদস্যু: এজন্যই আমাদের নামে অপপ্রচার ওরা চালাতে পেরেছে। আমরা নাকি হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা লোপাট করেছি। অর্থমন্ত্রীর মতো জিরো কমিয়ে বললেই সব কিছু সহনীয় হতে পারে। আমরাও বলতে পারি- ‘এটা কোনো ব্যাপারই না।’

ভূমিদস্যু: আচ্ছা, আপনারা কি লক্ষ্য করেছেন, আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো রিপোর্টে কেউ চার হাজার কোটি সংখ্যাটিকে সংখ্যায় লেখেনি। কারণটা কি? কারণ ওই জিরো। চার হাজার কোটি লিখতে ৪-এর পরে কটা শূন্য বসবে সে বিষয়ে অনেকেই অজ্ঞ অথবা অনিশ্চিত। তাই সংখ্যাটি শব্দে লেখা হচ্ছে। যাই হোক, চার হাজার কোটি হচ্ছে ৪০,০০০,০০০,০০০। অর্থাৎ ৪-এর পর দশটা শূন্য বসবে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে এর বিশালত্ব বোঝা অসম্ভব। একটি গার্মেন্ট গার্লের মাসিক আয় মাত্র ৩,০০০ টাকা। সে বুঝবে কি করে চার হাজার কোটি তার আয়ের তুলনায় কত বেশি?

আমার মনে হয়, চার হাজার কোটি টাকায় কি সম্ভব সেটা বোঝালে সাধারণ মানুষের হৃদয়ঙ্গম হবে এই জালিয়াতির পরিমাণ।

আমি ফ্যাট বিক্রি করি। প্রথমে ফ্যাটের উদাহরণ দিয়েই বলি। ৮০০ স্কোয়ার ফিটের একটা ফ্যাট বানাতে ২,৫০০ টাকা প্রতি স্কোয়ার ফিটে খরচ হলে, প্রতি ফ্যাট নির্মাণে মোট খরচ হবে বিশ লক্ষ টাকা। তার মানে, চার হাজার কোটি টাকায় ২০,০০০ ফ্যাট বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটায় অথবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে বিলি করা যেত। এতে সরকার নির্ভর আবাসিক সঙ্কট অনেকটা কমতো।

একটা ভালো পাবলিক বাসের দাম পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। চার হাজার কোটি টাকায় রাজধানীর পথে ৮,০০০ পাবলিক বাস নামানো যেত। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন চলাচলের সমস্যা দূর হতো।

একটা রেলওয়ে ইঞ্জিনের দাম ১২৮,০০০,০০০ টাকা। চার হাজার কোটি টাকায় ৩১৩টা রেলওয়ে ইঞ্জিন কেনা যেত এবং বর্তমান রেলমন্ত্রীকে রোজ এতটা পথ হেটে কোনো রেলওয়ে কর্মীকে চড় মারতে হতো না।

দৈনিক ৬০০ আউটডোর পেশেন্ট ক্যাপাসিটি ও ৯০০ জেনারেল বেড পেশেন্ট ক্যাপাসিটির একটা হসপিটাল বানাতে ২০০,০০০,০০০ টাকা পড়বে। চার হাজার কোটি টাকায় এ রকম দুশটা হসপিটাল সারা দেশে বানানো যেত। দেশের মানুষকে ঢাকা মেডিকাল হসপিটাল অথবা পিজি (Pran Gopal, প্রাণগোপাল) হসপিটালে ছুটতে হতো না।

একটা বেসিক ল্যাপটপের দাম হতে পারে পাইকারি রেটে ১০০ ইউএস ডলার অর্থাৎ ৮,০০০ টাকা। চার হাজার কোটি টাকায় বাংলাদেশের পঞ্চাশ লক্ষ ছাত্রছাত্রীকে ফৃ ল্যাপটপ দেয়া যেত। ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তার কিছুটা পূরণ সম্ভব হতো।

একজন ছাত্রকে ইংল্যান্ডে রিটার্ন টিকেটসহ পাঠিয়ে এক বছরে ইংরেজি কাস করাতে খরচ হবে ১,০০০,০০০ টাকা। চার হাজার কোটি টাকায় ৪০,০০০ ছাত্রছাত্রীকে ইংল্যান্ডে এক বছরের জন্য পাঠানো সম্ভব হতো। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি রূপে দাবিদার যেসব গার্ডিয়ান তাদের ভোট কেনা সম্ভব হতো মুক্তিযোদ্ধার কোটায় তাদের ছেলেমেয়েকে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে।


