বর্ণিল সমাপনীতে পর্দা নামল লন্ডন অলিম্পিকের by জাহিদুল আলম জয়

অবিশ্বাস্য, অবিস্মরণীয়, তাক লাগানো, মনোমুগ্ধকর, জমকালো, বর্ণিল কোন উপমাই গ্রেট ব্রিটেনের জন্য যথেষ্ট নয়। এক কথায় বলতে হবে সর্বকালের অন্যতম সেরা অলিম্পিক গেমস উপহার দিয়েছে লন্ডন। মাঠ এবং মাঠের বাইরে সমান সফল হয়েছে দেশটি।
গত ২৭ জুলাই পূর্ব লন্ডনের স্ট্যার্টফোর্ডের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে জ্বলে উঠেছিল যে মশাল, টানা সতেরো দিন সাড়ে দশ হাজার বিশ্বসেরা এ্যাথলেটের আলো ছড়ানো অনবদ্য ক্রীড়া নৈপুণ্যের মাধ্যমে তার সমাপ্তি ঘটল রবিবার। যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার, চীনের শীর্ষস্থান হাতছাড়া, স্বাগতিক গ্রেট ব্রিটেনের শত বছরের সেরা সাফল্য, গতির রাজা উসাইন বোল্টের গৌরবময় কীর্তিগাথা, মাইকেল ফেলপ্সের সবচেয়ে বেশি অলিম্পিক পদক জয়ের রেকর্ড, পা হারানো দৌড়বিদ অস্কার পিস্টোরিয়াসের ঐতিহাসিক অংশগ্রহণ, ব্রাজিল পুরুষ ফুটবল দলের আরও একবার স্বর্ণ জিততে না পারার হাহাকার, বিভিন্ন ডিসিপ্লিনে রেকর্ড ভাঙ্গা গড়ার খেলাÑ এ রকম অসংখ্য কীর্তির সাক্ষী হয়ে থাকল এবারের ৩০তম লন্ডন অলিম্পিক।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েই সারাবিশ্বের চোখ ছানাবড়া করে দিয়েছিল গ্রেট ব্রিটেন। এরপর দুই সপ্তাহেরও বেশি সময়ের মাঠের লড়াইয়ে তারা দেখিয়েছে নজরকাড়া সাফল্য। শেষদিকে দাপট ধরে রেখেই গর্বের সঙ্গে তারা সমাপনী অনুষ্ঠানে পা রাখে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সারাবিশ্বকে গ্রেট ব্রিটেন যেমন মোহিত করে তুলেছিল তেমনি সমাপনীতেও উপহার দিয়েছে স্মরণকালের অন্যতম সেরা আয়োজনযজ্ঞ। রবিবার রাতের ঝলমলে জমকালো সমাপনী অনুষ্ঠানকে যেন ব্রিটেনের এবারের অলিম্পিকে নিজেদের ১০৪ বছরের সাফল্য আরোহণের স্মারক মনে হচ্ছিল। সার্বিকভাবে দেখলে অসাধারণ, সাফল্যম-িত একটি আসর শেষ করল ব্রিটেন। অলিম্পিককে বাহন করে পুরো বিশ্বের কাছে নিজেদের মেলে ধরতে চেয়েছিল ব্রিটিশরা। নতুন করে চেনানোর তীব্র বাসনাও ছিল তাদের। ‘এক বিশ্ব এক স্বপ্ন’ সেøাগানকে সামনে রেখে সে ইচ্ছাটার স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে তারা। এ জন্য আয়োজকদের চোখেমুখে তৃপ্তির হাসিও। ব্রিটিশ অলিম্পিক এ্যাসোসিয়েশনের (বিওএ) চেয়ারম্যান কলিন ময়নিহান বলেছেন, আমরা অত্যন্ত গর্বিত সফলভাবে আসর শেষ করতে পেরে। আমাদের আত্মবিশ্বাস ছিল ভাল করার। আমরা সেটা পেরেছি। আমাদের দলের সাফল্যেও আমরা গর্বিত। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনও বিশ্বের সর্ববৃহৎ মিলনমেলার আয়োজন নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, আমরা সফলভাবে গেমস শেষ করতে পেরেছি। এ জন্য সবার কাছে কৃতজ্ঞ। নিজ দেশের এ্যাথলেটদের সাফল্যেও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন ডেভিড ক্যামেরন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই সাফল্য পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। আমাদের সাফল্য নিয়ে আমরা গর্বিত। লন্ডন অলিম্পিকের সাফল্য নিয়ে ব্রিটিশরা গর্ব করতেই পারে। কেননা এবার পদক তালিকার তৃতীয় স্থান অর্জন করে ১৯০৮ অলিম্পিকের পর নিজেদের ইতিহাসের সেরা সাফল্য পেয়েছে গ্রেট ব্রিটেন। শতাধিক স্বর্ণ পেয়েছে এক আসর পর শীর্ষস্থান পুনরুদ্ধার করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বেজিং আসরের সেরা চীন আসর শেষ করেছে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে।
অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে নিয়ে সবার মধ্যে আলাদা একটা আগ্রহ থাকে। কিন্তু সমাপনী অনুষ্ঠানকে ঘিরে সচরাচর তেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায় না। সনাতন এই নিয়মের বেড়াজাল থেকে চার বছর আগে বেরিয়ে এসেছিল বেজিং। এবার লন্ডনও একই পথ অনুসরণ করল। উদ্বোধনী যজ্ঞের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না লন্ডনের সমাপনী যজ্ঞ। বরং কিছু ক্ষেত্রে শুরুর ক্ষণকে ছাড়িয়ে গেছে শেষের মহারণ। এমনটি না হওয়ার কোন কারণও ছিল না। কেননা সমাপনী অনুষ্ঠানের জন্যই ব্রিটিশদের রিহার্সেল করতে হয়েছে প্রায় এক বছর! ‘এ সিম্ফোনি অব ব্রিটিশ মিউজিক’ এই শিরোনামে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে শুরু হয় সমাপনী অনুষ্ঠানের কার্যক্রম। অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ সঙ্গীত তুলে ধরা হয়। নব্বইয়ের দশকে বিশ্ব মাত করা বিখ্যাত ব্যান্ড ‘স্পাইস গার্লস’ এর শিল্পীরা একসঙ্গে সঙ্গীত পরিবেশন করেন। অন্যদের মধ্যে পারফর্ম করেন জর্জ মাইকেল আর অলিম্পিকের অফিসিয়াল গানের মালিক ব্যান্ড ‘মিউজ’-এর শিল্পীরা। তাদের নিয়েই গত ৫০ বছর ধরে যুক্তরাজ্যের সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যমটিকে বিশ্বের সামনে নতুন করে তুলে ধরেন গেমসের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর কিম গ্যাভিন। তাঁর নির্দেশনায় যুক্তরাজ্য তথা লন্ডনের সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হয়। সমাপনীতে গানের পাশাপাশি প্রায় চার হাজার শিশু-কিশোর বিভিন্ন শারীরিক কসরত প্রদর্শন করেন। সমাপনী অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি পারফর্মার। মোট কথা লন্ডন গেমসের সমাপ্তি ঘটে সুরের মূর্ছনাতেই। সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০১৬ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোকে শহরকে বরণ করে নেয়া হয়। আট মিনিটে তিন শ’র বেশি শিল্পী নিয়ে ব্রাজিলের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন দেশটির সুপার মডেল আলেসান্দ্রো এ্যামব্রোসিও। তাঁরা নেচে-গেয়ে বিশ্ববাসীকে আমন্ত্রণ জানান ২০১৬ অলিম্পিক গেমসে। পরবর্তী অলিম্পিকের পতাকা গ্রহণের জন্য বেশ ক’দিন হলো লন্ডনে অবস্থান করছিলেন রিও ডি জেনিরোর মেয়র এডওয়ার্দো পায়েস। গত শুক্রবার তিনি লন্ডনের মেয়র বরিস জনসনের সঙ্গে সংবাদ সম্মেলনও করেন। সে সময় পায়েস বলেছিলেন, আমাদের ধারণা মতোই আপনারা এ যাবতকালের সেরা গেমসটি আয়োজন করেছেন। আমি আগেও বহুবার লন্ডনে এসেছি। অলিম্পিক পার্কে আপনারা যা করেছেন তা এক কথায় দারুণ। আমরা এখানে এসেছি মেয়র বরিসের কাছ থেকে কিছুটা পরামর্শ নেয়ার জন্য। আমরা লন্ডনের অভিজ্ঞতা রিও গেমসে কাজে লাগাতে চাই। রবিরার সমাপনী অনুষ্ঠানে পুরনো কথা নতুন করে চাউর করেন রিও ডি জেনিরোর মেয়র। সমাপনী অনুষ্ঠানের শেষভাগে আনুষ্ঠানিকভাবে অলিম্পিক পতাকা তুলে দেয়া হয় পরবর্তী আসরের আয়োজক ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর মেয়র এডওয়ার্দো পায়েসের হাতে। এরপর নিভিয়ে ফেলা হয় অলিম্পিক মশাল। সবশেষে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) সভাপতি জ্যাক রোগে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্তি ঘোষণা করেন লন্ডন অলিম্পিকের। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ন্যায় সমাপনী অনুষ্ঠানেও মার্চপাস্টে অংশ নেন অংশগ্রহণকারী দেশের খেলোয়াড়রা। এবার অবশ্য কেউ কোন দেশের প্রতিনিধিত্ব করেননি। সবাই এক সঙ্গে জড়ো হন এক জাতির অংশ হিসেবে। ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিক থেকে এই রীতি চলে আসছে।
চার বছরের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে বিশ্বদরবারে উপস্থিত হয় দ্য বিগেস্ট শো অন দ্য আর্থ। বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের সবচেয়ে বড় এ আয়োজনের সময়টুকুতে অন্তত সবাই একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলেন। এ পাওয়াটুকুই বা কম কিসে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ এ পৃথিবীতে! লন্ডনের পর্দা নামার সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী আসরের রূপরেখা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। রিও ডি জেনিরোর মেয়র পতাকা হাতে নিয়ে তাদের সঙ্কল্পের কথা বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন। এ সময় লন্ডনকে বিদায় জানানোর পাশাপাশি স্বাগত জানানো হয় রিও ডি জেনিরোকে।

No comments

Powered by Blogger.