ঐতিহ্য রক্ষা নয়, কেবলি টাকা কামানোর বাহন by আশরাফুল ইসলাম

ঘোড়ার গাড়ি। বহু শতাব্দী আগের ঐতিহ্যবাহী ও রাজকীয় এ যানবাহনের ব্যবহার বিশ্বজুড়ে এখনো সমাদৃত। তবে বাংলাদেশে এখন ঐতিহ্য রক্ষার নামে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার হয় কেবল অর্থ কামানোর হাতিয়ার হিসেবে। ঘোড়ার প্রতি চরম নির্দয়তার পরিচয় দিয়ে সক্ষমতার চেয়ে বহুগুণ বেশি যাত্রী পরিবহন করা হয় ঘোড়ার টমটম বলে পরিচিত এসব ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে।

যন্ত্রের প্রবল দাপটের যুগেও বিশ্বের বহু দেশে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার এখনো টিকে রয়েছে সৌখিনদের প্রমোদ ভ্রমণের প্রয়োজনে। বহু যুগ আগে রাজা-বাদশাহ ও ধণাঢ্য বণিকরা ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করলেও ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এখনো পৃথিবীর বহু দেশে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এই ঘোড়ার গাড়ি।
কিন্তু প্রাণী অধিকার সচেতন বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের মতো সচেতন নন আমাদের দেশের মানুষ। এখানে ঐতিহ্য রক্ষার নামে ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহার হয় কেবলমাত্র অর্থ কামানোর হাতিয়ার হিসেবে। ঘোড়ার প্রতি চরম নির্দয়তার পরিচয় দিয়ে সক্ষমতার চেয়ে বহুগুণ বেশি যাত্রী পরিবহন করা হয় এসব ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে ঘোড়ার গাড়িতে মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের দৃশ্য চোখে পড়লেও নির্দয়তার বড় দৃশ্যটি চোখে পড়বে রাজধানীর পুরান ঢাকায়।

টানা কয়েক দিন বাংলানিউজের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, রাজধানীর গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত চলাচল করছে কমপক্ষে ৪০টি ঘোড়ার গাড়ি বা টমটম। এসব গাড়ি চালাতে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রায় ১শ’ ঘোড়া।

মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের কারণে এসব ঘোড়ার বেশির ভাগই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। একসময়কার সুঠাম দেহের ঘোড়াগুলোর বেশির ভাগের দেহই এখন কঙ্কালসার। রাজধানীর সবচেয়ে ব্যস্ত যানজটময় সড়কে চলাচলের কারণে রিকশা ও অন্যান্য গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা-ঘষা লেগে ঘোড়াগুলোর শরীরের বিভিন্ন অংশের চামড়াও উঠে গেছে। বিরামহীনভাবে ১৫/২০ জন করে যাত্রী আনা-নেওয়ার ফলে বেশির ভাগ ঘোড়ার পায়ে সৃষ্টি হয়েছে ক্ষতের।

এতো শারীরিক ধকল সহ্য করার পরও প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসা না পাওয়ার ফলে ক্রমাগত নির্জীব হয়ে পড়ছে ঘোড়াগুলো। ফলে প্রচণ্ড শারীরিক সক্ষমতা সম্পন্ন এই প্রাণীও ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। সাম্প্রতিক সময়ে পুরান ঢাকায়  যাত্রী বহনকারী এই ঘোড়াদের কয়েকটির অকাল মৃত্যু ঘটছে বলেও অনুসন্ধানে জানা গেছে।

গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পর্যন্ত ঘোড়ার গাড়িতে (টমটমে)  ভ্রমণ করে ঘোড়াগুলোর প্রতি এর চালকসহ সংশ্লিষ্টদের নানা নিষ্ঠুর আচরণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ওই সড়কে চলাচলকারী নিশি টমটমের কোচোয়ান (চালক) শুক্কুর আলী (২২) প্রায় এক যুগ ধরে ঘোড়ার গাড়ি চালাচ্ছেন। তার সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে অবলা প্রাণীদের নিগ্রহের অনেক কথাই।

