বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫০৮ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। আলিমুল ইসলাম, বীর প্রতীক দুঃসাহসী এক যোদ্ধা সীমান্ত এলাকা থেকে দিনের বেলা মাধবপুর রওনা হন আলিমুল ইসলামসহ ২২ জন মুক্তিযোদ্ধা। তাঁদের লক্ষ্য, সড়কে চলাচলরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গাড়ি অ্যাম্বুশ করা।
তখন গোটা মাধবপুর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দখলে। হবিগঞ্জ জেলার সর্বদক্ষিণ প্রান্তের উপজেলা মাধবপুর। মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসিক ওই অভিযানে নেতৃত্ব দেন লেফটেন্যান্ট গোলাম হেলাল মোর্শেদ খান (বীর বিক্রম, পরে মেজর জেনারেল)।
১৯৭১ সালের ২৮ এপ্রিল মাধবপুরের পতন ঘটে। পশ্চাদপসরণের সময় মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেটমুখী সড়কের বেশির ভাগ সেতু ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করেছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতুর পাশ দিয়ে বিকল্প সংযোগ সড়ক নির্মাণ করে।
২৩ মে বেলা আনুমানিক দুইটায় আলিমুল ইসলামসহ মুক্তিযোদ্ধারা ওই সড়কের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছান। এর আগে তাঁরা তিন দিন ওই সড়কে রেকি করেন। এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে দলনেতা স্থান নির্বাচন করেন ধ্বংসপ্রাপ্ত এক সেতুর পাশে নির্মিত সংযোগ সড়ক। তাঁরা সেখানে দুটি ট্যাংক-বিধ্বংসী মাইন পেতে আড়ালে পাকিস্তান সেনাবাহী গাড়ির জন্য অপেক্ষায় থাকেন। এরপর সময় গড়ায়।
কিন্তু সেদিন পাকিস্তানিদের কোনো গাড়ি আসেনি। মুক্তিযোদ্ধারা এতে হতাশ হননি। রাতে তাঁরা অ্যাম্বুশস্থলেই থাকেন। সে রাতে বৃষ্টি হয়। তাঁরা সবাই বৃষ্টিতে ভিজে যান। সারা রাত বিনিদ্র অবস্থায় থাকেন। সকাল হওয়ার পর কাছাকাছি এক পরিত্যক্ত বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে আবার অ্যাম্বুশস্থলে আসেন এবং অপেক্ষায় থাকেন।
পরদিন বেলা আড়াইটা পর্যন্ত গাড়ি আসেনি। এরপর তাঁরা বেশির ভাগ দুপুরের খাবার খেতে বসেন। বাকিরা থাকেন সতর্ক অবস্থায়। এমন সময় পাকিস্তানি সেনাদের বিরাট এক কনভয় তাঁদের অ্যাম্বুশস্থলের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। খাবার ফেলে তাঁরা দ্রুত নিজ নিজ অবস্থানে যান। আলিমুল ইসলামসহ তাঁর কয়েকজন সহযোদ্ধা ছিলেন একদম সামনে। তাঁদের ওপর দায়িত্ব ছিল মাইন বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম গোলাগুলি শুরু করার।
জিপ, লরি ও পিকআপ মিলে পাকিস্তানি ওই কনভয়ে মোট ২২টি গাড়ি ছিল। এই সংখ্যা তাঁর দলনেতা ও পেছনে থাকা সহযোদ্ধারা আঁচ করতে পারেননি। এতে আলিমুল কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন। কারণ তাঁরা মাত্র ২২ জন, আর পাকিস্তানিরা তাঁদের সাত-আট গুণ। পাল্টা আক্রমণে তাঁদের সবার মারা পড়ার আশঙ্কাই ছিল বেশি। কিন্তু তিনি বিচলিত হননি।
এর মধ্যে পাকিস্তানিদের একদম সামনের গাড়ি (জিপ) সেতুর বিকল্প রাস্তা দিয়ে চলে যায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় গাড়িও যায়। চতুর্থটি ছিল পিকআপ। সেটি যাওয়ার সময় তাঁদের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরিত হয়। পিকআপটি উড়ে গিয়ে কয়েক গজ দূরে পড়ে। দ্বিতীয় গাড়িরও একই ভাগ্য ঘটে। পেছনের গাড়িগুলো থেমে যায়।
এ সময় আলিমুল ইসলামসহ তাঁর সহযোদ্ধাদের অস্ত্র গর্জে ওঠে। তাঁদের গোলাগুলিতে হতাহত হয় অনেক পাকিস্তানি সেনা। অক্ষত পাকিস্তানি সেনারা ছোটাছুটি করে নিরাপদ আশ্রয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য পাকিস্তানিরা পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। তখন মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন। এ সময় পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের ধাওয়া করে। কিন্তু তাঁদের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।
আলিমুল ইসলাম চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল জয়দেবপুরে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ২৮ মার্চ ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরে, পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ‘এস’ ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য আলিমুল ইসলামকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ১২০।
আলিমুল ইসলাম ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে হাবিলদার (বর্তমানে সার্জেন্ট) হিসেবে অবসর নেন। বর্তমানে নিজ বাড়িতে অবসর জীবন যাপন করছেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার সদর উপজেলার খাগড়হর ইউনিয়নের কালিগাপুর গ্রামে। বাবার নাম ইসকান্দার আলী, মা নজিরননেছা। স্ত্রী মাজেদা খাতুন। তাঁদের দুই ছেলে, দুই মেয়ে।
সূত্র: প্রথম আলোর ময়মনসিংহ প্রতিনিধি কামরান পারভেজ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৩।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
rashedtr@prothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.