বিশেষ সাক্ষাৎকার : হাসানুল হক ইনু-দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ সভাপতি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান হাসানুল হক ইনু সাম্প্রতিক রাজনীতি, অর্থনীতি, সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা ও বিরোধী দলের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন কালের কণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে।


সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পার্থ প্রতীম ভট্টাচার্য্য
কালের কণ্ঠ : মহাজোটের শরিক দল হিসেবে সাড়ে তিন বছরের শাসনামলকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
হাসানুল হক ইনু : মহাজোট সরকারের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে দেশের অর্থনীতি, প্রশাসন, কৃষি, শিক্ষা এবং রাজনীতি ও প্রশাসন পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অনেক সাফল্য আছে। পাশাপাশি কিছু ব্যর্থতা, কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। মহাজোট সরকার শুধু সরকার বদলের সরকার নয় বা গতানুগতিক সরকার নয়। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা ও অতীতের খালেদা-নিজামীর জোট সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, জঙ্গিবাদী, দলবাজি ও ক্ষমতাবাজির প্রেক্ষাপটে এই সরকার ক্ষমতা নেয়। গত নির্বাচনে জনগণ শুধু সরকার পরিচালনার ম্যান্ডেট দেয়নি, বাংলাদেশকে এই বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বের করে আনারও ম্যান্ডেট দিয়েছে মহাজোট সরকারকে। লুটপাটের মধ্য থেকে দেশকে বের করে এনে সমাজের চাহিদা সম্পৃক্ত করে অর্থনীতিতে নতুন দিনবদলের সূচনা করেছে সরকার। শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে সরকার নতুন দিনের সূচনা করেছে। অর্থনৈতিক মন্দার ভেতরেও প্রচুর জনশক্তি রপ্তানিতেও সরকার সফলতা দেখিয়েছে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী বৃদ্ধি করে সরকার সফলতা দেখিয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সফলতা দেখিয়েছে। খালেদা-নিজামীর সরকার সেভাবে সশন্ত্র জঙ্গিবাদীদের ঘাঁটি তৈরি করেছিল, সেখান থেকে দেশকে মুক্ত করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠন ও আত্মস্বীকৃত যুদ্ধাপরাধীদের গ্রেপ্তার করে সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। সরকারের বর্তমান শাসনামলে কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তি বোমাবাজি করেনি, কোনো শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা হয়নি। এগুলো সরকারের ইতিবাচক দিক।
কালের কণ্ঠ : কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা আছে বলে মনে করেন?
হাসানুল হক ইনু : মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার কাঙ্ক্ষিত সফলতা দেখাতে পারেনি। শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রদের গুণ্ডামি ও অস্থিতিশীলতা সামাল দিতে সরকার চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সরকার এখন গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য স্থায়ী রেশনিং চালু করতে পারে।
কালের কণ্ঠ : বর্তমান মন্ত্রিসভা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
হাসানুল হক ইনু : প্রধানমন্ত্রী তাঁর এখতিয়ার অনুযায়ী পছন্দের মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। তবে তিনি যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন, তাতে যারা ভোট দিয়ে এই সরকার নির্বাচিত করেছে তাদের আকাঙ্ক্ষা এই মন্ত্রিসভা গঠনে পূরণ হয়নি। নির্বাচনী অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা সরকারের মূল দায়িত্ব। সুতরাং নির্বাচনী অঙ্গীকার কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে মন্ত্রিসভার সাফল্য। দক্ষতার সঙ্গে মন্ত্রীরা কাজ করছেন কি না সেটাই দেখার বিষয়। সরকার কিছু মন্ত্রীকে অপসারণ করে প্রমাণ করেছে কিছু মন্ত্রীর অদক্ষতা নিয়ে সরকার নিজেই বিরক্ত।
কালের কণ্ঠ : প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপদেষ্টারা একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিচ্ছেন। এ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
হাসানুল হক ইনু : বিশ্বব্যাংক, গ্রামীণ ব্যাংক, পদ্মা সেতু বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার- এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীদের বা তাঁর দলের নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। একটা চরম সমন্বয়হীনতা বিরাজ করছে সরকারের ভেতরে। এটা সরকারের দুর্বলতার লক্ষণ। আমি আশা করব, সরকার সমন্বয়হীনতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে। প্রধানমন্ত্রীর কথা তাঁর মন্ত্রীরা বুঝছেন না, এ কারণেই এই সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে।
কালের কণ্ঠ : সব সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। কেন এটা করতে হয়, বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?