আগামী নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের ভোট খুব সহজেই কেনা যেত।

ধরা যাক, দেশের দুই কোটি তরুণ-তরুণী প্রেম করতে চাইছেন। তারা কাছে থাকতে চাইছেন! ভালোবাসার টানে পাশে আসতে চাইছেন। তারা মানসিক ও জৈবিক তাড়নায় মোবাইল ফোন নির্ভর হয়ে পড়েছেন। প্রতি ফোন কলের দাম ২৯ পয়সা হলে এক কোটি প্রেমিক যদি প্রতিদিন এক মিনিট কথা বলেন আরেক কোটি প্রেমিকার সঙ্গে, তাহলে খরচ হবে ২,৯০০,০০০ টাকা। এই হিসাবে দুই কোটি প্রেমিক যদি প্রতিদিন এক ঘণ্টা প্রেমালাপ করেন, তাহলে তারা চার হাজার কোটি টাকায় প্রায় আট মাস ধরে প্রেমালাপ চালিয়ে যেতে পারবেন। তাদের প্রেম ও ভালোবাসা বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক ভূমিকা নিত, তার ফলে প্রধানমন্ত্রীর শান্তিতে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার সম্ভাবনা জোরালো হতো।

আর এত ঝামেলায় না গিয়ে ডাইরেক্ট প্রপাগান্ডায় যদি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাহলে পাইকারি হারে ৫০০ টাকায় বঙ্গবন্ধু কোট বানিয়ে চার হাজার কোটি টাকায় আট কোটি পুরুষকে দেয়া যেত। তার মানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা যদি পনের বা ষোল কোটি হয় এবং তার অর্ধেক যদি পুরুষ হয়, তাহলে চার হাজার কোটি টাকায় বাংলাদেশে সব পুরুষকেই এই শীতের আগেই বঙ্গবন্ধু কোট ফৃ দেয়া যেত। অর্থমন্ত্রী, অর্থ মন্ত্রণালয় ও ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কেউই বোঝেননি ভোট কেনার কি সুযোগ তারা হারিয়েছেন।

উলফাদস্যু : অর্থমন্ত্রী এখন পার্লামেন্টে বলেছেন, তার ওরকম কথা বলা উচিত হয়নি। তিনি ক্ষমাও চেয়েছেন। তবে এটা তাকে ক্ষমা করার বিষয় নয়- এটা হচ্ছে তার বিশ্বাসযোগ্যতার বিষয়। ওই হাইলি অ্যালার্ট সাংবাদিক ওয়ান পার্সেন্ট আর টেন পার্সেন্টের ভুলটা ধরিয়ে না দেয়া পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর মানসিকতায় চার হাজার কোটি টাকা, চল্লিশ হাজার কোটি টাকার এক শতাংশ রূপেই বিরাজ করছিল। তাই তিনি কেলেঙ্কারিটি উদঘাটিত হবার পরেও বিষয়টিকে আমলে আনছিলেন না। কিন্তু ওয়ান পার্সেন্ট হলেও এখানে যে চার হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, তার গুরুত্ব তিনি বোঝেননি। সুতরাং এখন তিনি ক্ষমা চাইলে মানুষ তাকে ক্ষমা করলেও করতে পারে- কিন্তু বিশ্বাস করবে না।

শেয়ারবাজারদস্যু: ক্ষমাও হয়তো করবে না। শেয়ারবাজার আমরা ম্যানিপুলেট করার পর অর্থমন্ত্রী গালিগালাজ করেছিলেন, আমাদের আর সাধারণ মানুষকে। সেই সাধারণ মানুষ তাকে এখন গালিগালাজের সুযোগ পেয়েছে। নো ওয়ান্ডার, অর্থমন্ত্রীর কানেও এটা পৌঁছেছে। তাই তিনি স্বীকার করেছেন, তিনিই এখন দেশের সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত ব্যক্তি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল বলেছেন, অর্থমন্ত্রী নিজেই এখন রাবিশ হয়ে গিয়েছেন।

