হারিয়ে যাচ্ছে কাসিদা by দীপংকর গৌতম

হারিয়ে যাচ্ছে পুরানো ঢাকার জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক মাধ্যম কাসিদা । মূলত কাসিদা গাওয়া হতো রমজান মাস আসলেই । বিশেষত চাঁদরাতে বিশেষ ধরনের আয়োজন করা হতো । ঢাকার ইতিহাসে দেখা যায়, লৌখনো থেকে জমিদাররা ঢাকায় আসার সময় সঙ্গে অনেক লোকজনও নিয়ে আসেন।

যে জন্য পুরানো ঢাকায় উর্দু ভাষার প্রচলন রয়েছে । পুরানো ঢাকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে ভারতের লৌখনো, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে । বিশেষত সংক্রান্তির ঘুড়ি ওড়ানো,চৈত্রের গাজন ইত্যাদি । তবে লৌখনোর আদলে কাসিদা চর্চার বৈচিত্র্য বেশ আগের । আরবি শব্দ ‘কাসিদ’ থেকে কাসিদার উৎপত্তি। কাসিদ অর্থ দূত বা বার্তাবাহক। ধারণা করা যায়, ধর্মের বার্তা বহন করায় এ সঙ্গীতের নাম হয়েছে কাসিদা। কবিতার ছন্দে ধর্মীয় বিষয় বা ব্যক্তির প্রশংসা বর্ণনা করাই কাসিদার মর্মার্থ। অনেক গবেষকের মতে, মোগল আমলেই মূলত কাসিদার প্রচলন ঘটে। এক সময় এ গানের মধ্য দিয়ে এক জমিদার আরেক জমিদারকে সেহরীর দাওয়াত দিতো । সে সময় উর্দু শের বলার প্রতিযোগিতা হতো । মধ্যরাতে মহল্লায় মহল্লায় প্রতিযোগিতা হতো শের বলার । এসব অনুষ্ঠানে শের রচনার অনেক লোক ছিল । জমিদাররা শের রচনাকারীদের টাকা দিয়ে শের লিখিয়ে আরেক জমিদারকে শোনাত,দাওয়াত দিতো । তবে রমজান মাসের মহিমা প্রকাশই ছিল এ গানের লক্ষ্য । পবিত্র রমজান মাসে পুরনো ঢাকার ঐতিহ্য কাসিদা (ধর্মভিত্তিক এক ধরনের কোরাস সঙ্গীত) এখন আর তেমন গাওয়া হয় না। ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে ঢাকার এক সময়ের ব্যাপক জনপ্রিয়  সঙ্গীত কাসিদা।

মাত্র দুই দশক আগেও রমজান মাসে সেহরির আগে পুরনো ঢাকায় কান পাতলেই সম্মিলিত কণ্ঠে গাওয়া কাসিদা শোনা যেত। কাসিদা ছাড়া সেহরিই জমতো না। কিন্তু এখন শুধু প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান ছাড়া অন্য কোথাও কাসিদা গাওয়া হয় না। তাই প্রাচীন এই সঙ্গীত ধারাটিকে রক্ষার আহবান জানিয়েছেন পুরনো ঢাকাবাসী। ১৯৪৭ সালে প্রথম ঢাকায় কাসিদা গানের প্রথম প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। অবাঙ্গালি মোহাজেররাই মূলত কাসিদা গানের রচয়িতা। পবিত্র রমজান মাসের মহিমা প্রচার করতেই কাসিদার আবির্ভাব। রমজান মাসে ভোর রাতে সেহরি খেতে ঢাকাবাসীকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার জন্যই কাসিদা পরিবেশন করা হয়। দলবদ্ধ হয়ে পাড়া-মহল্লায় রাতের পথ ধরে হেঁটে হেঁটে যুবকরা হ্যাজাক লাইট আর লাঠি নিয়ে কাসিদা পরিবেশন করে। রমজান মাসকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করে এই সংগীত পরিবেশন করা হতো। রমজানের চাঁদ দেখার দিন থেকে পাঁচ রোজা পর্যন্ত রোজাকে স্বাগত জানিয়ে কাসিদা ‘চানরাতি আমাদ’ গাওয়া হতো। পাঁচ থেকে পনের রোজা পর্যন্ত রোজার ফজিলত এবং আল্লাহ ও রাসুলের প্রশংসা বর্ণনা করে গাওয়া হতো খুশ আমদিদ মাহে রমজান। এছাড়া রমজানের বিদায় লগ্নে বিরহ ও হযরত আলীর শাহাদাতে দুঃখ প্রকাশ করে কেয়ামতের বর্ণনা করে কাসিদা পরিবেশিত হতো। তবে পুরনো ঢাকার উর্দু রোড, কসাইটুলী, বকশীবাজার, হোসেনী দালান ও বংশালে এখনো কাসিদা পরিবেশিত হয়। প্রতিবছর কাসিদা সঙ্গীত প্রতিযোগিতা হয়।  এবছরও সোবহান বেপারী স্মৃতি সংসদ কাসিদা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। রমজানের বিদায়কে কেন্দ্র করে গাওয়া হয় বিদায় সঙ্গীত ।

ঢাকার ‘হারিয়ে যাওয়া কাসিদা’ গ্রন্থের রচয়িতা সায়লা পারভীন বলেন, মূলত মোগল আমল থেকে ঢাকায় কাসিদার প্রচলন ঘটে। ১৯৪৭-১৯৪৮ সালে আমাদের এখানে কাসিদা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পুরনো ঢাকার ২০ থেকে ৩৫টি মহল্লায় কাসিদার প্রচলন ছিল বলে তিনি জানান। এখন কাসিদা কেবলই স্মৃতি। এখন যাও গাওয়া হয় সবই বাংলায় । উর্দু শের যারা লিখতেন তারাও এখন আর ওভাবে লিখেন না । পুরানো ঢাকার এই ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত মাধ্যমটি সংরক্ষণ না করলে অতি দ্রুত এটি হারিয়ে যাবে ।

জনপ্রিয় একটি কাসিদার কয়েকটি চরণ উল্লেখ করা হলো :

“এলোরে দেখ ঐ মাহে রমজান

জাগোরে মুসলমান।


চলরে মুমিন চলরে মুসলমান

দিলেতে পড়ি, নামাজ রোজা মুখেতে পড়ি কলেমা কালাম

জাগোরে মুসলমান

হাতে ধর কুরআন

জাগোরে মুসলিম/জাগোরে মুসলমান ।’’

দীপংকর গৌতম: গণমাধ্যমকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.