হাসানুল হক ইনু : অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশ মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার নয়। এটা প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার। মন্ত্রীরা অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নিয়ে দোদুল্যমানতার পরিচয় দেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার প্রধানমন্ত্রীর দিকে ঠেলে দেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকারে যাওয়া উচিত। সেটা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গলজনক। এটা হলে মন্ত্রীরাও দায়িত্ব নিয়ে অনেক কাজ করতে পারবেন।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির কর্মকাণ্ডকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
হাসানুল হক ইনু : বিরোধী দল হিসেবে প্রথম দিন থেকেই দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছে বিএনপি। প্রথম দিন থেকে সংসদের বাইরে অবস্থান নিয়েছে। চলমান কোনো বিষয় নিয়ে বিরোধী দল কোনো গঠনমূলক প্রস্তাব দিতে পারেনি। সাড়ে তিন বছরে জনগণের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো বিষয়ে বা সরকার পরিচালনায় কোনো প্রস্তাবনা দেয়নি বিরোধী দল। খালেদা জিয়া প্রথম দিনে নির্বাচনের ফল মেনে নেননি এবং সরকারকে তিনি বৈধ সরকার মনে করেন না। সে কারণে প্রথম দিন থেকে তিনি সংসদের বাইরে অবস্থান নিয়েছেন। সংসদকে অকার্যকর করতে এবং রাজনীতিকে সংকটের মধ্যে ঠেলে দিতে চান। পুরোটা সময় খালেদা জিয়া সরকারকে অচল অবস্থায় ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বিরোধীদলীয় নেতার কোনো প্রস্তাবনা নেই, শুধু উদ্দেশ্য যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া আটকানো, দুর্নীতিগ্রস্ত ছেলেদের বাঁচানো এবং যেকোনো ছুতোয় সংঘর্ষের রাজনীতি জন্ম দেওয়া।
কালের কণ্ঠ : সম্প্রতি আপনার 'খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করা হবে'- বক্তব্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হয়েছে। আপনার এ ধরনের বক্তব্যের কারণ কী?
হাসানুল হক ইনু : আমি আগেও বলেছি, নির্বাচনী ঐকমত্য হলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে না। গণতন্ত্র নিয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি না হলে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের রাজনীতি বন্ধ হবে না। এই ঐকমত্য অর্জনে খালেদা জিয়াকে এগিয়ে আসতে হবে। সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গ ছাড়ার ঘোষণা দিতে হবে তাঁকে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল না করার ঘোষণা দিতে হবে। আমি সেই পরিপ্রেক্ষিতে বলেছি, হয় খালেদা জিয়া সাম্প্রদায়িকতা ছাড়বেন, না হয় গণতন্ত্রের জন্য খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস হতে হবে। আমি শারীরিক মাইনাসে বিশ্বাস করি না, রাজনীতির মাঠে রাজনীতির চাল দিয়ে খালেদা জিয়াকে সাম্প্রদায়িক শক্তি ছাড়তে বাধ্য করব, না হয় তাঁকে রাজনীতির মাঠ থেকে বিদায় করার সূচনা করব।
কালের কণ্ঠ : এখন অনেকের মুখেই দুই নেত্রীকে মাইনাসের কথা শোনা যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
হাসানুল হক ইনু : যাঁরা দুই নেত্রীর মাইনাস চাচ্ছেন তাঁরা কার্যত গণতন্ত্রকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র করছেন। তাঁরা সাম্প্রদায়িক, যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতির মাঠে টিকিয়ে রাখতে চান। তাঁরা খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে এক পাল্লায় মাপতে চান। কিন্তু শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তির নেতা আর খালেদা জিয়া হচ্ছেন সাম্প্রদায়িক, যুদ্ধাপরাধীদের ঘনিষ্ঠ মিত্র। খালেদা জিয়া যত দিন পর্যন্ত জামায়াতি ও জঙ্গিবাদীদের মিত্র হিসেবে থাকবেন, তত দিন দেশের গণতন্ত্র নিরাপদ নয়। এখন জাতির সামনে প্রশ্ন, বাংলাদেশ কি সামনে আফগানিস্তান, পাকিস্তানের মতো হবে, না আরো গণতন্ত্রের দিকে যাবে। খালেদা জিয়া যদি জঙ্গিদের না ত্যাগ করেন, তাহলে দেশ আবার অন্ধকারে ডুবে যেতে পারে, যা জাতির জন্য ভয়াবহ।
কালের কণ্ঠ : আপনি কি মনে করেন, বর্তমানে দেশের গণতন্ত্রে কোনো হুমকি আছে? থাকলে এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
হাসানুল হক ইনু : দেশের গণতন্ত্রে সংকট অবশ্যই আছে। গণতন্ত্রের গায়ে কিছু আবর্জনা আছে। আমলাতান্ত্রিকতা, দুর্নীতি, দলবাজি, ক্ষমতাবাজির মতো কিছু আবর্জনা আছে। দেশে যে গণতন্ত্র চালু আছে সেটাকে আরো গ্রহণযোগ্য করতে হলে একে আরো অংশগ্রহণমূলক করা দরকার। এর জন্য দরকার সংস্কার। স্থানীয় সরকারগুলোকে আমলা ও এমপিদের প্রভাবমুক্ত করা দরকার। গণতন্ত্রে হুমকি আছে সেটা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক, জঙ্গিবাদী ও যুদ্ধাপরাধী চক্রের হুমকি। এটা আমাদের দেশের একটা সমস্যা। গণতন্ত্রকে প্রথমে নিরাপদ করতে হবে এবং এর গা থেকে আবর্জনা পরিষ্কার করতে হবে।