ভূমিদস্যু: তার এই স্টেটাস হয়তো বেশি দিন নাও থাকতে পারে। যারা আগামী নির্বাচনে আবারো দাড়াতে চান, সেই সব উদ্বিগ্ন আওয়ামী এমপিদের দাবিতে অর্থমন্ত্রীকে হয়তো পদত্যাগ করতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পদ ছেড়ে যাওয়া মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো অর্থমন্ত্রীকেও ‘দেশপ্রেমিক’ টাইটেল দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। সে যাই হোক, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তারুয়া গ্রামের যে সন্তানটির কারণে আজ আমরা এখানে সমবেত হয়েছি তার নামটি এখন পর্যন্ত কেউ উচ্চারণ করেননি। কারণটা কি? তার সঙ্গে আওয়ামী সরকারের কিছু শীর্ষ ব্যক্তির সুসম্পর্ক আছে বলে? কারণ যা-ই হোক না কেন, আমি নামটা বলছি। তিনি হচ্ছেন হলমার্ক গ্রুপের কর্ণধার তানভীর মাহমুদ তফসির। তানভীরের সত্তরোর্ধ্ব পিতা নুরুল ইসলাম কালু মিয়া এখনো গ্রামে টিনের ঘরেই থাকেন। পাশেই তানভীরের নবনির্মিত দোতলা বাড়িতে কালু মিয়ার যাওয়া নিষিদ্ধ। চিটাগং ও কুমিল্লার এজেন্টদের কাছ থেকে মাল এনে কালু মিয়া এলুমিনিয়ামের পাতিল ও বাসনের ব্যবসা করতেন।


কালু মিয়ারা পাচ ভাই। বড় তিনি। দ্বিতীয় রইস মিয়া রেশন দোকানি। তৃতীয় মোখলেস মিয়া কৃষিকাজ করেন। চতুর্থ শফিকুল ইসলাম ও পঞ্চম হোসেন মিয়া উল্লেখ করার মতো কোনো কাজ করেন না।

কালু মিয়ার দুই ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তান হয়, তানভীর প্রথম ছেলে। সে পাশের তালশহর এআই হাই স্কুলে পড়াশোনা করে। ১৯৯৩-৯৪-এর দিকে বিয়ে করে। তার সুশ্রী স্ত্রীর নাম জেসমিন। তানভীরের একটি পুত্রসন্তান আছে।

কালু মিয়া বলেন, ১০-১২ কানিক্ষেত ও ঢাকায় শেখেরটেকের বাড়ি বিক্রি করে তিনি ও তার ছেলে দশ-বারো বছর আগে ঢাকায় চলে যান। সেখানে একটা মুদির দোকান দেন। কিছুকাল পরে তানভীর একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে অল্প বেতনে কাজ করেন। তারপর পিতার টাকায় হলমার্ক প্যাকেজিং নামে নিজের ব্যবসায় শুরু করেন।

এর পরের কয়েক বছরে কিভাবে তানভীর ব্যবসায় এত উন্নতি করলেন সে বিষয়ে গ্রামবাসীর কোনো ধারণা নেই। তবে তানভীরের বিত্ত সম্পর্কে কিছু ধারণা তাদের হয়। রোজার ঈদে পাচ-ছয় ট্রাক কাপড় গ্রামে বিতরণ করা হতো। কোরবানির ঈদে ট্রাকে করে অনেক গরু আনা হতো। ইফতারের জন্য গ্রামের সতেরটি মসজিদে দশ হাজার টাকা করে দেওয়া হতো। প্রতি বছর মা আনোয়ারা বেগমের মৃত্যুবার্ষিকীতে তিন-চার হাজার লোক খাওয়ানো হতো। গ্রামবাসী শুনেছিল ঢাকায় তানভীরের অন্ততপক্ষে সাতাশটা গাড়ি আছে, আর আমরা শহরবাসীরা দেখেছি, রূপসী বাংলা হোটেলের সোনালী ব্যাংক ব্রাঞ্চের কেলেঙ্কারি ফাস হবার পর তানভীর যখন প্রথম সাংবাদিকদের সামনে উপস্থিত হন, তখন নাম্বার প্লেটবিহীন একটি পাজেরো গাড়িতে আসেন, যার আগে-পিছে ছিল একাধিক গাড়ি। সেই সময়ে তানভীর এটাও বলেন, যে চার হাজার কোটি টাকা তিনি নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে, সেটার পাই-টু-পাই শোধ করার সামর্থ্য তার আছে। কারণ তার সম্পত্তির পরিমাণ এর বিশ গুণ। অর্থাৎ আশি হাজার কোটি টাকা! মাত্র দশ বছরে তিনি কিভাবে আশি হাজার কোটি টাকার মালিক হলেন সেই প্রশ্নও এখন উঠেছে।

