করদাতাদের সরকার কিছু একটা ফেরত দিক! আসুন সবাই আয়কর দিইঃ লায়ন মীর আব্দুল আলীম

করদাতাদের আয়কর প্রদানে উৎসাহিত করতে প্রতিবছর “জাতীয় আয়কর দিবস” পালন করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ওই দিবসটিতে দেশের সর্বোচ্চ করদাতাদের সম্মাননা প্রদানসহ নানা কর্মসুচি করে থাকে। ১৫ সেপ্টেম্ব সারা বিশ্বে এ দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় পালিত হলেও মাত্র ৪ বছর আগে থেকে (২০০৮ সালে) এদেশে দিবসটি পালিত হচ্ছে। এ দিবসটি পালনের লক্ষ্য হচ্ছে জনগণকে আয়করের প্রতি সচেতন করে তোলা।
সাধারণত সরকারের পক্ষ থেকেই দিবসটি পালনের নানা কর্মসূচি থাকে। এবারও দিবসটি পালনে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। খুবই আশার কথা গত ৪ বছর ধরে এদিবসটি পালনের পর থেকে আয়কর আদায় বেড়েছে। এবার আয়করের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আয়কর দিবস পালন করাতেই কর আদায় বেড়েছে তা বলা যাবে না। তবে আয়কর দিবস কর আদায়ে জনগণকে কিছুটা হলেও উদ্বুদ্ধ করেছে। এবার সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা প্রতিটি জেলায় এবং উপজেলা পর্যায়ে আয়কর দিবস পালন করছে। এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় আয়কর দিবস পালন এবং আয়করের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। আয়কর দিবসটিকে ঘিরে রাজস্ব বোর্ডের বিভিন্ন সচেতনতামূলক কার্যক্রমের ফলে প্রতিবছর আয়কর আদায়ের পরিমাণ বাড়ছে। পাশাপাশি আয়কর দাতাদের সংখ্যাও বাড়ছে। যে হারে করদাতার সংখ্যা বাড়ছে তা সন্তষ্ট হবার মত নয়। আয়কর আদায় বাড়াতে সরকারের আরও কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের উচিত জনগণের আয় বাড়ান ও ব্যয় কমান। কিন্তু অবস্থা উল্টো। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ আয় যা করেন, ব্যয় তার চেয়ে অনেক বেশি। তাই হিমশিম খেতে হয় সাধারণ মানুষকে। দ্রব্যমূল্য কমানো এবং মানুষের আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে পারলে তখনই সার্থক হবে জাতীয় আয়কর দিবস পালনের। মানুষের খরচের চেয়ে আয় যখন বেশি হবে তখন আয়কর দিতে কারো কোনো অসুবিধা হবে না। আয় বাড়লে ব্যক্তিগত শ্রেণীর করদাতা বাড়বে।

উন্নত দেশে পরোক্ষ করের চেয়ে আয়করের মতো প্রত্যক্ষ করের পরিমাণই বেশি। আমাদের দেশে তার উল্টো। এখানে মোট রাজস্ব আয়করের পরিমাণ মাত্র ২০ ভাগ। অর্থাৎ ৮০ ভাগই আসে অপ্রত্যক্ষ কর থেকে। আয়কর বাড়ানোর জন্য এনবিআর ও আয়করদাতার মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক জরুরি। ভয়ভীতি দেখিয়ে আয়কর আদায় বাড়ানোর চেষ্টা সফল হয় না। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই তা প্রমাণ হয়েছে। সে সময় এনবিআর বিভিন্ন মার্কেটে গিয়ে ব্যবসায়ীদের আয়কর দেয়ার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা প্রশংসনীয়। তবে কর ফাঁকির অভিযোগে তাদের পাইকারি গ্রেফতার ও হয়রানির ঘটনা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। নাগরিকরা তখনই আয়কর দিতে উৎসাহী হবেন, যদি তারা দেখেন তাদের অর্থের অপচয় হচ্ছে না; দেশের উন্নয়ন ও জনকল্যাণেই তা ব্যয় হচ্ছে। স্বীকার করতে হবে, নাগরিকদের মধ্যে আয়কর দেয়ার প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি এ নিশ্চয়তা দেয়া হয়, কোন নাগরিক আয়কর দিতে গেলে হয়রানির শিকার হবেন না, তাহলে আয়করদাতার সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। আয়কর পরিশোধ সামাজিক দায়িত্বের অন্তর্গতও বটে। এনবিআর কর্তৃক শীর্ষ আয়করদাতাদের সম্মাননা জানানোর বিষয়টি বরাবরই প্রশংসনীয়। রাজস্ব আদায় কার্যক্রমে বিদ্যমান অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধেও সরকারকে কঠোর মনোভাব নিতে হবে। প্রত্যক্ষ করের পরিমাণ বাড়ানো গেলে ভ্যাটের মতো অপ্রত্যক্ষ করের বোঝা সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্তকে কমই বহন করতে হবে। সেটি হবে সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে আনার একটি বড় উপায়।
প্রতি বছর দেশের মোট রাজস্ব আয়ের ৩০ শতাংশ প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর থেকে আসে। রাজস্ব বোর্ডের এক তথ্য মতে, গত ৭ বছরে আয়কর আদায় বেড়েছে প্রায় চারগুণ। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে যেখানে ৭ হাজার ১৬২ কোটি টাকা আয়কর আদায় হয়েছিল, ২০১১-১২ অর্থবছরে তা ২৮ হাজার ৩৬০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ৮ হাজার ৭২১ কোটি টাকা, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৪৪ দশমিক ৬৬ কোটি টাকা, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা, ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৪১ কোটি টাকা, ২০১০-১১ অর্থবছরে ২৩ হাজার ২৩ হাজার ৭ কোটি টাকা আয়কর আদায় হয়েছে। তাই আয়কর আদায় অব্যাহত রাখতে এবং করদাতাদের অনুপ্রাণিত করতে দীর্ঘমেয়াদি ও সর্বোচ্চ করদাতাদের প্রতিবছর সম্মাননা দিয়ে আসছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।এদিকে চলতি (২০১০-১১) অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭২ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এই লক্ষ্যমাত্রা ১৯ শতাংশ বেশি। তার মধ্যে চলতি অর্থবছরে আয়কর খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২১ হাজার ৫ কোটি টাকা। বর্তমান সরকারের শেষ বছরে আয়করের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে অর্থমন্ত্রী প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। এ প্রত্যয় বাস্তবে রূপ দিতে হলে এনবিআর কর্মকর্তাদের দক্ষতাও বাড়াতে হবে; নিতে হবে নতুন নতুন যুগোপযোগী পদক্ষেপ।