শুক্কুর আলীর তথ্যমতে, প্রতিদিন ভোরে খাবার খাইয়ে ঘোড়াদের গাড়িতে জুড়ে কোচোয়ান বের হন যাত্রী পরিবহনের জন্য। কোনো দিন রাত ৮টা, আবার কোনো দিন ১০টাও বেজে যায় ওদের নিয়ে তাদের আবাসে ফিরতে। দিনের বেলায় কখনো সামান্য পানি খাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়, আবার কখনো বা তাও দেওয়া হয় না। একটানা চলে যাত্রী পরিবহন।

নিশি টমটমের হেলপার রবি (১২) বলেছে, ‘‘অনেক সময় ব্যথা করলে ঘোড়াগুলান পাও(পা) উডাইয়া ইশারা করে। তখন পাও টিইপ্পা দেই। মাসখানিক আগে গাড়ির মালিক জাকিরের লাল ঘোড়া বাবু কয়েকদিন রোগে ভোইগ্যা পেট ফুইল্যা মইরা গেছে। কয়দিন কিচ্ছু খায় নাই, পায়খানাও করে নাই।’’

সদরঘাট ঘোড়ার টমটম স্ট্যান্ডে বেশ কয়েক জন কোচোয়ানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর আগেও রোগে ভুগে কয়েকটি ঘোড়া মারা গেছে।

সপ্তাহে একদিন বন্ধ থাকলেও অনেক সময় বন্ধের দিনও গাড়ি চালাতে হয় বলে জানান কোচোয়ান শুক্কুর আলী।

পুরান ঢাকায় চলাচলকারী ৩৫-৪০টি ঘোড়ার টমটমের মালিক ১০-১২ জন মালিক। ঘোড়ার গাড়ি মালিক সমিতি নামে একটি সংগঠনও রয়েছে তাদের। এই সংগঠনের সভাপতি নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজের কাছে ঘোড়াদের দিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহনের বিষয়ে বলেন, ‘‘চালকদের বেশি যাত্রী তুলতে নিষেধ করা আছে। তারপরও এরা (কোচোয়ান) চুরি করে। মাঝে মধ্যে মারধরও করি।’’

কতোজন যাত্রী পরিবহন করা উচিৎ জানাতে চাইলে তিনি জানান, ৮/১০ জন যাত্রী সহজেই নিতে পারে। তবে অসুস্থ হলে ঘোড়াকে পশু হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসাও করা হয়। 

প্রতিদিন গড়ে একটি গাড়ি ৫/৬ বার গুলিস্তান-সদরঘাট আসা-যাওয়া করে থাকে। একটি টমটম দিনে ৩ হাজার থেকে ৩৫শ’ টাকা পর্যন্ত ভাড়া পায়, কখনো বা তারও বেশি। কোচোয়ানের হাজিরা দিনে ৩শ’ টাকা, হেলপারের ১শ’ টাকা। এর বাইরে খাওয়ার টাকাও দেওয়া হয় তাদের।

লোহার ও স্টিলে তৈরি দুই ধরনের ঘোড়ার টমটম রয়েছে পুরান ঢাকায়। এক জোড়া ঘোড়াসহ একটি গাড়ির দাম আড়াই লাখ থেকে চার লাখ টাকা পর্যন্ত। যাত্রী পরিবহন ছাড়াও ঘোড়ার টমটম ব্যবহৃত হয় বিয়ে, পূজা, বিভিন্ন দিবসের শোভাযাত্রায়, সিনেমার শ্যুটিং ইত্যাদি কাজে। এসব কাজে টমটমকে ফুল দিয়ে সুসজ্জিত করে সাজানো হয়। কোচোয়ান ও হেলপারের জন্যও ওইসব অনুষ্ঠানের সময় রয়েছে বিশেষ পোশাক। ঢাকার বাইরে একদিনের জন্য টমটমের ভাড়া ৮ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত।

