যারা আছেন হৃদয়পটে by ফকির আলমগীর

হৃদয়ের খুব কাছের মানুষ তারেক মাসুদ চলে গেলেন এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় গেল বছর (২০১১) ১৩ আগস্ট শনিবার। মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব মিশুক মনীরকেও আমরা হারাই একই দুর্ঘটনায়। যে কোন মৃত্যুই বেদনাদায়ক, শোকের। কিন্তু তাদের মাসুদ ও মিশুক মুনীরদের মতো প্রতিভাবান মানুষদের মৃত্যু এক অপূরণীয় ক্ষতি। আন্তর্জাতিক


খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা-পথিকৃৎ তারেক মাসুদ চলে গেলেন বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিয়ে, বিশাল ক্যানভাসে যে স্বপ্ন এঁকেছিলেন তা অপূর্ণই রয়ে গেল। বহু আরদ্ধ কর্ম ফেলে তার চলে যাওয়া কখনই মেনে নেয়া যায় না। তাই তো তার মৃত্যুতে কেঁদেছে বাংলাদেশ, কেঁদেছে শহিদ মিনার, কেঁদেছে ঢাকা, কেঁদেছে ভাঙ্গা, কেঁদেছে নূরপুর, কেঁদেছে তার প্রিয় কুমার নদের তীরঘেঁষা জনবসতি। একদিন কুমারগঞ্জের ছায়া সুনিবিড় জনপদেই যে মানুষটি বেড়ে উঠেছিলেন। মেঠো পথ, সবুজ পল্লবঘন শান্তশ্রীম-িত নদীর তীর। গ্রামের পথ বেয়ে হেঁটে চলা পথিক কিংবা পাখির কূজন, নদীর সৌন্দর্য যাকে অভিভূত করেছিল। সেই মানুষটি এমন অকালে, অসময়ে চলে যাবেন, কেউ ভাবতেই পারেনি। আমি ছবির লোক নই, তারপরও মুক্তিযুদ্ধের ছবির নির্মাতা হিসেবে তারেক মাসুদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা ছিল। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা হলে কথা হতো, শুভেচ্ছা বিনিময় হতো একই এলাকার সন্তান হিসেবে, একে অপরের প্রতি টান ছিল। তবে তার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর হলো মৃত্যুর পূর্বে ঢাকাস্থ ভাঙ্গা উপজেলা সমিতির উপদেষ্টা কমিটিতে তার যোগদানের পর। এক্ষেত্রে ভাঙ্গা উপজেলা সমিতির ফরিদউদ্দিন আহমেদ, কামাল আহমেদের সক্রিয় সহযোগিতায় তারেক মাসুদ সমিতির কর্মকা-ে সক্রিয় হয়্ কখনও সমিতির অভিষেক অনুষ্ঠান, ইফতার পার্টি কিংবা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে দেখা হতো, কথা হতো। এ আনন্দ আড্ডায় সাবেক এমপি, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বর্তমান এমপি প্রকৌশলী নিলুফার জাফরউল্লাহ, সাংবাদিক মঞ্জু ভাই, অধ্যাপক কামাল আতাউর রহমান, ওয়াদুদ ভূঁইয়া, মোশারফ হোসেন, ফকির সিরাজসহ অনেকে তারেক মাসুদের উজ্জ্বল উপস্থিতি বেশ উপভোগ করত। এলাকার উন্নয়ন-অগ্রগতিতে তার অংশগ্রহণ, আগ্রহ-উৎসাহ সবাইকে অনুপ্রাণিত করত, সরল, সহজ মানুষটির উপস্থিতি দেখে মনেই হতো না তিনি এত বড় চলচ্চিত্র নির্মাতা।
এসব অনুষ্ঠানে ভাঙ্গা উপজেলা সমিতির কর্মকা- ছাড়াও তারেক মাসুদের রানওয়ে ছবির প্রসঙ্গে কিংবা কুমার নদে নৌকা বাইচের আয়োজনের ব্যাপারে অনেক কথা হতো। এমনিতেও ভাঙ্গার বিশ্বকর্মা পুজার দিনে অনুষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ লোকপ্রিয়। শৈশবের নৌকা বাইচ ছিল তার রক্তের সঙ্গে মিশে। তাই তো তার নির্মিত অনেক ছবিতে ভাঙ্গার নৌকা বাইচের দৃশ্য আমাদের আনন্দিত করত। এমনিতেই তারেক মাসুদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রস্ফুটিত ফসল। তাই মুক্তিযুদ্ধ, দেশ, জনগণ এবং লোকজ সংস্কৃতি, যা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল উত্তরাধিকার, তারই সরল উপস্থাপনা করে যাচ্ছিলেন যে নির্মাতা তার আকস্মিক দুর্ঘটনায় মৃত্যু সেই অভিযাত্রাকেই থামিয়ে দিল। তার মৃত্যুতে যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো দেশ-জাতি কিভাবে তা পূরণ করবে সে কথাই আজ ভাবছি। একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে তার নির্মিত মুক্তির গান, মু্িক্তর কথা, মাটির ময়না, নরসুন্দর নামের ছবিগুলোর সঙ্গে সেই সঙ্গে তারেক মাসুদের কাজের সঙ্গে একটি অলিখিত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একদিকে একই এলাকার সন্তান হিসেবে অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা আমাকে গর্বিত করত। তার জন্য আমাদের অহংকর হতো। আজ সে কেবলই স্মৃতি, আর তাকে দেখা যাবে না স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদকে নিয়ে কোন অনুষ্ঠানে, চিরনিন্দ্রায় শায়িত হয়েছেন তার স্মৃতিঘেরা গ্রাম ভাঙ্গার নূরপুরে বাবার কবরের পাশে। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তিনি জানান দিয়ে গেলেন যে জনপদের আলো-বাতাসে তিনি বড় হয়েছেন সেখানেই তার জীবনের শেষ ঠিকানা। চিরায়ত বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যম-িত নূরপুরের মাটি ধন্য হলো এমন একজন কালজয়ী চলচ্চিত্রকারকে বুকে ঠাঁই দিয়ে। এক সময় সে ছিল ভাঙ্গার সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে অগ্রণীর ভূমিকায়। ফুটবল, নাটক, যাত্রা, জারিগান, কবিগান, সার্কাস, নৌকা বাইচ অথবা ওয়াজ ও বাতাসে মুখরিত ভাঙ্গার উচ্ছল জীবনের পরিবেশে যিনি বেড়ে উঠেছিলেন, তার নীরব প্রস্থান আমাদের ভাবায়, কাঁদায়। হালিম বয়াতী, হাজেরা বিবির বিচারগান, লক্ষণ দাসের সার্কাস, রূপবান যাত্রা, ছিলাধরচর ও সোনা খোলার আড়ং, হোগলা গাজির গরু দৌড়, নূরপুরের হাজরাহাটির ঘোড়া দৌড়, আশ্বিনের নৌকা বাইচ, গাজির বটতলা, ঈদগাহের ওয়াজ আর কীর্তনের আসর যাকে শৈশব-কৈশোরে প্রভাবিত করত সে আজ অনেক দূরে।
ফিরে এলো তার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী স্মৃতি সংসদ থেকে ভাস্কর্য উদ্বোধন হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর নূরপুরে ফুলে ফুলে ঢেকে যাবে তার কবর। কাঁদবে এলাকাবাসী, কাঁদবে কুমার নদ, কাঁদবে মাটির ময়নার সাথীরা।মিশুক মুনীরের জন্যও কাঁদতে তার সতীর্থরা। লেখক : গণসঙ্গীত শিল্পী

No comments

Powered by Blogger.