অরণ্যে রোদন- বেবুন, কোকেইন ও ক্ষমতাধরেরা by আনিসুল হক

ক্ষমতা মানুষের মস্তিষ্কে কাজ করে ঠিক সেভাবে, যেভাবে কাজ করে কোকেইন। কথাটা আমার নয়। এটা প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্যের টেলিগ্রাফ পত্রিকায়, ২৬ এপ্রিল ২০১২ সংখ্যায়। শিরোনাম হলো, ‘বেবুনদের মতোই আমাদের নির্বাচিত নেতারা ক্ষমতায় আসক্ত।’ বেবুন হলো একপ্রকারের বাঁদর।


এই লেখায় ড. আয়ান রবার্টসন জানাচ্ছেন, কতগুলো বেবুনের ওপর নিরীক্ষা করা হয়েছে। দেখা গেছে, যখন কেউ ক্ষমতা পায়, তখন তার মস্তিষ্কে এমন পরিবর্তন সংঘটিত হয় যা তার শরীরে বেশি করে টেস্টোস্টেরন নির্গত হতে উদ্বুদ্ধ করে। মস্তিষ্কে ডোপামিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এটা ঠিক সেভাবে কাজ করে, যেভাবে কাজ করে কোকেইন। ক্ষমতা মানুষকে ক্ষমতার নেশায় বুঁদ করে ফেলে।
বেবুনদের ওপর বিজ্ঞানীরা নিরীক্ষা করে দেখেছেন, যেসব বেবুন পালের গোদা, বেশি ক্ষমতাশালী, তাদের মস্তিষ্কে ডোপামিনের পরিমাণ যায় বেড়ে, তারা খুবই আগ্রাসী হয়ে ওঠে, বেশি তৎপর হয়, যৌনতাপরায়ণ হয় এবং ক্ষমতার নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তাদের মস্তিষ্ক তেমনিভাবে কাজ করতে থাকে, যেমন করে কাজ করে একজন কোকেইনসেবীর মস্তিষ্ক। কোকেইনসেবীর মতোই তারা সাময়িকভাবে চরম আনন্দ পায়, কিন্তু আখেরে এটা তাদের নেশাসক্ত করে ফেলে এবং তার পরিণাম ভালো হয় না।
কোনো একটা পক্ষ যদি বিপুল জনপ্রিয় হয়, তা হলে নির্বাচন-পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, তারা জয়লাভ করবেই। আর কোনো সরকারের জনপ্রিয়তায় যদি ধস নামে, তারা যদি ব্যাপকভাবে অজনপ্রিয় হয়, কিংবা বলি, জন-অপ্রিয় হয়, ছল-বল-কৌশল যা-ই তারা অবলম্বন করুক না কেন, ক্ষমতা তারা ধরে রাখতে পারে না। এবং কারও ক্ষমতাই চিরস্থায়ী হয় না। যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা অবশ্য কোনো দিনও বিশ্বাস করেন না যে তাঁরা অজনপ্রিয়, তাঁরা কোনো দিন ক্ষমতার বাইরে যাবেন, তাঁদের কোনো দিনও বিরোধী দলের স্থান নিতে হতে পারে।
ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতা ছাড়তে চান না, এটা পৃথিবীর ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে। তবু, জীবনানন্দ দাশ বিষণ্ন চোখ মেলে দেখেছেন, এশিরিয়া ধুলো আজ, ব্যাবিলন ছাই হয়ে ভাসে। কার ক্ষমতাই বা এই দুনিয়ায় চিরস্থায়ী হলো?
আচ্ছা, ধরুন, আপনি একটা রাজনৈতিক দলের প্রধান নীতিনির্ধারক। আপনার সামনে ক্ষমতা ধরে রাখার দুটো বিকল্প খোলা। এক. ভালো ভালো কাজ করে জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে চলা, অন্তত জনপ্রিয়তায় যাতে ধস না নামে, সেই চেষ্টা করা। তারপর একটা সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে নিজেকে জনতার আদালতে হাজির করা। দুই. নির্বাচন-পদ্ধতিটাকেই এমন করে তোলা যাতে ‘আমি’ ছাড়া আর কেউ জিততে পারবে না। কিন্তু এটা করতে গেলে একটা সমস্যা হবে, আপনার জনপ্রিয়তায় ধস নামবে। আপনি কোনটা করবেন?
