টিপাইমুখ প্রকল্প-বিস্তারিত নথিপত্র কতটা বিস্তৃত হবে? by শেখ রোকন

আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নদী, পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা রয়েছে। সরকার তাদের সঙ্গেও প্রতিবেদনটি শেয়ার করতে পারে। বস্তুত 'পরীক্ষা-নিরীক্ষা' করে দেখার যে কথা ঢাকার প্রতিনিধি দল নয়াদিলি্লতে বলে এসেছে, সেটা কার্যকরভাবে করতে হলেও তো বিশেষজ্ঞ মহলের সহায়তা লাগবে
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. একেএম মসিউর রহমান দিন তিন-চারের ভারত সফর শেষে শুক্রবার যখন ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে নামলেন, তখন স্বভাবতই সংবাদমাধ্যমের যাবতীয় কৌতূহল ও কটাক্ষ ছিল পদ্মা সেতু ইস্যুতে তার পদত্যাগ করা না-করা নিয়ে। দু'জন প্রভাবশালী উপদেষ্টা_ তিনি ও ড. গওহর রিজভী_ ততোধিক প্রভাবশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্রে কী কারণে গিয়েছিলেন, সেখানে কী কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক এই দৌত্য কতটা তাৎপর্যপূর্ণ; বিশ্বব্যাংক-সরকার দ্বৈরথের ছায়ায় সেই আলোচনা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।
যতদূর জানা যাচ্ছে, তেহরানে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সাইডলাইনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার ভারতীয় প্রতিপক্ষ ড. মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে যে বৈঠক করেন, তারই ফলোআপ হিসেবে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন আমাদের দুই উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ জানান। সফরে গিয়ে গওহর রিজভী ও মসিউর রহমান ভারতের নতুন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ছড়াও পানিসম্পদ, বিদ্যুৎ, স্বরাষ্ট্র ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় সীমান্ত সংকট, ছিটমহল বিনিময়, বিদ্যুৎ প্রকল্প, ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট, টিপাইমুখ ও তিস্তা ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন।
সংবাদমাধ্যম যতই পদত্যাগের মতো গরম খবরের পেছনে ছুটুক, শেষে এবং সংক্ষেপে হলেও অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টা অবশ্য তার সফর নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। এর মধ্যে অনেকের বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি সম্ভবত এটি_ 'টিপাইমুখ সম্পর্কে ভারতের কাছে থাকা সব তথ্য তাদের দেওয়া হয়েছে' (সমকাল, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২)।
তার মানে, দুই সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয়বার নিশ্চিত হওয়া গেল যে টিপাইমুখ প্রকল্প সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে উজানের দেশটি। এর আগে ২৭-২৮ আগস্ট নয়াদিলি্লতে অনুষ্ঠিত যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) নবগঠিত সাবগ্রুপের বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে খবর দেওয়া হয়েছিল, ভারতীয় পক্ষ 'টিপাইমুখ হাইড্রোপাওয়ার প্রজেক্ট' বিষয়ে পাঁচ খণ্ডের বিস্তারিত প্রকল্প প্রতিবেদন বা ডিপিআর (ডিটেইলড প্রজেক্ট রিপোর্ট) বাংলাদেশি প্রতিনিধি দলের কাছে হস্তান্তর করেছে। যাতে করে ভাটির দেশটি নিজেও একটি ইমপ্যাক্ট স্টাডি পরিচালনা করতে পারে। বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতিতে ড্যামটির প্রভাব নিরূপণ করতে যৌথ সমীক্ষা চালানোর ব্যাপারে 'বিস্তারিত আলোচনা শেষে' টার্মস অব রেফারেন্সও চূড়ান্ত করা হয় ওই বৈঠকে। পরে এক সংবাদ বিবৃতিতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা এবং যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মীর সাজ্জাদ হোসেন বলেন, তারা ডিপিআর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবেন এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় প্রস্তাবিত প্রকল্পের সম্ভাব্য প্রভাবের ওপর যৌথ সমীক্ষা পরিচালনা করবেন। সমীক্ষার প্রয়োজনে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ও সম্পূরক তথ্য-উপাত্ত সরবরাহের ব্যাপারেও ভারত আশ্বাস দিয়েছে। যদিও সমীক্ষা সম্পন্ন করার কোনো সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়নি (ডেইলি স্টারের নয়াদিলি্ল প্রতিনিধির পাঠানো খবর, ২৯ আগস্ট ২০১২)।
