তাকওয়া অর্জনের মাস রমজান by মাওলানা এম এ করিম ইবনে মছব্বির

মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনুল করিমে ঘোষণা করেছেন, হে মুমিনগণ! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান দেওয়া হয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তীদের। আল-কোরআনের এ আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া অর্জনের গুণাবলি সৃষ্টি হয়ে যাবে।


এ আয়াতে লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন থেকে প্রমাণিত হয়, রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্যই তাকওয়া অর্জন।
আভিধানিকভাবে তাকওয়া শব্দটি ওকিউন থেকে এসেছে। এর একটি অর্থ বাঁচা। আরেকটি অর্থ হচ্ছে ভয় করা। পারিভাষিক অর্থে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর সব আদেশ মানা ও নিষিদ্ধ কাজগুলো থেকে দূরে থাকা। ইসলামী জীবনব্যবস্থা হচ্ছে মুসলমানদের জন্য পঞ্চম স্তম্ভবিশিষ্ট গৃহের মতো। আর রোজা হচ্ছে সেই গৃহের তৃতীয় স্তম্ভ। এই রোজার মাধ্যমে দেহ ও মনকে সংযমের শাসনে রেখে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন ও তাকওয়া অর্জনের কঠোর সিয়াম সাধনাই মাহে রমজানের মূল কাজ। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, তাকওয়া হলো আল্লাহর আদেশের আনুগত্য হওয়া, নাফরমানি না করা, আল্লাহকে স্মরণ করা, তাঁকে ভুলে না যাওয়া, আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা এবং কুফরি না করা।
তুমি যে আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে, আমার ভয় তোমার অন্তরে থাকবে না। তুমি তোমার পরিবার-পরিজন, ধনসম্পদ, আত্মীয়স্বজন, ব্যবসাবাণিজ্য, রাজনীতির নেশা- সব কিছু নিয়ে তুমি যখন দূরে সরে যাবে। তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য, হে প্রিয়! তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক গাঢ় করার জন্য, হে মুমিন বান্দারা! আমি তোমাদের ওপর বাধ্যতামূলক এই রোজা দিয়েছি। যাতে তোমাদের অন্তরে আমার ভয়ভীতি ও ভালোবাসার সঞ্চার করে নিতে পারি। বান্দার ভয় থাকলেই বান্দা আল্লাহর কাছে আসে। আল্লাহ পাকের ভয় যদি মুমিনের অন্তরে থাকে, তখন মুমিন আল্লাহর কাছে আসবেই, আল্লাহকে ভালোবাসবেই এবং আল্লাহর কাছে প্রিয় মুমিন হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবেই।
হজরত ওমর বিন আবদুল আজিজ (রা.) বলেছেন, দিনে রোজা রাখা কিংবা রাতে জাগরণ করা তাকওয়া নয়, বরং তাকওয়া হচ্ছে আল্লাহ যা ফরজ করেছেন তা পালন করা এবং তিনি যা হারাম করেছেন তা থেকে দূরে থাকা।
বিশিষ্ট তাবেঈ তালাক বিন হাবিব বলেন, আল্লাহর আলোর উজ্জ্বলতায় তাঁর হুকুমের পূর্ণ আনুগত্য করা ও পুণ্যের আশা করা এবং আল্লাহর বিশাল শক্তিকে ভয় করা, আর তাঁর নাফরমানি ত্যাগ করার নাম তাকওয়া।
হজরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) সাহাবি উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। উবাই (রা.) বলেন, হে ওমর (রা.)! কাঁটাযুক্ত রাস্তায় কিভাবে চলেন? ওমর (রা.) বললেন, বেছে বেছে চলি। উবাই (রা.) বললেন, এটাই হচ্ছে তাকওয়া।
তাকওয়ার এই মহান ব্রত সৃষ্টির জন্যই রমজান শরিফ আসে প্রতিবছর। রাসুলে পাক (সা.) বলেন, তাকওয়াবিহীন রোজা গ্রহণযোগ্য নয়।
তাকওয়া অত্যন্ত উঁচু স্তরের মহামূল্যবান একটি গুণ এবং সব কাঙ্ক্ষিত গুণের সমষ্টিও বটে। যার মধ্যে তাকওয়ার গুণ রয়েছে, তাকে আল্লাহ পাক দুনিয়া ও আখেরাতের সব কল্যাণের জামানত দান করেছেন। তাকওয়া এমন এক জিনিস, যার মাধ্যমে সব সমস্যা মোকাবিলা করার কথা পাওয়া যায়। আর এই তাকওয়া অর্জনকারী মুত্তাকিদের জন্য এমন বেহেশতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে, যার প্রশস্ততার মধ্যে সারা পৃথিবী ঢুকে যাবে। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন, যদি লোকালয়ের লোকেরা ইমান গ্রহণ করে, আর তাকওয়া অবলম্বন করে, তাহলে আমি তাদের জন্য আসমান ও জমিনের সব বরকতের দরজা খুলে দেব। (সুরা আল-আরাফ)।