(গ্লাসে পানি ঢেলে একটু খেয়ে) মুদির দোকানি থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হওয়াটা নিন্দনীয় নয়। বরং প্রশংসারই বটে। তবে প্রশ্নটা হচ্ছে তিনি কিভাবে মালিক হলেন। আমি নিজেও ঢাকার মৌলভীবাজারে একটা চায়ের দোকান খুলে ব্যবসায় শুরু করেছিলাম। তারপর গিয়েছি রিয়াল এস্টেট ব্যবসায় এবং বহু ধরনের ইন্ডাস্ট্রিতে। কিন্তু চটচলদি এত বড়লোক আমিও তো হতে পারিনি!

তা ছাড়া সম্পত্তি অর্জন করতে গিয়ে আমাকে কত কঠিন সমস্যা পোহাতে হয়েছে। (উলফাদস্যুর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে) আপনার পত্রিকা দুটোতে আমার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন রিপোর্ট হয়েছিল। মানুষ আমাদের ভূমিদস্যু টাইটেল দিয়েছিল। মানুষের আবাসিক সঙ্কট মেটানোর জন্য যে এত কাজ করলাম তার কোনো স্বীকৃতিই পেলাম না। পতিত ভূমিকে উন্নত ভূমি করলাম। সেখানে ইন্টারন্যাশনাল হসপিটাল হলো, ইন্টারন্যাশনাল স্কুল হলো, ইউনিভার্সিটি হলো, কনভেনশন সেন্টার হলো, করপোরেট হেড কোয়ার্টার হলো। কিন্তু হায়! কারো কোনো স্বীকৃতি কোনো দিনই পেলাম না। শুধু গালি আর গালি। ভূমিদস্যু আর ভূমিদস্যু। তারপর সেনাসমর্থিত সরকারের হুমকি আর চাদাবাজি। স্বেচ্ছানির্বাসনে গিয়ে প্রাণ বাচাতে হলো। এখন দেশে ফিরে এসেও শান্তি নেই। ব্যবসায়ে চলছে প্রচণ্ড মন্দাবস্থা। ফ্যাট বিক্রি প্রায় বন্ধ। গ্যাস কানেকশন নেই। ইলেকটৃসিটি কানেকশন নেই। তা ছাড়া ক’জনের কাছেই বা শাদা টাকা আছে যে ফ্যাট কিনবে?

আগে বিদেশে গিয়ে আমরা রিহ্যাব মেলা করতাম। এখন তাতেও কোনো লাভ নেই। দেশের অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে প্রবাসীরা এখন দেশে ইনভেস্ট করতে চাইছেন না। এর ওপর সেই পুরানো দুশ্চিন্তা তো আছেই। আওয়ামী সরকারের পর আরেকটা সেনাসমর্থিত সরকার এলে আবার চাদাবাজি, জুলুমবাজি, স্পেশাল কোর্ট, জেলহাজত অথবা আবার স্বেচ্ছানির্বাসনে যাওয়া। ওহ মাই গড।

এখন দেখুন তানভীর কত কেভার। এক. (শেয়ারবাজারদস্যু ও এমএলএমদস্যুর দিকে তাকিয়ে) তানভীর আপনাদের মতো সাধারণ মানুষের টাকা সরাসরি মেরে দেয়নি।

