তেহরানে ন্যাম সম্মেলন by মুহাম্মদ রুহুল আমীন

গত ৩০ ও ৩১ আগস্ট তেহরানে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনভুক্ত (ন্যাম) দেশগুলোর উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। মোট ১৫৯টি ন্যাম সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে প্রায় গুরুত্বপূর্ণ ১২০টি দেশের সরকারপ্রধানরা একবিংশ শতাব্দীর এ যুগসন্ধিক্ষণে অনুষ্ঠিত নিরপেক্ষ পৃথিবীর মুক্ত নেতারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।


পারমাণবিক ইস্যুতে ইরান-পাশ্চাত্য টলটলায়মান সম্পর্ক, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, ব্যাপক গণজাগরণে আরব বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রের পুনরাঙ্কন প্রভৃতি সমকালীন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জটিল গতিপ্রবাহের সময় ও প্রেক্ষিতে ন্যামের তেহরান সম্মেলন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
১৯৬১ সালে পরাশক্তিদ্বয়ের স্নায়ুযুদ্ধকালীন যুদ্ধমদমত্ততার প্রতি ঘৃণা ও প্রত্যাখ্যান ছুড়ে দিয়ে ইউরোপ ও আফ্রো-এশিয়ার স্বাধীনচেতা, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও শান্তিকামী কতিপয় বিরল নেতৃত্বের বুদ্ধিমত্তায় দানাবেঁধে ওঠে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন (NAM)। পরাশক্তিদ্বয়ের পাতানো ফাঁদে পা না দিয়ে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে শান্তিময় বিশ্ব গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আন্দোলন হিসেবে ন্যামের যাত্রা সূচিত হয়। ন্যামের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও চেতনা ক্রমবিকশিত হয়ে আস্তে আস্তে পৃথিবীর স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোকে এত বেশি আকর্ষিত করে যে বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা ১৫৯, যা জাতিসংঘের সদস্যপদের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি।
স্নায়ুযুদ্ধের বাস্তবতায় ন্যাম প্রতিষ্ঠিত হলেও স্নায়ুযুদ্ধোত্তরকালে অন্যান্য বাস্তবতার কারণে ন্যামের প্রযোজ্যতা তৎকালীন সময়ের চেয়ে বর্তমানে বেশি অনুভূত হচ্ছে এবং সে কারণে তেহরান সম্মেলন বিশ্ব রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
প্রথমত, পর পর দুটি বিশ্বযুদ্ধ দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্ম দিয়েছে- লিগ অব নেশনস ও ইউনাইটেড নেশনস। ইতিপূর্বে ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের যুদ্ধ ৩০ বছর ধরে যুদ্ধের জন্ম দেয় এবং শান্তির প্রত্যয়ে ওয়েস্টফালীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। কিন্তু নেপোলিয়নের যুদ্ধের পর বিশ্বময় অশান্তি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে হেগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা অতি অল্প সময়ের মধ্যে আবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেয়। এরপর লিগ অব নেশনস প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু অনেক পণ্ডিত মনে করেন, লিগ অব নেশনস দুটি বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে কেবল যুদ্ধবিরতির ভূমিকা পালন করে। ফলে ১৯৩৯ সালে মানব ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা ধ্বংসাত্মক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় এবং যুদ্ধের অব্যবহিত পর শান্তির উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।
গত ৫০০ বছরের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের এ ইতিহাস পর্যালোচনায় বোঝা যায়, মানবসমাজ অন্যায় ও অশান্তির পরপরই শান্তির জন্য সংস্থার আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘ বিশ্বসমাজকে বর্তমানে ঈপ্সিত শান্তি ও নিরাপত্তা প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বসমাজ তাই জাতিসংঘের সংস্কারের নানা প্রস্তাব দিচ্ছে। এ অবস্থায় জাতিসংঘ তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে মারাত্মকভাবে। ফলে জাতিসংঘের পাশাপাশি অন্যান্য বিশ্বসংস্থার প্রযোজ্যতা অনুভূত হচ্ছে প্রভূতভাবে।
দ্বিতীয়ত, জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরকালে মধ্যম ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। অধিকন্তু নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যের পদ সৃষ্টি করা হয় ও ভেটো ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধি এর প্রতিবাদ করলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি কনালি দম্ভভরে জাতিসংঘ সনদ ছিঁড়ে ফেলেন এবং এক নিষ্ঠুর নাটকীয়তার অবতারণা করে মন্তব্য করেন, 'ভেটো ছাড়া কোনো জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হবে না।' সেই থেকে অসংখ্য অন্যায় অসম নীতি অনুসৃত হচ্ছে জাতিসংঘে। ফলে বিকল্প সংস্থার অধীনেও বিশ্বসমাজ বিশ্বশান্তি রক্ষার স্বপ্ন দেখছে। এ প্রেক্ষিতে শোষিত-বঞ্চিত মানবসমাজের প্রয়োজনে বিকল্প বিশ্বসংস্থা হিসেবে ন্যামের প্রযোজ্যতা নতুন করে অনুভূত হচ্ছে।