টেলিগ্রাফ পত্রিকার কথা সত্য বলে ধরে নিলে, আপনি তো আবার বেবুনের মতোই ক্ষমতাসক্ত। আপনার অবস্থা এখন হেরোইনখোরের মতো, আপনি আর সুস্থভাবে চিন্তা করার ক্ষমতাই রাখেন না। কাজেই আপনি যা ভাববেন, তা হলো, ভালো ভালো কাজ করে নির্বাচনে গেলেই যে আমি জয়লাভ করব, তার নিশ্চয়তা কই। তার চেয়ে যেভাবেই হোক, নির্বাচনে আমি যাতে জিতিই, সেটা নিশ্চিত করো। তাতে আমি জনপ্রিয় থাকলাম কি থাকলাম না, কী বা এসে যায়। জনপ্রিয়তা দিয়ে আমি কী করব যদি নির্বাচনেই না জিতি, যদি ক্ষমতাই হাতছাড়া হয়। আর অজনপ্রিয় হলেই বা কী ক্ষতি, যদি নির্বাচন মানেই আমার জয়লাভ, এটা নিশ্চিত থাকে।
হ্যাঁ, এই রকম আপনি ভাবতে পারেন বটে। তবে একটা কথা আপনাকে বলে রাখা দরকার, অজনপ্রিয় সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারে না। জনগণ আপনাকে চায় না, আর আপনি নির্বাচনী-প্রকৌশল প্রয়োগ করে ক্ষমতায় টিকে থাকবেন, এটা কখনোই হবে না। হলে, আজকে তারেক রহমানের বিএনপিই ক্ষমতায় থাকত।
এই কলামে আমি অন্তত দুবার একটা মন্তব্য করেছিলাম, আওয়ামী লীগ আসলে সরকার খারাপ চালায় না, আওয়ামী লীগের সমস্যা তার খাসলতে, মানে তার স্বভাবে, তার চালচলনে। এ সপ্তাহে এক পাঠক আমাকে প্রশ্ন করেছেন, আপনি কি এখনো মনে করেন, আওয়ামী লীগ আসলে সরকার খারাপ চালায় না?
মহাজোট সরকার ক্ষমতা নেওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় ২০১০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার আমার একটা লেখা ছাপা হয়েছিল। তাতে লিখেছিলাম, ‘শেখ হাসিনার নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে সাধারণভাবে অনেকেই খুশি। এই মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজ বা সন্ত্রাসী লালনের অভিযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। চাঁদাবাজিতে দক্ষ অনেকে পাত্তাই পাননি। তরুণ ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির এই মন্ত্রিসভায় নারীদের প্রাধান্য নিয়েও আমরা গর্ব করতে পারি। এই মন্ত্রিসভা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে, দুর্নীতি ও দলীয়করণ থেকে নিজেদের মুক্ত রেখে দেশের স্বার্থকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে, তা হলে বলা যাবে, বাংলাদেশে একটা পুরোনো যুগের অবসান ঘটল, হলো এক নতুন যুগের সূচনা। প্রাথমিকভাবে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাতেই হয় এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। একচেটিয়া জয়লাভের আগে-পরে শেখ হাসিনার কথাবার্তাও খুবই সংযত ও রাষ্ট্রনায়কসুলভ বলেই মনে হয়েছে।
‘প্রাথমিক মুগ্ধতা কেটে গেলে আসে বাস্তবতাবোধ। আমরা যখন একজন গাড়ির চালক নিই, তখন প্রথমেই যেটা দেখতে হয়, সে গাড়ি চালাতে জানে কি না। সততা, নিয়মানুবর্তিতা ও আনুগত্যও খুব দরকার, কিন্তু প্রথম গুণটা না থাকলে বাকি গুণ দিয়ে হয় না। দেশের চালকের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সততা, ঐকান্তিকতা, সৌজন্য—এসব খুবই দরকার কিন্তু এক নম্বর গুণটা আছে তো! যিনি যে পদ লাভ করলেন, সে ব্যাপারে তিনি যোগ্য তো!’
এখন মনে হচ্ছে, আমার গাড়ির চালক কেবল গাড়ি চালাতে জানে না, ব্যাপার শুধু তা-ই নয়, সে নিয়মিত তেল চুরি করে, গাড়ি বাইরে নিয়ে গিয়ে ভাড়া খাটায়, গাড়ির যন্ত্রাংশ খুলে বিক্রি করে দেয়, সে নিয়মিত কাজে আসে না, প্রায়ই ফাঁকি দেয় এবং আশপাশের লোকজন তার আচার-আচরণে অতিষ্ঠ!
তার পরও সেই চালককে আমি কাজে রাখি কী করে?
শেয়ার মার্কেটে ধস, বিভিন্ন হায় হায় কোম্পানি কর্তৃক মানুষের পকেট কেটে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, পদ্মা সেতু বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ এবং অবশেষে সরকারি ব্যাংক থেকে তিন-চার হাজার কোটি টাকা হাপিস হয়ে যাওয়া। অন্যদিকে আছে গুম, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের কিনারা না হওয়া। ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীদের বাড়াবাড়ি। বহু ব্যর্থতার মূল কারণ কিন্তু অন্ধ দলীয়করণ। ১৯৯৬-২০০১ সালে সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জনকারী অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশেষজ্ঞরা। ২০০৯ সালের পরে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এসেছেন আওয়ামী লীগ- ছাত্রলীগ-যুবলীগের মাঠপর্যায়ের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকেরা! বুয়েটে আজকে অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে সহ-উপাচার্যের পদ থেকে সরানো হলো, কিন্তু এ সমস্যা দানাই বাঁধত না, যদি না দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে তাঁকে জ্যেষ্ঠতা ছাড়াই এই পদে নিয়োগ দেওয়া হতো!