(কুইকরেন্টালদস্যুর দিকে তাকিয়ে) আপনার মতো সরাসরি তানভীর সাধারণ মানুষকে বিদ্যুতের বেশি দাম দিতে বাধ্য করেনি। তাই তানভীরের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। বরং তানভীর তার পক্ষে কিছু মানুষকে বিক্ষোভে সাভারের পথে নামাতে পেরেছে। সারা ঢাকা শহর তার পক্ষের পোস্টারে ভরাতে পেরেছে। দুই. যেহেতু জনগণের সাথে তার কোনো সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল না এবং নেই, সেহেতু তার উত্থান নিয়ে কেউ (উলফাদস্যুর দিকে তাকিয়ে) ঈর্ষান্বিত ছিল না। মিডিয়ার কোনো নজর তার প্রতি ছিল না। তিন. যেহেতু তানভীরের ব্যবসায় স্রেফ কাগুজে সেহেতু দেশের কোনো চলমান সমস্যাই তাকে পীড়িত করেনি। গ্যাস বিদ্যুৎ না থাকলেও এবং দেশে চলমান অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা থাকলেও তার কখনোই কোনো সমস্যা হয়নি। চার. আমিও আওয়ামী সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ রেখে চলেছি। তার পরও মাঝে মধ্যে অসুবিধায় পড়তে হয়েছে। কিন্তু তানভীর আওয়ামী শীর্ষ পর্যায়ের এমন কিছু ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পেরেছে যার ফলে তার সম্পর্কে সরকারি প্রতিক্রিয়া হয়েছে অবিশ্বাস্যভাবে দুর্বল।

অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তানভীরের কাছ থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। যেহেতু মিডিয়া এখন এ নিয়ে লেখালেখি করছে সেহেতু বাকি টাকার জন্য আদালতে গেলে সেটা কখন নিষ্পত্তি হবে সেটা আল্লাহই মালুম।

অর্থমন্ত্রী বলেননি কবে এবং কিভাবে দুই হাজার কোটি টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। উপরন্তু বাকি দুই হাজার কোটি টাকা যে ফেরত পাওয়া যাবে না সে বিষয়ে হাসিমুখে মোলায়েম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। অথচ (শেয়ারবাজারদস্যুর দিকে তাকিয়ে) মনে করে দেখুন, স্টক এক্সচেঞ্জ কেলেঙ্কারির পরে তিনি আপনাদের দুষ্ট লোক বলেছিলেন এবং বিনিয়োগকারীদের আরও কঠিন সমালোচনা করেছিলেন।

আমাদের বিরুদ্ধে চাদাবাজ সরকারগুলো লেগে যায় বলে মিডিয়াতে প্রচুর ইনভেস্ট করতে হয়েছে। দৈনিক পত্রিকা করতে হয়েছে। অনলাইন নিউজ সার্ভিস করতে হয়েছে। টিভি চ্যানেল খুলতে হয়েছে। রেডিও স্টেশন করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ সাংবাদিক লেখক কলামিস্টদের পেছনে নিয়মিত খরচ করতে হয়েছে। লন্ডন প্রবাসী এক কলামিস্ট যিনি একটি গানের অর্ধ রচয়িতা এবং যিনি জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে এপৃল ১৯৭৪ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র সোয়া দুই বছর ছিলেন, তাকে নিয়মিত পাউন্ড পাঠাতে হয়েছে, মানিলন্ডারিং অভিযোগের ঝুকি নিয়ে। এসব কিছুই করতে হয়নি তানভীরকে।

এ ছাড়া ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের সাথে রেগুলার কনটাক্ট রাখতে হয়েছে। বিভিন্ন চেম্বারে পদ দখল করতে হয়েছে। এসব কিছুই করতে হয়নি তানভীরকে।

তাহলে আজ আমাদের স্বীকার করতেই হবে, তানভীর মাহমুদ তফসিরই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বুদ্ধিমান, কৌশলী ও সফল ব্যবসায়ী যে জনগণকে প্রত্যক্ষভাবে আঘাত না করে, সব কূল এমনভাবে রক্ষা করে চলেছে যার ফলে তার বিরুদ্ধে কোনো কড়া একশন নিতে সরকার এখন পর্যন্ত উদ্যোগী হয়নি। তানভীর আমাদের সবাইকে টেক্কা দিয়েছে। আমরা সবাই ফালতু। ফালতু। ফালতু।

মিগদস্যু: ঠিকই বলেছেন। আমার বিরুদ্ধে সেনাসমর্থিত সরকার বহু একশন নিয়েছিল। গুলশানে বহুতল হোটেল নির্মাণে বাধা সৃষ্টি করেছিল।

