বিচার- ব্রেইভিক: গর্বিত (!) এক গণহত্যাকারী? by শেখ হাফিজুর রহমান

৭৭ ব্যক্তিকে হত্যার দায়ে ব্রেইভিককে যখন অসলোর একটি আদালত ২১ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করে রায় দিলেন, ব্রেইভিক তখন হাসছিলেন, যেন তাঁর জয় হয়েছে। ৭৭ ব্যক্তিকে খুন ও ২৪২ ব্যক্তিকে আহত করেছিলেন যে ব্রেইভিক, তিনি এই দণ্ডাদেশের জন্য শুধু প্রস্তুতই ছিলেন না, এ দণ্ডাদেশে তিনি মহাখুশি! এতগুলো মানুষকে খুন, জখম ও পঙ্গু করার পরও তিনি এতটুকু অনুতপ্ত নন।


কেননা তিনি, তাঁর মতে, একটি মহৎ উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য এ হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটিয়েছেন। ব্রেইভিক নরওয়েকে ‘মাল্টি কালচারালিজম’, ‘কালচারাল মার্ক্সসিজম’ ও ‘ইসলামে’র হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছেন।
২০১১ সালের ২২ জুলাই এনডারস বেহরিং ব্রেইভিক অসলোতে সরকারি ভবনের বাইরে গাড়িবোমা পেতে রেখে আট ব্যক্তিকে খুন করেন। তারপর ব্রেইভিক পুলিশ অফিসারের পোশাক পরে চলে যান উটোয়া দ্বীপে, সেখানে তখন লেবার পার্টির বার্ষিক সামার ক্যাম্প উপলক্ষে ৫৩৬ জন ব্যক্তি জড়ো হয়েছিলেন। ব্রেইভিক তাঁর পিস্তল ও সেমি অটোমেটিক রাইফেল থেকে গুলি ছুড়ে ৬৯ জনকে খুন করেন। এর মধ্যে ৩৪ জন ছিল ১৪ থেকে ১৭ বছর বয়সের। ওই দিন যারা ব্রেইভিকের নির্মম শিকারে পরিণত হয়, তাদের অনেককে খুব কাছ থেকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। ব্রেইভিক ২৬ বছরের এক নারীকে ছয়-ছয়বার গুলি করেন, যার একটি তাঁর মাথায় গিয়ে লাগে।
নরওয়ের মতো উদার, গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী সংস্কৃতির লালনকারী একটি সমাজে কীভাবে ব্রেইভিকের মধ্যে চরমপন্থী মতবাদ জেঁকে বসে? ওই মতবাদ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গণহত্যা করতেও কেন তিনি বিচলিত হন না? মামলার শুনানি শেষে আদালত তাঁকে কথা বলার সুযোগ দিলে তিনি ‘আরও হত্যাকাণ্ড না করার জন্য’ চরমপন্থী জাতীয়তাবাদীদের কাছে কেন ক্ষমা প্রার্থনা করেন? এ প্রশ্নগুলো পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের সচেতন ও সংবেদনশীল মানুষকে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত করে তুলেছে। আর নরওয়েবাসীর কাছে এ তো এক দুঃস্বপ্ন! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রক্তের এমন হোলি খেলা তারা আর কখনো দেখেনি।
হাজার বছর ধরে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা করেছে, এক বর্ণের মানুষ অন্য বর্ণের মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছে, একটি নৃগোষ্ঠী অন্য নৃগোষ্ঠীকে গণহত্যার মাধ্যমে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে পৃথিবী থেকে। যাঁরা হত্যা করেছেন, তাঁরা মনে করেছেন তাঁরা সঠিক কাজটিই করেছেন এবং প্রতিপক্ষ ধর্ম, বর্ণ বা গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যার ‘নৈতিক অধিকার’ ও ‘যৌক্তিক কারণ’ দুই-ই তাঁদের রয়েছে। গেস্টাপো বাহিনীর প্রধান ও জার্মানির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরিখ হিমলার ১৯৪৩ সালের ৪ অক্টোবর তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ইহুদিদের গণহত্যা করার ‘নৈতিক অধিকার’ তাঁদের রয়েছে, কেননা ইহুদিরা জার্মান সমাজের অস্তিত্বের জন্য হুমকি তৈরি করেছে। ইউরোপকে পরিশুদ্ধ করা, জার্মান সমাজকে নিরাপদ রাখা ইত্যাদির কথা বলে লাখ লাখ ইহুদিকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছে, আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তা দেখেছি। ওই ঘটনার ৬৬ বছর