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, অযোগ্যতা, অদক্ষতা, কখনো কখনো দুর্নীতির যে বিপুল অভিযোগ, তা সত্ত্বেও কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা কেন নেওয়া হয় না? এত বড় হলমার্ক কেলেঙ্কারির পরও একটা লোকও গ্রেপ্তার হলো না! এত অভিযোগের পরও কোনো মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে সরকার কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে, এই রকম খবর কি কেউ শুনেছেন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারদা পুলিশ একাডেমিতে বলেছেন জিরো টলারেন্সের কথা। জিরো টলারেন্স নীতি যদি শুরু করতে হয়, সেটা করতে হবে ওপর থেকে, ঘর থেকে, মন্ত্রিসভা থেকে, দল থেকে।
আচ্ছা, নিজের ভালো মানুষ নিজে বুঝবে না? কেউ কি ইচ্ছা করে নিজের জনপ্রিয়তা কমানোর আয়োজন করে?
একটা সরকার যখন তার মেয়াদে ব্যর্থ হয়, তখন সেই সরকার একা ব্যর্থ হয় না, পুরো দেশের সম্ভাবনাই বিনষ্ট হয়, ১৫ কোটি মানুষই ক্ষতির সম্মুখীন হয়। একটা সরকার যখন সফল হয়, তখন একা একা সফল হয় না, পুরো দেশটাও এগিয়ে যেতে থাকে। কৃষি ক্ষেত্রে সাফল্য যেমন সরকারের, তেমনি কৃষকদের, তেমনি পুরো দেশের। একইভাবে পদ্মা সেতু না হলে সেটা কেবল মহাজোট সরকারের ব্যর্থতা নয়, তার অর্থ দাঁড়াবে পুরো দেশের একটা বিশাল অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনাকেই নস্যাৎ করে দেওয়া।
সরকারের হাতে এখনো সোয়া বছর সময় আছে। এই সময়টাতে সরকার কি ঘুরে দাঁড়াতে পারে না? দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে, অদক্ষদের অপসারিত করে, সর্বত্র যোগ্য ও দক্ষ মানুষকে কাজের সুযোগ করে দিয়ে একটা ইতিবাচক কর্মযজ্ঞ শুরু করার সময় কি শেষ হয়ে গেছে?
আমি চাই না আগামী সোয়া বছরে ব্যর্থতার মিছিল আরও ব্যর্থতা ডেকে আনুক।
কিন্তু আমার চাওয়া দিয়ে কিছুই যায়-আসে না। যাদের চাওয়া-পাওয়া আসলে গুরুত্বপূর্ণ, তাঁরা তো যে যাঁর উচ্চ আপন বাঁশের মাচায় আত্মতুষ্ট অবস্থায় ঝিমোচ্ছেন।
আর মোসাহেবেরা কী বলছে?
চমৎকার চমৎকার।
চমৎকার সে হতেই হবে, হুজুরের মতে অমত কার?
কাজেই আমাদের সামনে কোনো আশা নেই। আগামী সোয়া বছরে সরকারের আচার-আচরণ কোনো এক আশ্চর্য জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় বদলে গিয়ে অপরূপ হয়ে উঠবে না। আর জনপ্রিয়তা যদি না থাকে, তা হলে কেউ ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে, ইতিহাস তা বলে না। কোনো অলৌকিক কারণে আমাদের বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষগুলো সমঝোতায় উপনীত হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন করবে, এই রকম একটা আকাশকুসুম আমরা রচনা করতে পারি। কিন্তু তা না হলে কী হবে, আমাদের নিকট ভবিষ্যৎ কেমন হতে যাচ্ছে, কল্পনাও করতে পারছি না। দুর্ভাবনায় তাই ছেয়ে আসে আকাশ। কিন্তু যাঁদের এসব নিয়ে ভাবিত হওয়ার কথা, তাঁরা কী করছেন। টেলিগ্রাফ-এর শিরোনামটা অবিকল তুলে দিই: লাইক বেবুনস, আওয়ার ইলেকটেড লিডারস আর লিটারেলি অ্যাডিকটেড টু পাওয়ার। নেশায় যাঁরা বুঁদ হয়ে থাকেন, তাঁদের কাছে আপনি কী আশা করতে পারেন?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.