ঘোড়াদের দিয়ে যাত্রী পরিবহনে ঝুঁকি, খাদ্য, বাসস্থান ও চিকিৎসা প্রসঙ্গে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অনুষদের ডিন অধ্যাপক গৌতম বুদ্ধ দাস। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশে এনিম্যাল ওয়েলফেয়ার বলতে কিছু নেই। অন্য দেশে প্রাণীদের ওপর এমন নির্দয় আচরণ করা হলে তার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হতো দায়ীদের। আমি মনে করি, ঘোড়াদের ক্ষেত্রে প্রাণী অধিকার পুরোপুরি খর্ব করা হচ্ছে।’’

তিনি আরো বলেন, এই ঘোড়াদের যে পরিমাণ খাদ্যের চাহিদা রয়েছে, তার চার ভাগের এক ভাগও এরা পাচ্ছে না। দৈনিক একটি ঘোড়ার তার দেহের ওজনের ৬-৮ শতাংশ খাদ্য গ্রহণ করা উচিৎ। এদের দিয়ে ৪/৫ জনের বেশি যাত্রী বহন করানো কোনো ভাবেই উচিৎ নয়। এদের ছোলা, গম, ভুট্টা ইত্যাদি উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য খাওয়ানো উচিৎ। একই সঙ্গে ১৫/২০ দিন অন্তর এদের নিয়মিত পশু হাসপাতালে নিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো অবশ্যই উচিৎ।’’

অবিলম্বে বাংলাদেশে এনিম্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাক্ট তৈরিরও আহ্বান জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও ওয়াইল্ডলাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ‘‘আমাদের দেশে মানবাধিকারের জায়গাটিতেই এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে। সেখানে প্রাণীদের অধিকারের বিষয়টিতে স্বাভাবিকভাবেই আমরা পিছিয়ে। একটা সময় ছিল, যখন গ্রামে সব পশুদের সঙ্গে একত্রে মানুষ বসবাস করতো। বর্তমানে প্রাণীদের প্রতি মানবিকতার জায়গাটি সেভাবে তৈরি হচ্ছে না।’’


তিনি বলেন, যান্ত্রিক যুগে পশুদের ব্যবহারের প্রয়োজন কমে গেছে। অনেক দেশে পশুদের দিয়ে এসব কাজ করানোকে নিরূৎসাহিত করা হচ্ছে। ঐতিহ্য রক্ষার মানে এই নয় যে, প্রাণীদের কষ্ট দেওয়া।

অবিলম্বে ঐতিহ্য রক্ষার নামে ঘোড়াদের ওপর নির্দয় আচরণ বন্ধের দাবিও জানান এই প্রাণীবিদ।

বিষয়টি নিয়ে ঢাকার জেলা প্রশাসক মোঃ মুহিবুল হকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি অভিযোগের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, ‘‘এটি আমাকেও খুব কষ্ট দেয়। বিষয়টি সত্যিই খুব অমানবিক। ঈদের পর ঘোড়ার গাড়ির মালিক ও চালকদের ডেকে এনে সহনীয় মাত্রায় যাত্রী পরিবহন করতে ও এদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য নির্দেশ দেবো।’’

বিষয়টি নিয়মিত নজরদারি করা হবে বলেও জানান জেলা প্রশাসক।

উল্লেখ্য, অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের প্রথমদিকে ঢাকা শহরে বসবাস শুরু করে আর্মেনিয় সম্প্রদায়। ঢাকায় তাদের অনেকেরই জমিদারি ছিল। কেউবা আবার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লবণ উৎপাদন ও বিপণন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আর্মেনিয়রা তাদের বিভিন্ন ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছিলেন। আর্মেনিয় ব্যবসায়ী সিরকো ১৮৫৬ সালে প্রথম ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন করেছিলেন। তখনকার ‘ঠিকা গাড়ি’ নামে প্রচলিত এই গাড়ি ঢাকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ধীরে ধীরে এটি ঢাকার প্রধান যানবাহন হয়ে ওঠে।

No comments

Powered by Blogger.