উলফাদস্যু: আমার পরিবার ভয়াবহ দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে। ওই সেনাসমর্থিত সরকার আমাকে দুইশ দুর্নীতিবাজদের লিস্টভুক্ত করেছিল।

শেয়ারবাজারদস্যু: আপনাকে ওয়ান-ইলেভেন সরকার জেলে নেয়নি। আমাকে জেলে নিয়েছিল। তারপর এই আওয়ামী সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্ত তেত্রিশ লাখ পুজি বিনিয়োগকারী আমাদের পিছু লেগেছিল। আওয়ামী সরকারের রহমতে এখন কিছুটা স্বস্তিতে আছি। ভবিষ্যতে কি হবে জানি না।

এমএলএমদস্যু (বিব্রত স্বরে): লুটপাটে আমরা নবাগত। ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময়ে আমরা ছিলাম না। এখন আছি। কিন্তু বড়ই বিপদে আছি। মুক্তিযোদ্ধা ও আওয়ামী সমর্থক জনৈক জেনারেলকে শীর্ষ পদে বসিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। জামিনে মুক্ত আছি। একাউন্ট সব ফৃজ হয়ে গেছে। আমাদের পেছনে লাগবে পঞ্চাশ ষাট লাখ বিনিয়োগকারী। আমাদের ভবিষ্যতে যে কি আছে সেটা অর্থমন্ত্রীর ভাষায় বলতে হয়, আল্লাহই মালুম। আল্লাহর অসীম দয়ার ওপর নির্ভর করা ছাড়া আর কোনো পথ দেখছি না।

কুইকরেন্টালদস্যু: আপনারা বলছেন, আপনাদের পেছনে লেগেছে কয়েক লাখ মানুষ। আমার সমস্যার তুলনায় এটা তো কিছুই না। বাংলাদেশের পনের কোটি মানুষ আমাদের পেছনে লেগেছে। তারা বলছে, আমরা নাকি অচল জেনারেটর আমদানি করেছিলাম। অথবা সেকেন্ড হ্যান্ড দুর্বল জেনারেটর ইমপোর্ট করেছিলাম। আমরা নাকি সরকারের কাছে খুব চড়া দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করছি। তাই সরকার বাধ্য হয়েছে এর মধ্যে ছয়বার বিদ্যুতের দাম বাড়াতে। সর্বশেষ দাম বেড়েছে পহেলা সেপ্টেম্বরে এসব কারণে কোটি কোটি মানুষ ক্ষেপে আছে। তারা স্বীকারই করতে চায় না যে আমরা বাংলাদেশ থেকে লোডশেডিং দূর করেছি। অকৃতজ্ঞ কোথাকার। আনগ্রেটফুল লট। সব রাজাকার। সব মুক্তিযুদ্ধবিরোধী।

উলফাদস্যু: লোডশেডিং দূর হলো কোথায়? প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন, ‘মানুষ যাতে লোডশেডিংয়ের কথা ভুলে না যায় সে জন্য আমি বিদ্যুৎ বিভাগকে বলে দিয়েছি প্রতিদিন সকাল বিকাল দুই ঘণ্টা করে লোড শেডিং করতে।’ তিনি সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্য এই নির্দেশ দিয়েছেন। তা ছাড়া তিনি একই সঙ্গে এটাও বলেছেন, ‘দুই ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের ফলে বিদ্যুতের বিল কম আসবে, জনগণের টাকা বাচবে।’ এক দিকে তিনি স্বীকার করেছেন মানুষকে হয়রানি করতে তিনিই বলেছেন। অন্য দিকে তিনি বিদ্যুতের বিল দিতে ওষ্ঠাগত মানুষের সঙ্গে করেছেন নির্মম রসিকতা। এই উক্তি যে তার সীমাহীন স্বেচ্ছাচারিতা ও তীব্র প্রতিশোধপরায়ণতার পরিচায়ক সে বিষয়ে আমরা কিছুই বলতে পারছি না। তিনি যে দেশবাসীকে শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী হতে চান সেটা ১৯৮৭-তে বিবিসির সিরাজুর রহমানকে বলেছিলেন। সেটাই তিনি এখন করছেন। এই উক্তির জন্য যে কোনো ইলেকটৃসিটি কনজিউমার তার বিরুদ্ধে পাবলিক ইন্টারেস্টে মামলা করতে পারেন। কিন্তু কেউ করতে সাহসী হচ্ছে না। তার মানে, লোডশেডিং চলতেই থাকবে এবং আমরা ভুক্তভোগী হবো।