সব মিলিয়ে আশ্বাস আর অবিশ্বাসের অদৃশ্য সুতোয় ঝুলে থাকা টিপাইমুখ ড্যাম প্রকল্প ইস্যুতে কয়েক দশকে যা সম্ভব হয়নি, গত দুই সপ্তাহে সে 'অগ্রগতি' দেখা গেল। কতটা অগ্রগতি? বিষয়টি বোঝার জন্য একটি মাপকাঠিই যথেষ্ট। আমাদের মনে আছে, গত বছর ২২ নভেম্বরে ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া টিপাইমুখ ইস্যুতে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। তাতে তিনি মূলত দুটি দাবি জানিয়েছিলেন। প্রথমত, একটি যৌথ সমীক্ষা সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ভারত টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হবে না। দ্বিতীয়ত, দুই দেশের মধ্যে প্রকল্পের বিস্তারিত বিনিময় করতে হবে (ডেইলি স্টার, ২৪ নভেম্বর ২০১১)। কী আশ্চর্য! মাত্র দুই সপ্তাহ সময়ের মধ্যে দুটি দাবিই পূরণ হয়ে গেল! বিরোধীদলীয় নেত্রীর উপদেষ্টারাও সম্ভবত প্রত্যাশা করতে পারেননি যে ভারত এতে এত তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে। সাবগ্রুপের বৈঠকের পর আমাদের প্রতিনিধি দলের সংবাদ বিবৃতিতে যদিও বলা হয়েছে যে, যৌথ সমীক্ষা পরিচালনার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ইচ্ছার প্রতিফলন হচ্ছে এই বৈঠক, আমরা এখন দেখছি তার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও একই আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন!
সরকারের পক্ষ থেকে টিপাইমুখ ইস্যুতে সাম্প্রতিক অগ্রগতিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে হলেও স্বাগত জানানো হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু বিএনপি কী করবে? একটা দাবি তারা তুলতেই পারে_ বিস্তারিত প্রকল্প প্রতিবেদন খণ্ডগুলো জনসমক্ষে প্রকাশ করা হোক এবং এই দাবি যৌক্তিক। আমরাও মনে করি, প্রতিবেদনটি গোপন রাখা উচিত হবে না। দেশের বিপুল স্বার্থ ও বিস্তীর্ণ ভবিষ্যৎ জড়িত যে প্রকল্পের সঙ্গে, যে প্রকল্প নিয়ে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট জল ঘোলা হয়েছে; সেটা নিয়ে সর্বোচ্চ স্পষ্টতা থাকাই জরুরি।
বিষয়টি অবশ্য সহজ হবে বলে মনে হয় না। বিশেষ করে এর সঙ্গে যখন যৌথ নদী কমিশন জড়িত। ভুক্তভোগীরা জানেন, প্রতিষ্ঠানটি তাদের 'তথ্য' নিয়ে কী মাত্রায় স্পর্শকাতর। আমরা সংবাদমাধ্যম সূত্রে জেনেছি যে, সাবগ্রুপে টিপাইমুখ ইস্যুতে 'বিস্তারিত' আলোচনা হয়েছে। সেই আলোচনার খবর ছাড়া আধেয় কী জানা গেছে? এ ধরনের আলোচনা জনসমক্ষে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিতটির নাম 'রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা' বা 'কূটনৈতিক স্পর্শকাতরতা'। বিশেষ করে অবসর নেওয়ার আগে কূটনীতিক ও আমলারা এবং ক্ষমতায় থাকাকালে রাজনীতিকরা এ ব্যাপারে বেশ যত্নবান থাকেন। টিপাইমুখ প্রকল্প প্রতিবেদন প্রকাশের ক্ষেত্রেও সরকারের পক্ষে এমন দোহাই দেওয়া হয় কি-না, দাবি জানালেই বোঝা যাবে।
ভারতের দিক থেকেও আপত্তির কথা বলা হতে পারে। কিন্তু সে আপত্তি সঙ্গত হবে না। কারণ তারা তো বারংবারই বলে আসছেন যে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ ড্যাম প্রকল্পে 'বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর' কিছু নেই। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে ভারতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় সফর এবং পরের বছর সেপ্টেম্বরে তাদের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ফিরতি সফরে যে দুটি যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেই দুই দলিলে সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে_ টিপাইমুখে এমন কোনো পদক্ষেপ ভারত গ্রহণ করবে না। বাংলাদেশ সফরের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া বক্তৃতায়ও মনমোহন সিং প্রাঞ্জল ভাষায় বলেছিলেন_ 'টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে। আমি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে এটা পরিষ্কার করতে চাই যে, ভারত সেখানে এমন কোনো পদক্ষেপ নেবে না, যা বাংলাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।' ক্ষতিকারক কিছু যদি না-ই থাকে, বিস্তারিত নথিপত্র জনসমক্ষে প্রকাশে বাঁধ দেবে কেন!