গণতন্ত্রকে নিরাপদ করতে এবং নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করতে একটা জাতীয় ঐকমত্য দরকার। তেমনি দেশের রাজনীতি থেকে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদ ঝেড়ে ফেলার জন্য ঐকমত্য দরকার। স্বৈরাচার পতনের পর গত ২২ বছর নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকলেও গণতন্ত্র মজবুত হওয়ার পরিবর্তে এটা দুর্বল হয়েছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটেছে এবং এর কাছে গণতন্ত্র জিম্মি হয়ে পড়েছে। বোমাবাজি, খুনের ঘটনা ঘটেছে।
যাঁরা আজ নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার কথা বলেন, তাঁদের বলব, সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদীদের বর্জনের ব্যাপারে ঐকমত্যে আসুন। গণতন্ত্রের গা থেকে ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করতে জাসদ ওয়াশিং মেশিনের ভূমিকা পালন করবে। সরকার যদি এই মেশিনের দায়িত্ব পালন না করে, তবে ঈদের পর থেকে রাজনীতির মাঠ থেকে সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ এবং গণতন্ত্রের গা থেকে দলবাজি, টেন্ডারবাজি দূর করতে জাসদ ওয়াশিং মেশিনের ভূমিকা পালন করবে।
কালের কণ্ঠ : দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কিভাবে এই জটিলতা থেকে উত্তরণ সম্ভব বলে মনে করেন?
হাসানুল হক ইনু : প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়ে প্রমাণ করেছেন সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, এই সরকারব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা যায়। প্রধানমন্ত্রী আহ্বানের মাধ্যমে আলোচনার সদর দরজা খুলে দিয়েছেন। এখন খালেদা জিয়া আলোচনার সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত না নিয়ে প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করার মাধ্যমে সংকট জিইয়ে রাখার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীসহ শরিক দল ও জোট প্রধান আওয়ামী লীগ এবং সংবিধান সংশোধন কমিটির পক্ষ থেকে অনেকবার বিরোধী দলকে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সচেতনভাবে খালেদা জিয়া সংলাপে রাজি হননি। কিভাবে পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সে কথাও বলেননি খালেদা জিয়া। বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল করার জন্য গোঁ ধরেছেন তিনি।
কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি ফিরিয়ে আনা সম্ভব?
হাসানুল হক ইনু : তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা হুবহু পুনর্বহাল সম্ভব নয়। এর অধীনে একটা নির্বাচনও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারে পাঁচটা গুরুত্বপূর্ণ ত্রুটি আছে। সেগুলো হচ্ছে, এই ব্যবস্থায় মেয়াদ নির্দিষ্ট নয়। এই সরকারের আমলে জরুরি আইন জারি করা যাবে কী যাবে না সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই। এই সরকারের মেয়াদে রাষ্ট্রপতি অর্ডিন্যান্স দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইন তৈরি করে ফেলেন। এটা করতে পারেন কি না সেটাও সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা নেই। এই সরকারের প্রধান কে হবেন- সে ব্যাপারে এত বিকল্প থাকায় এটা নিয়ে জাতি সংকটে জড়িয়ে পড়ে এবং নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়। দৈনন্দিন কাজ কী হবে সে ব্যাপারে ব্যাখ্যা নেই। এই ব্যবস্থাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন কোনোভাবেই সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে না। আদালতের রায়ে পরবর্তী দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার কথা বলা হলেও সেখানে বিচার বিভাগকে সম্পৃক্ত না করার কথা বলা হয়েছে। সে হিসেবে খালেদা জিয়া যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানাচ্ছেন, সে দাবির মাথাই নেই।
শেখ হাসিনার সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব আর খালেদা জিয়া যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। এখন এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার সংলাপের মধ্য দিয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। সরকার ও বিরোধী দল সংলাপে বসে একটা সমাধানে পৌঁছানোই ভালো।
উভয়কেই বলব, নির্দলীয় বলেন আর সর্বদলীয় বলেন, সেই সরকারের দৈনন্দিন কাজ কী- সেটা ঠিক করতে হবে। সেই সরকার কি জরুরি আইন জারি করবে, অর্ডিন্যান্স দিয়ে আইন করবে, অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকবে? এই প্রশ্নগুলোর স্থায়ী সমাধান দরকার। না হলে পাঁচ বছর পর পর জাতি বিতর্কে লিপ্ত হবে, গণতন্ত্র দুর্বল হবে।
কালের কণ্ঠ : বিরোধী দল ঘোষণা দিয়েছে ঈদের পর সরকার পতনের আন্দোলনে যাবে; মহাজোট কি প্রস্তুত সেই আন্দোলন মোকাবিলায়?