ভূমিদস্যু: তানভীরকে এমন কোনো ঝামেলাই পোহাতে হচ্ছে না। হি ইজ দি গ্রেটেস্ট। মুষ্টিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলীর পরে তানভীরই গ্রেটেস্ট। তানভীর যে রাষ্ট্রীয় সহানুভূতিসূচক আচরণ পাচ্ছে সেটা নিয়ে আমরা সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। দৈনিক নয়া দিগন্তে রিপোর্ট হয়েছে ‘হলমার্কের হাতিয়ে নেয়া টাকা দশ হাজার কোটি ছাড়াতে পারে।’ দৈনিক সমকালে রিপোর্ট হয়েছে ‘বিপাকে আরো ২৬ ব্যাংক।’ সে ক্ষেত্রে আমাদের সমস্যা হচ্ছে গোটা ব্যাংকিং সিসটেমই হঠাৎ ধসে পড়তে পারে। অর্থমন্ত্রী সে রকম আশংকাও প্রকাশ করেছেন। আর তাই যদি হয় তাহলে আমাদের ব্যবসার কী হবে? আর আমাদের টাকাগুলোরই বা কি হবে? (আবেগী স্বরে) বন্ধুগণ! এই দুরবস্থার বিরুদ্ধে আজ আমাদের রুখে দাড়াতেই হবে। কোথাকার কোন জালিয়াত এসে গণপ্রতারণায় আমাদের টপকে যাবে, সেটা হতে পারে না। কিছুতেই না।

ভূমিদস্যু তার বক্তব্য শেষ করলেন।


সারা ঘরে নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো কিছুক্ষণ।


মিগদস্যু: কিন্তু আমরা কি করবো?
উলফাদস্যু: যাই করি না কেন আমাদের সেটা খুব সাবধানে করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তো হিলারিরও তোয়াক্কা করছেন না। তিনি ডু আর ডাই-য়ের মেজাজে আছেন। তানভীরের কিসসু না হলেও আমাদের বিরুদ্ধে অনেক একশনই নেয়া হতে পারে তার প্রতিশোধস্পৃহা থেকে।

শেয়ারবাজারদস্যু: ইয়েস। আই ফুললি অ্যাগৃ। আমি এক মত।
এমএলএমদস্যু: আমিও।
কুইকরেন্টালদস্যু: আমিও। এখন বলুন, আমাদের কি করণীয়? সে বিষয়ে আপনার কোন প্ন্যান আছে কি?
ঘরে আবার কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা।
ভূমিদস্যু: হ্যা, আছে। বিষয়টি নিয়ে আমি গভীর চিন্তা করেছি।
নিমন্ত্রিতরা (সমস্বরে): কি প্ল্যান? কি প্ল্যান?
ভূমিদস্যু: তানভীর কিভাবে চার হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছিল? সোনালী ব্যাংকসহ একাধিক রাষ্ট্রীয় ব্যাংক এবং কিছু প্রাইভেট ব্যাংক হাত করে। তাই না?
নিমন্ত্রিতরা (সমস্বরে)! হ্যা তাই।
ভূমিদস্যু: এসব ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক ব্যাংক কোনটি?
নিমন্ত্রিতরা (সমস্বরে): বাংলাদেশ ব্যাংক।
ভূমিদস্যু (দৃঢ় স্বরে): আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক হাত করবো।
এমএলএমদস্যু (সন্দেহের স্বরে): সেটা কি সম্ভব হবে? সোনালী ব্যাংকের ব্রাঞ্চ অফিসার, হেড অফিসের কর্মকর্তা, পর্ষদের সদস্য, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টাকে তানভীর হাত করেছিল। সে রকম কিছু করা কি সম্ভব হবে বাংলাদেশ ব্যাংকে? গভর্নর যিনি স্বঘোষিত চাষিপুত্র, তাকে হাত করতে পারবেন কি?
ভূমিদস্যু: না। সে পথে আমরা যাবো না।
নিমন্ত্রিতরা (সমস্বরে): তাহলে?
ভূমিদস্যু: আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকটাই দখল করবো। চাষিপুত্রকে গ্রামে চাষাবাদের কাজে পাঠিয়ে দেব। তারপর আমরাই বাংলাদেশ ব্যাংক চালাবো। তখন তানভীরের মতো বাটপাড়রা আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন কোনো ব্যাংকের ধারে কাছে ঘেষতেও সাহস পাবে না।
উলফাদস্যু: দেশে মানিক থাকলেও এখনো তো কিছু আইনকানুন আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কিভাবে দখল করবো আমরা? গভর্নরকে গ্রামে পাঠাবো। কিন্তু অর্থমন্ত্রীকে কোথায় পাঠাবো?