তৃতীয়ত, স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরাশক্তিদ্বয়ের পরস্পরবিরোধী প্রতিযোগিতার প্রমত্ততা একপর্যায়ে স্তিমিত হয়ে আসে। ষাটের দশকের শুরুতে উভয়ে ক্লান্ত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে বিশ্বসমাজে বসবাসের চিন্তা করতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ নতুন পরিস্থিতিতে দাঁতাত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন একে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হিসেবে অভিহিত করে। ঠিক এমনই অবস্থায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন দানাবেঁধে ওঠে। দুই পরাশক্তি কারো সঙ্গে জোটবদ্ধ না থেকে নিরপেক্ষভাবে ও শান্তিপূর্ণভাবে বিশ্বসমাজের আন্তক্রিয়ায় অংশ নিতে সেই সময় জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। অর্থাৎ স্নায়ুযুদ্ধের অসম পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণ বসবাসের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপনায় প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হতে থাকে, যার ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয় ন্যাম।
চতুর্থত, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর পরাশক্তিদ্বয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান হলেও শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরপেক্ষভাবে বিশ্বসমাজে বাস করার অদম্য স্পৃহা বিশ্ব নাগরিক সমাজ নতুন করে লালন করতে থাকে। স্নায়ুযুদ্ধাবসান তাদের নিরপেক্ষভাবে বসবাস করার অবারিত সুযোগ উন্মোচিত করে। স্নায়ুযুদ্ধের হুমকি-ধমকির মুখে নয়, বরং সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে, নিরপেক্ষভাবে ও শান্তিসহকারে বসবাসে তারা নতুন চেতনাদীপ্ত হয়ে ওঠে।
পঞ্চমত, আগেই বলা হয়েছে, জাতিসংঘকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা শোষণ, বঞ্চনা, অসাম্য এবং অশান্তির অভিশাপে পৃথিবীকে জর্জরিত করে তুলেছে। বঞ্চিত পৃথিবীর অনেক দেশ ও অনেক নাগরিক এ শোষণ ও বঞ্চনা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে নতুন বিশ্বব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস চাচ্ছে। ন্যাম কার্যকর হলে জাতিসংঘের দাপট কিছুটা হ্রাস পেতে পারে। কেননা, পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি ন্যামের অন্তর্ভুক্ত।
পরিশেষে, স্নায়ুযুদ্ধাবসানের পর পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় জাতিসংঘ ও অন্যান্য বিশ্ব সংস্থাগুলোর ক্রমবর্ধমান ক্ষয়িঞ্চু প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে ন্যামের পুনর্মূল্যায়ন অবধারিত হয়ে উঠেছে। স্নায়ুযুদ্ধের পর একমাত্র পরাশক্তির একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে পৃথিবীব্যাপী এক মেরু বিশ্বব্যবস্থার যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য ন্যামের মতো সংস্থার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হয়ে পড়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্রের বিস্তৃতি নিয়ে যে আঞ্চলিক উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে, তা স্তিমিত করতে একটি নিরপেক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপনার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে, যেখান থেকে শোষিত-বঞ্চিত রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থের দিকগুলো তুলে ধরা যায়। তেহরানে অনুষ্ঠিত ন্যামের শীর্ষ সম্মেলনে প্রায় ৫০টি দেশের নেতারা পারমাণবিক শক্তির আন্তর্জাতিক ও আইনগত অধিকার অর্জনের বিষয়ে আলোচনা করেছেন। পাশ্চাত্যের কোনো একক দেশ বা রাষ্ট্র জোটের চাপিয়ে দেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত, অর্থনৈতিক অবরোধ বা বাণিজ্য অবরোধের কারণে ইরানের মতো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র যেভাবে ভোগান্তির শিকার হয়েছে, সে ব্যাপারে ন্যামের তেহরান সম্মেলনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং ইরান যাতে সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে পারে তার সম্ভাব্য সমাধানের নিশ্চয়তা দেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক অভিলাষ পূরণের ন্যায়সংগত দাবিকে ন্যাম সম্মেলনে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং ইরানের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের একতরফা দমননীতির নিন্দা জানানো হয়। সিরিয়া, ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা যাতে বাধামুক্ত হয়, তার কার্যকর ভূমিকা পালনের অঙ্গীকার করা হয়। এভাবে পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের যৌক্তিকতা, যথার্থতা ও প্রযোজ্যতা অনুভূত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি বর্তমান সময়ে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.