সন্দেহ নেই যে, বিস্তারিত নথিপত্র হস্তান্তর টিপাইমুখ ইস্যুতে বড় ধরনের অগ্রগতি। কিন্তু যদি সেটা গোপনই রাখা হয়, তাহলে এর উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ কিন্তু থেকেই যাবে। দুই পক্ষের এই আন্তরিকতা ও বিনিময়ের পূর্ণ তাৎপর্য তখনই পাওয়া যাবে, যখন এটা বিস্তৃত পর্যায়ে প্রকাশ করা হবে।
বলছি না যে লিফলেটের মতো করে জনে জনে বিলি করতে হবে। পাঁচ খণ্ড দলিলপত্র সেভাবে বিতরণ সম্ভবও নয়। কিন্তু বিস্তারিত প্রতিবেদন নিয়ে সংসদে কি আলোচনা হতে পারে না? সেখানে বিরোধী দলও যোগদান করে বিস্তারিত নথিপত্র এবং টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারে।
আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নদী, পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা রয়েছে। সরকার তাদের সঙ্গেও প্রতিবেদনটি শেয়ার করতে পারে। বস্তুত 'পরীক্ষা-নিরীক্ষা' করে দেখার যে কথা ঢাকার প্রতিনিধি দল নয়াদিলি্লতে বলে এসেছে, সেটা কার্যকরভাবে করতে হলেও তো বিশেষজ্ঞ মহলের সহায়তা লাগবে। এসব ক্ষেত্রে সরকারকে সব সময়ই অনুগত কিছু বিশেষজ্ঞ বেছে নিতে দেখা যায়। বিস্তারিত নথি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে এর পুনরাবৃত্তি চলবে না। সর্বজনস্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের যুক্ত করতে হবে। টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলোচনার প্রশ্ন যখনই উঠেছে, বিভিন্ন পক্ষ থেকে যেসব নাম উঠেছে, কী এক আশ্চর্য কারণে আমরা দেখেছি সরকার সেগুলো অগ্রাহ্য করেছে। বিস্তারিত প্রতিবেদন নিরীক্ষার ক্ষেত্রে এমনটি হলে তা হবে আত্মঘাতী।
টিপাইমুখ ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরে নাগরিক সমাজের যারা আন্দোলন করছেন, আলোচনা করছেন বিস্তারিত প্রতিবেদনটি তাদেরও দেখা উচিত। তাহলে সরকার কেবল অহেতুক বিরোধিতা এড়াতেই সক্ষম হবে না, সুপরামর্শও পেতে পারে তাদের কাছ থেকে।
সরকারের জন্য একদিক থেকে বরং সুযোগ এসেছে। অনেকে অভিযোগ করে থাকেন, টিপাইমুখ ইস্যুতে বর্তমান সরকার যথেষ্ট স্বচ্ছতা ও আন্তরিকতা প্রদর্শন করছে না। বিস্তারিত নথিপত্র যত দূর সম্ভব ছড়িয়ে দিয়ে সেই সমালোচনার মোক্ষম জবাব দেওয়ার এমন সুযোগ আরও কি আসবে? আমার মনে হয় না।

শেখ রোকন : সাংবাদিক ও গবেষক
skrokon@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.