পর আমরা আবার নরওয়েতে এক ভয়াবহ রক্তপাত প্রত্যক্ষ করলাম এবং ব্রেইভিকের কণ্ঠে হিমলারের কথার প্রতিধ্বনি শুনলাম। ২২ জুলাইয়ের গণহত্যার আগে ব্রেইভিক ইন্টারনেটে তাঁর এক হাজার ৫১৬ পৃষ্ঠার মেনিফেস্টো প্রচার করেছিলেন। এ মেনিফেস্টোতে তিনি ইসলাম, মার্ক্সসিজম ও মাল্টি কালচারালিজমকে তাঁর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি মনে করেন, বহুত্ববাদী সংস্কৃতি ও মুসলিম অভিবাসীরা নরওয়েকে কলুষিত করছে। এ জন্য তিনি নরওয়েকে পরিশুদ্ধ করতে চান। আর পরিশুদ্ধ করার জন্য তিনি বেছে নেন হত্যাকাণ্ড। নরওয়েবাসীর রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ ও দ্বীপ, কিশোর ও কিশোরীর তরুণ প্রাণ নিথর হয়ে পড়ে থাকে সবুজ ঘাসের ওপর, কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি ব্রেইভিক, বিচারকাজ চলার সময়ও অনুতাপের দহন তাঁর চোখের দৃষ্টিকে কখনো ঝাপসা করেনি।
রায় ঘোষণার দিন ব্রেইভিক আদালতে ঢুকেই ফ্যাসিস্ট কায়দায় মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত উঁচিয়ে আদালতকে স্যালুট দেন। রায় ঘোষণার পর সাদা শার্ট, খয়েরি টাই ও কালো স্যুট পরা ব্রেইভিক হাসতে থাকেন, যেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত রায়টিই তিনি পেয়েছেন। ৭৭ জন মানুষ খুন ও ২৪২ জনকে জখম করার দায়ে তাঁকে ২১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাঁচজন বিচারককে নিয়ে গঠিত প্যানেলের কাছে তিনি বলেন, তাঁকে যেন ওই হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়, কেননা মুসলিমদের দ্বারা নরওয়ে পরিচালিত হওয়ার বিপদ থেকে নরওয়েকে রক্ষার জন্য ওই হত্যাকাণ্ডগুলো ছিল ‘নিষ্ঠুর ও প্রয়োজনীয়’। এ রায়ে ব্রেইভিক সবচেয়ে বেশি উৎফুল্ল হন এ কারণে যে আদালত তাঁকে পাগল বলে ঘোষণা করেননি, যদিও একদল মনোবিজ্ঞানী দৃঢ়ভাবে বলেছিল যে ব্রেইভিক মানসিকভাবে সুস্থ নন।
নরওয়েবাসী ২২ জুলাইয়ের ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে সংঘটিত ৯/১১-এর ঘটনার সমতুল্য বলে মনে করে। কিন্তু ওই ঘটনার নায়ক ব্রেইভিককে ২১ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করার মাধ্যমে নরওয়ে বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিল যে তারা কতটা সভ্য ও গণতান্ত্রিক। নরওয়ে দোষী ব্যক্তির শাস্তি যেমন নিশ্চিত করেছে, তেমনি বহুত্ববাদী সংস্কৃতি, গণতন্ত্র এবং মানবতাবাদী আইন ও নীতিমালাকেও সমুন্নত রেখেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ৯/১১-এর ঘটনার জন্য দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দিতে গিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে দখল করেছে আফগানিস্তান ও ইরাক। ব্রেইভিককে যে ২১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, নরওয়ের আইনে ওটাই সর্বোচ্চ শাস্তি, ওখানকার আইনে মৃত্যুদণ্ড নেই, কেননা ওরা মৃত্যুদণ্ডকে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবিক মূল্যবোধের অপমান মনে করে। ৭৭ জন মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যার পরও নরওয়ের আদালত যেভাবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করলেন, তাতে সহিষ্ণুতা, অহিংসা এবং ক্ষমাশীল ন্যায়বিচারের প্রতি নরওয়ের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। আশা করি, আমরাও এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করব। আমাদের প্রিয় বাংলাদেশও একদিন হয়ে উঠবে পরমতসহিষ্ণু, শান্তিপূর্ণ ও ক্ষমাশীল ন্যায়বিচারের এক দেশ।
শেখ হাফিজুর রহমান: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.