আর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া এ জন্য অর্জিত হয় যে মানুষ (আত্মজ্ঞান) যখন তার দেহ ও অন্যান্য শক্তি পরিপূর্ণরূপে আয়ত্তাধীন করে নিতে পারে এবং মনের যাবতীয় কামনা, বাসনা ও আবেগ-উচ্ছ্বাসকে নিজের সিদ্ধান্তের অনুসারী করে তুলতে পারে, ঠিক তখনই হয় আত্মসংযম। ইসলামের দৃষ্টিতে সফল জীবনের জন্য অনুগত খুদি একান্ত অপরিহার্য। যে খুদি অবাধ্য তার উদাহরণ হলো ফেরাউন, নমরুদ, হামান ও কারুন। যারা পৃথিবীতে শুধু অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। রোজা মানুষের মধ্যে অনুগত খুদি তৈরি করে। নফস ও দেহের যাবতীয় চাওয়া-পাওয়া যাচাই করে দেখলে জীবন ও দেহের দাবি খুবই জরুরি বলে মনে হয়। জীবন ও দেহের তিনটা দাবি হচ্ছে- এক. ক্ষুণি্নবৃত্তি- জীবন রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যক। দুই. যৌন আবেগ- বংশ তথা মানবজাতির স্থিতির জন্য যা প্রয়োজন। তিন. বিশ্রাম গ্রহণের দাবি। মানুষের এ তিনটি দাবি যদি নিজ নিজ পরিসীমার মধ্যে থাকে, তবে তা বিশ্বপ্রকৃতির অন্তর্নিহিত ভাবধারার অনুরূপ হবে সন্দেহ নেই। অন্যদিকে নফস ও দেহের কাছে এ জিনিসই হচ্ছে বড় ফাঁদ। একটু ঢিলা, একটু সুযোগ পেলেই এ তিনটি ফাঁদ মানুষের খুদিতে বন্দি করে নিজের গোলাম, নিজের দাসানুদাস বানিয়ে দেয়। ফলে এর প্রতিটি দাবি সম্প্রসারিত হয়ে অসংখ্য দাবির একটি দীর্ঘ ফিরিস্তি হয়ে যায়। একটি দুর্বল খুদি এখন এসব দাবির কাছে পরাজিত হয়, তখন খাদ্যের দাবি তাকে পেটের দাস বানিয়ে দেয়। যৌনক্ষুধা তাকে অনেক নিম্নস্তরে নামিয়ে ফেলে। বিশ্রামপ্রিয়তা তার ইচ্ছাশক্তি বিলোপ করে দেয়। অতঃপর সে তার নফস ও দেহের শাসক বা পরিচালক থাকে। সে তার দাসে পরিণত হয়। আর রোজা নফসের এ তিনটি লালসা-বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। নিয়মানুগ করে ৭২০ ঘণ্টার এই বাধ্যতামূলক সুমহান প্রশিক্ষণ কোর্সের মাধ্যমে। সে যদি আল্লাহর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করে, এ রোজা তাকে সম্বোধন করে বলে- আল্লাহ পাক আজ সারা দিন পানাহার করাকে নিষেধ করেছেন, অনুগত খুদি তা মেনে নেয় অকাতরে। রোজা আহ্বান জানায়, আজ তোমার মালিক আল্লাহ তোমার যৌনক্ষুধা চরিতার্থ করার ওপর দিনের বেলা বিধি-নিষেধ করেছেন, অনুগত যদি তা মেনে নেয়। সারা দিনের দুঃসহ ক্ষুধা-পিপাসার পর যখন তুমি ইফতার করবে, তখন তুমি পরিশ্রান্ত হয়ে আরাম করার পরিবর্তে কিয়াম অর্থাৎ নামাজ পড়ার জন্য তৈরি হও এবং অন্যান্য দিনের চেয়েও বেশি বেশি ইবাদত করো। বস্তুত এতেই তোমার রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি নিহিত আছে। এর ফলে খুদির মধ্যে একটি বিরাট শক্তি স্ফুরিত হয়। তা আল্লাহর মর্জি অনুসারে নিজের নফস ও দেহের ওপর শাসন ক্ষমতা চালাতে সামর্থ্য হয়। মুমিনের আত্মজ্ঞান, তার ক্ষুধা, পিপাসা, যৌনবৃত্তি এবং বিশ্রাম-অভিলাষ শুধু রোজার মাসেই নয়; বরং পরবর্তী ১১ মাস ধরেও মানুষের তিনটি সর্বপ্রধান এবং সবচেয়ে বেশি জোরদার ও শানিত হাতিয়ারের মোকাবিলা করে আল্লাহর বিধানের অধীনে তার সব কার্যসূচিকে অনুগত করে দেয়। আর এ জন্য তাকওয়া সৃষ্টিতে রোজা নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। আল্লাহ পাক আমাদিগকে তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে ১৪৩৩ হিজরির রমজানুল করিম পালন করার তওফিক দান করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।
লেখক : ইসলামী গবেষক

No comments

Powered by Blogger.