আয়কর বাড়ানোর কতিপয় সুপারিশ :
#    কর হচ্ছে দেশের মূল চালিকা শক্তি। করদাতার সংখ্যা বাড়লে; করের ক্ষেত্র বাড়লে কর আয় বাড়লে দেশের মঙ্গল। আয়কর আইন ও আয়কর প্রদান পদ্ধতি নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। আছে জনগনের মধ্যে ভীতিও। আয়কর পদ্ধতি এবং আইন উভয়ই সহজ করা প্রয়োজন।
#    হালনাগাদ আয়কর পরিশোধের সনদপত্র প্রদান না করলে করের আওতাধীন ব্যক্তির কোনো লাইসেন্স নবায়ন করা যাবে না।
#    যে পরিমান বিলাসবহুল গাড়ী রাস্তায় চলে সেই মাত্রার দেশে করদাতা পাওয়া যায় না। গাড়ির মালিকদের গাড়িতে আয়করের প্রত্যয়ন পত্র রাখতে বাধ্য করতে হবে এবং তা যে কোন সময় তা পরীক্ষা করতে হবে। গাড়ির কাগজ পত্র ঠিক না থাকলে যেমন মামলা ঠুকে দেয়া হয় তেমনই করের কাগজপত্রও সঠিক না থাকলে জরিমানা এবং মামলার বিধান করতে হবে। তাতে নতুন করদাতার সংখ্যা বাড়বে।
#    আমাদের দেশে ব্যক্তিগত করদাতাদের অধিকাংশই চাকুরীজীবী। তারা বাধ্য হয়ে করের আওতায় আসেন। তাদেওর চেয়ে আয় বেশী করছেন এমন ব্যক্তি করের আওতায় না এসে নিজেকে লুকিয়ে রাখছেন। তাদের স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে চিহিৃত কর করের আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বার কিংবা কমিশনারদের কাছ থেকে তালিকা চাইতে পারে এনবিআর। তাদেও দেয়া তালিকা যাচাই বাছাই করে কর দিতে সমর্থ আছে এমন ব্যক্তিকে করের আওতায় আনতে হবে।
#    ব্যক্তি যখন করের সুফল উপভোগ করবেন, তখনই তিনি আরেকজনকে কর দেয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে পারবেন। এ জন্য শুধু কর নিলেই চলবে না করের বিপরিতে জনগনকে (করদাতাকে) কিছু একটা সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। কর দিচ্ছি কিšুÍ আমর কতোটুকু এবং কী লাভ হচ্ছে এ প্রশ্ন যেন না জাগে জনমনে।
#   করদাতাকে জানতে দেয়া হোক তার কর কোথায় কীভাবে খরচ হচ্ছে। ব্যক্তিকে বুঝতে দেয়া হোক তার দেয়া করের ফলে দেশের অমুক অমুক উন্নতি হচ্ছে। সরকারকে তখন আর পয়সা খরচ করে প্রচারণা চালাতে হবে না, ব্যক্তি নিজ উদ্যোগেই কর জমা দিয়ে আসবে।
#    আয়কর কর্মকর্তাদের মানসিকতায় পরিবর্তন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের জনবল সংকট নিরসন ও কর্মপরিধি বাড়ানোর মধ্য দিয়ে করদাতা ও কর আদায় বাড়ানো সম্ভব হবে।
#    কর দেয়া মানুষের নাগরিক দায়িত্ব এই ধরনের কথার চেয়ে মানুষ বরং বেশি উৎসাহিত হবে যখন দেখবে তার করের বিনিময়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু কাজ হচ্ছে। সরকারেরও উচিত মানুষের করের টাকায় প্রতি বছর কী কী কাজ হচ্ছে সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করা।
#    সরকারের উচিত হবে আয়কর রিটানের কাজটিকে আরো সহজতর করে তোলা। যাতে করের ব্যাপারে জনগনের মনে ভীতি না জন্মে।
#    বার্ষিক আয়ের রিটার্ণ আয়কর অফিসে সাবমিট করা এবং কর পরিশোধ সংক্রান্ত সনদ সংগ্রহ সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞতা বোধ করি প্রতি বছরই সবচেয়ে কঠিন দুঃস্বপ্ন। এ বিড়ম্বনা দুর করতে হবে।
#    বাংলাদেশই বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে আয়করের চেয়ে আমদানী করের পরিমান বেশী। মানে এখানে কর দিয়ে আমদানী করার পয়সা আছে, কিন্তু আয়কর দেবার লোক নেই। কর ফাঁকির শুভংকরের ফাঁকিটা এখানেও কিছুটা বোঝা যায়। এ ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে হবে।
#    আমাদের অর্থনীতিতে কালোটাকার পরিমান বাড়ছে। আর সরকারকে প্রতিবছরই কালোটাকা সাদা করার জন্য সুযোগ দিতে স্বার্থান্বেষীমহল চাপ দিচ্ছে। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া আর যারা ঠিকমতো কর দেয় তাদের অপমান করা একই বিষয়। ট্যাক্স রেঞ্জের কারনে প্রতিবছর যে বিপুল পরিমান টাকা অঘোষিত আয় হিসেবে থেকে যাচ্ছে আর সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব সামান্য কটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই এটি রোধ করা যেতে পারে ।
#    কেউ প্রায় এক যুগ ধরে আয়কর দিয়েও দেখেন না তিনি বিনিময়ে কোন সুবিধা পাচ্ছেন কিনা। কিন্তু যখন তিনি এটা খেয়াল করেন যে তার চেয়ে দশগুন বেশী আয় করেও কোন কোন ব্যবসায়ী ঐ ব্যক্তির এক দশমাংশ আয়কর দেন এবং কর অফিসের সাথে তার চেয়ে বেশী সুসম্পর্ক রাখেন এবং মর্যাদা পান। তখনই ক্ষোভটা আসে, কর দিয়া তার কি লাভ হল। এমনটি যেন না হয়।
#    আয়কর দাতারা শুধু দিয়েই যান। সরকার তাদেরকে অন্ততঃ কিছু একটা ফেরত দিক। এতে সরকার আরও লাভবান হবেন। যদি আর্থিকভাবে কিছু না দিতে পারেন তবে আপাততঃ শান্তনা হিসেবে দেয়া যায় আইডি কার্ড। সবাইকে কার্ড দেয়ার দরকার নেই।তিনরকম কার্ড দেয়া যেতে পারে। সিলভার, গোল্ড, প্লাটিনাম। অনেকটা ক্রেডিট কার্ডের মত।যাদের বাত্তসরিক প্রদত্ত আয় ২০,০০০ টাকা বা তার উর্ধে তারা সিলভার কার্ডের যোগ্য হবেন।যাদের ১০০,০০০ টাকার উপরে তারা গোল্ড এবং যারা ৫০০,০০০ টাকার উপরে তাদেরকে প্লাটিনাম কার্ড দেয়া উচিত।প্লাটিনাম কার্ডধারীরা আপনাআপনিই সিআইপি হিসেবে স্বীকৃত হতে পারেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় সিআইপি নির্বাচনে আর কাউকে গলদঘর্ম হতে হবে না।