ঠিক সেই সময়ে দেয়ালে লাগানো টিভি স্কৃনে ব্রেকিং নিউজ শব্দ দুটি ভেসে উঠলো। তারপরই স্ক্রলে সংবাদটি দেখা গেল।


ব্রেকিং নিউজ... প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে রাষ্ট্রপতি আগামী ২৯ ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন... বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন সদস্যদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে... আজই সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে নতুন মন্ত্রীরা শপথ গ্রহণ করবেন..

.
ভূমিদস্যু রিমোট কনট্রোলে টিভির সাউন্ড অন করলেন। একাগ্রভাবে সবাই টিভির খবর শুনতে লাগলেন। খবর শোনা শেষ হলে ভূমিদস্যু তার মুখ খুললেন।

ভূমিদস্যু: অর্থমন্ত্রীর কি হবে সেই প্রশ্নের উত্তর আপনারা পেয়ে গেলেন। যে নির্বাচন ঘোষিত হলো তাতে আমাদের দখল কর্মসূচি খুব সোজা হয়ে গেল।
নিমন্ত্রিতরা (সমস্বরে): তার মানে?
ভূমিদস্যু: আপনারা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছেন এই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না। একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচন চায়। সুতরাং এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবারও বিজয়ী হবে। লক্ষ্য করুন, তারা লাকি ডেট আবার ২৯ ডিসেম্বরই বেছে নিয়েছে। এই নির্বাচনে আমরা আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ফান্ডিং করবো। আর সেটি হবে খুব সহজে।
নিমন্ত্রিতরা (সমস্বরে): কিভাবে?
ভূমিদস্যু: বাংলাদেশ ব্যাংক দখল করলে শুধু যে অন্য সব ব্যাংকই আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসবে তা নয়। আমাদের নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিকিউরিটি পৃন্টিং প্রেস, যেখানে সব নোট ছাপা হয় তারও নিয়ন্ত্রণ থাকবে, যেটা এই গাজীপুরেই অবস্থিত। লাঞ্চের পর আমি আপনাদের সবাইকে ওই সিকিউরিটি পৃন্টিং প্রেস দেখাতে নিয়ে যাবো। অলরেডি তার পাশে আমার প্রাইভেট ফোর্স পাহারা দিচ্ছে, যারা দখলে এক্সপার্ট।


নিমন্ত্রিতরা সবাই আনন্দে ফেটে পড়লেন।

ভূমিদস্যু (আত্মপ্রসাদের হাসি মুখে): আমরা গাজীপুর থেকে নোট ছাপাবো। তারপর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সব কমার্শিয়াল ব্যাংক কনট্রোল করবো। ওই সব ব্যাংকের মাধ্যমে আগামী ইলেকশনে আওয়ামী প্রার্থীদের টাকা দেব। এবার আর আওয়ামী লীগকে ইনডিয়া থেকে বস্তা বস্তা টাকা আনতে হবে না। এবার আর আওয়ামী লীগকে রাজাকার ইংরেজি সাপ্তাহিক দি ইকনমিস্ট-এর অভিযোগ শুনতে হবে না। নির্বাচনে জেতার পরে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক দখলকে বৈধতা দিয়ে দেবে। এটাই হবে রাষ্ট্রের সমর্থনে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় লুট!

সবাই (সমস্বরে): কি চমৎকার সলিউশন! কি চমৎকার। কি চমৎকার। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু! জয় শেখ হাসিনা!


৯ সেপ্টেম্বর ২০১২

শফিক রেহমান: প্রখ্যাত সাংবাদিক ও টিভি অ্যাংকর।

No comments

Powered by Blogger.