হাসানুল হক ইনু : রাজনীতির নিয়ম অনুযায়ী বিরোধী দল আন্দোলন করবে। বিরোধী দলকে মোকাবিলা করতে যাওয়া কখনোই উচিত নয়। বিরাজিত সমস্যা সমাধানের কৌশল দেশবাসীর কাছে হাজির করতে হবে সবাই মিলে। বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা সরকারের কাজ নয়।
কালের কণ্ঠ : মহাজোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন? এ ক্ষেত্রে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?
হাসানুল হক ইনু : মহাজোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক চমৎকার। একসঙ্গে ইফতার খাই, মাঝেমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি। কিন্তু রাজনৈতিক সম্পর্ক বেশ শীতল। এটার জন্য মহাজোটের প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ প্রধানত দায়ী। অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে মহাজোটের ঐক্য ধরে রাখতে হবে এবং আরো শক্তিশালী করতে হবে। মহাজোটের বাইরে যেসব অসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আছে তাদের বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে একলা চলার প্রবণতা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উস্কে দেবে। এটা হবে আত্মঘাতী। ২০১৪ সাল অগ্নিপরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় অসাম্প্রদায়িক শক্তি যদি ব্যর্থ হয়, তবে বাংলাদেশ আবারও অন্ধকারে ডুবে যাবে। সুতরাং ঐক্যই কেবল পারে ২০১৪ সালের অগ্নিপরীক্ষায় জয়লাভ করাতে। এ ব্যাপারে ব্যর্থতার কোনো জায়গা নেই।
কালের কণ্ঠ : বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ভালো নয়। বলা হচ্ছে, সে কারণে পদ্মা সেতুর ব্যাপারটাও ঝুলে গেছে। কিভাবে দেখছেন বিষয়টিকে?
হাসানুল হক ইনু : বিশ্বব্যাংক আমাদের দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহযোগী। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে অতীতেও অনেকবার জটিলতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এবার বিরোধটা জনসমক্ষে বেশি প্রচারিত হচ্ছে। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে টাকা বন্ধ করে দেওয়াটা দুঃখজনক। এটা বিশ্বব্যাংক ঠিক করেনি। যে অভিযোগ, তা নিষ্পত্তির জন্য সরকার চেষ্টা চালাচ্ছে। সে রকম অবস্থায় হঠাৎ করে টাকা বন্ধ করে দেওয়া অনভিপ্রেত। এটা ভালো লক্ষণ নয়। আমার সন্দেহ হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের এই অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনীতি কাজ করছে কি না। অন্যদিকে সরকার বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে যেভাবে, যে ভাষায় অবস্থান নিয়েছে, সেটাও ভবিষ্যতে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার জন্য মঙ্গলজনক নয়। আমি মনে করি, সরকারের উচিত বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা। পদ্মা সেতু নিজের টাকায় করি আর বিশ্বব্যাংকের টাকায় করি- এ ব্যাপারে কোনো দুর্নীতি গ্রহণযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে আমরা স্বচ্ছতা চাই, জবাবদিহিতা চাই। আবুল হোসেনের অপসারণের মধ্য দিয়ে সরকার প্রকারান্তরে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির প্রাথমিক অভিযোগ স্বীকার করে নিয়েছে। তারপর আবুল হোসেনকে সার্টিফিকেট প্রদান করাটা সরকারের উচিত হয়নি।
কালের কণ্ঠ : বিভিন্ন সময়ে সরকারের কাজে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা তাদের আশঙ্কা বা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আপনি কি মনে করেন এভাবে বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারেন?