এ কথা স্বীকার করতেই হবে, নাগরিকদের মধ্যে আয়কর দেয়ার প্রবণতা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি এ নিশ্চয়তা দেয়া হয়, কোন নাগরিক আয়কর দিতে গেলে হয়রানির শিকার হবেন না, তাহলে আয়করদাতার সংখ্যা আরও বেড়ে যাবে। সেজন্য যুৎসই আইন প্রণয়ন ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করা প্রযোজন। উপরোক্ত সুপারিশগুলো কাজে লাগানো যেতে পারে। এতে দেশের করের ক্ষেত্র আরও সম্প্রসারন হবে বলে মনে করি।


লায়ন মীর আব্দুল আলীম
(লেখক- সাংবাদিক , কলাম লেখক ও নিউজ বাংলাদেশ ডটকমের সম্পাদক, newsstore09@gmail.com) 
সাংবাদিক ও নিউজ বাংলাদেশ ডটকমের সম্পাদক।
৩০/৩১ বিসিআইসি ভবন (১৭ তলা), দিলকুশা বা/এ, ঢাকা-১০০০।
মোবাইল-০১৭১৩৩৩৪৬৪৮,
ই-মেইল-newsstore09@gmail.com 
তাং- ১১/০৯/২০১২ ইং

No comments

Powered by Blogger.