হাসানুল হক ইনু : এখন পর্যন্ত আমেরিকা বা ইউরোপ রাজনীতির ব্যাপারে মন্তব্য করেনি। সুতরাং এটা সরকারের বন্ধুহীনতা প্রমাণ করে না। দূতাবাসগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কিছু সন্তোষ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তার সব কিছু ঠিক বলে মনে করি না। অর্থনৈতিক লেনদেনে অনেক সমস্যা হতে পারে। কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকার দূতাবাসগুলোর বক্তব্য-বিবৃতি কূটনৈতিক শালীনতার বাইরে হয়ে যাচ্ছে। আমরা বন্ধুত্ব চাই, তবে কারো খবরদারি চাই না।
কালের কণ্ঠ : প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন?
হাসানুল হক ইনু : প্রতিবেশীদের সঙ্গে শত্রু-শত্রু খেলার পররাষ্ট্রনীতি অচল। সমতার ভিত্তিতে প্রতিবেশীদের জন্য সদর দরজা খুলে দিতে হবে। এই পথের মধ্যে কিছু বাধা আছে। এই বাধা অপসারণের মূল দায়িত্ব দিলি্ল সরকারের। তিস্তাসহ ভারত থেকে প্রবাহিত সব নদীর পানি সমতার ভিত্তিতে বণ্টনের সমাধান করতে হবে। একতরফা টিপাইমুখ বাঁধ না দেওয়া এবং সীমান্তে সাধারণ বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি না করার ইতিবাচক সমাধান প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কে বিরাট ভূমিকা রাখবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ও ভারত, উভয় পক্ষের রক্ত ঝরেছে। উভয় পক্ষের রক্তের ঋণ শোধ করার দায়দায়িত্ব রয়েছে। এই ঋণ পরিশোধ করতে পারি বন্ধুত্বের সুদৃঢ় বন্ধনের মাধ্যমে।
কালের কণ্ঠ : বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হয়েছেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি ও গার্মেন্ট শ্রমিক নেতা আমিনুল খুন হয়েছেন। এসব ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগকে কি যথেষ্ট মনে করেন?
হাসানুল হক ইনু : গুম, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার- এগুলো গণতন্ত্রে অচল। এর সঙ্গে যারা জড়িত, আজ হোক কাল হোক তারা বিচারের সম্মুখীন হবেই। ইলিয়াস আলী, সাগর-রুনির বিষয়ে জাতিকে সঠিক তথ্য জানানোর দায়িত্ব সরকারের। আজ অবধি সে ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো বক্তব্য না দেওয়াটা সরকারের সীমাহীন প্রশাসনিক ব্যর্থতা। এসব বিষয়ে যারা জড়িত তাদের মুখোশ উন্মোচন কি সরকার করতে পারছে না, না করতে চাইছে না- এ ব্যাপারে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সে বিভ্রান্তি দূর করার দায়িত্ব সরকারের। যে দেশে দীর্ঘদিন পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়, সাজা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়; সে দেশে কোনো অপরাধই বিচার ছাড়া থাকবে না। এসব ব্যাপারে আজ হোক আর কাল হোক দেশবাসী সঠিক তথ্য জানবেই। যে দেশে প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর ছেলেদের বিরুদ্ধে মামলা হয়, প্রধানমন্ত্রীকে আদালতে হাজিরা দিতে হয়; সে দেশে ক্রসফায়ারের সঙ্গে জড়িত প্রশাসনের কর্মকর্তারা রেহাই পাবে না। বর্তমান সরকারের আমলেও যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদেরও বিচার ভবিষ্যতে হবে।
কালের কণ্ঠ : শেয়ারবাজার নিয়ে এক-দেড় বছর ধরে আন্দোলন করছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। আপনার কি মনে হয় সরকার বিনিয়োগকারীদের ব্যাপারে যথেষ্ট আন্তরিক?
হাসানুল হক ইনু : শেয়ারবাজার নিয়ে সরকার ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা ও ব্যর্থতা রয়েছে। তার চেয়ে বড় কথা, শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় সরকারের সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শেয়ারবাজার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, সে সিদ্ধান্তগুলোও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। আবার শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। শেয়ারবাজারে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে কেলেঙ্কারির হোতাদের প্রথমে গ্রেপ্তার করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
হাসানুল হক ইনু : আপনাকে ও কালের কণ্ঠ পরিবারকে ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.