ঈদ বকশিশের নামে পরিবহন সেক্টরে তোলাবাজি ॥ বেপরোয়া চাঁদাবাজি- ০ মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, পুলিশ থেকে শুরু করে নানান নামে টাকা উঠানো হচ্ছে সব টার্মিনালেই -০ পিচ্চি হেলালের জেল খরচ ও মামলা চালানোর নামে গাড়িপ্রতি ৪শ’ টাকা তোলা হচ্ছে by রাজন ভট্টাচার্য

ঈদ বকশিশের নামে সারাদেশে পরিবহন সেক্টরে চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়ন, পুলিশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নামে চলছে অর্থ আদায়। নিজেদের ইচ্ছামতো সড়ক-মহাসড়কসহ টার্মিনালের বিভিন্ন পয়েন্টে ‘তোলা’ উঠছে। চাঁদা না দিলে মালিকদের দেয়া হচ্ছে হত্যার হুমকি।


কখনও গাড়ি বন্ধ করে দেয়া, ভাংচুরসহ নানাভাবে হয়রানিও করা হচ্ছে মালিকদের। সপ্তাহে সপ্তাহে কৌশল পরিবর্তন করেও চলছে চাঁদাবাজি। এ কারণে অতিষ্ঠ পরিবহন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেও প্রতিকার মিলছে না। রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় অন্তত ৩০ পয়েন্টে চাঁদাবাজি চলছে। জেলে থাকা তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলালের নাম করে মোহাম্মদপুরে প্রতিদিন গাড়িপ্রতি নেয়া হচ্ছে ৪শ’ টাকা। হেলালের জেল খরচ ও মামলা পরিচালনার নামে এই চাঁদা তোলা হচ্ছে। এছাড়া টঙ্গী, সাভার, গাবতলী, বাইপাইল, শিমরাইল, তারাবÑ এ সব পয়েন্টে চাঁদাবাজি সবচেয়ে বেশি চলছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে ঈদ বকশিশের নামে চাঁদাবাজির কথা স্বীকার করে জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের। মালিক বা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দেশের কোথাও পরিবহন চাঁদাবাজি হচ্ছে নাÑ এমন দাবি করে তিনি বলেন, সিলেট রুটের শিমরাইল, নারায়ণগঞ্জের রুট, মুন্সীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন রুটে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা চাঁদা আদায় করছে। আমি মনে করি এ ব্যাপারে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন ইচ্ছা করলেই চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারে। এতে যাত্রী হয়রানি হ্রাসের পাশাপাশি পরিবহন মালিক শ্রমিকরা নিরাপদে গাড়ি চালাতে পারবে।
বাংলাদেশ বাস-ট্রাক এ্যাসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ জনকণ্ঠকে জানান, ঈদ খরচের নামে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদাবাজি হচ্ছে। নিজেদের সুবিধামতো চাঁদা তোলা হচ্ছে যানবাহন থেকে। তবে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন।

নানা কায়দায় বরিশালে চাঁদাবাজি
বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন রুটে চাঁদাবাজি বেড়েছে। নানা কায়দায় চলছে চাঁদা আদায়। বার বার কৌশল পরিবর্তন করছে চাঁদাবাজরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির বরিশাল অঞ্চলের এক শীর্ষ নেতা জানান, পটুয়াখালী-বরিশালের মাঝখানে লেবুখালীতে যানবাহন সিরিয়ালের নামে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে। কখনও গাড়িপ্রতি ২০ টাকা, কখনওবা তাদের ইচ্ছামতো চাঁদা আদায়ের অভিযোগ করেন তিনি। এছাড়া বাকেরগঞ্জ সেতুতে গাড়িপ্রতি ৫০ টাকা চাঁদা নেয়া হচ্ছে। আবদুর রব সেরনিয়াবাত সেতুতে গাড়িপ্রতি নেয়া হচ্ছে ২২০ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী টার্মিনাল ফি টার্মিনালেই নেয়ার কথা। কিন্তু নিয়ম ভঙ্গ করে জোরপূর্বক টার্মিনালের বাইরে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ করেন তিনি।
এই অঞ্চলের বিভিন্ন শ্রমিক ইউনিয়নের নামে মাসুদ খান, টিটুসহ আরও কয়েকজন প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করছে। সুলতান মাহামুদ নামে এক প্রভাবশালীর নেতৃত্বে এই চাঁদা তোলা হচ্ছে। ঈদ সামনে রেখে চাঁদাবাজির কারণে মালিকরা অতিষ্ঠ। প্রশাসনের কাছে বার বার অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার মেলেনি। জেলা আইনশৃঙ্খলা বৈঠকে এ সব বিষয় উত্থাপন করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

পিচ্চি হেলালের নামে মোহাম্মদপুরে চাঁদাবাজি
সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলাল এখন কাশিমপুর কারাগারে। কিন্তু তাঁর নামে চাঁদাবাজি বন্ধ নেই। বেপরোয়া চাঁদাবাজি চলছে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায়। পরিবহন মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বলছেন, মোহাম্মদপুর থেকে বিভিন্ন রুটে প্রায় ২২৫টি লেগুনা চলছে। এসব গাড়ি থেকে দিনে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। ৬১টি মিনিবাস মোহাম্মদপুর থেকে কাঁচপুর ব্রিজ পর্যন্ত প্রতিদিন যাতায়াত করছে। এসব গাড়ি থেকে দিনে ৫শ’ থেকে ৬শ’ টাকা চাঁদা নেয়া হচ্ছে। মোহাম্মদপুর বাস টার্মিনাল থেকে মাসে ২৫-২৭ লাখ টাকা চাঁদা নেয়ার অভিযোগ করেন মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ।
সম্প্রতি এই এলাকায় চাঁদাবাজি রোধে মোহাম্মদপুর লেগুনা ও মিনিবাস মালিক-শ্রমিকদের পক্ষে র‌্যাব-২ বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন তৌফিকুল ইসলাম অপু। অভিযোগে বলা হয়, পিচ্চি হেলালের জেল খরচ, কোর্ট অর্থাৎ মামলা পরিচালনা ব্যয়ের নাম করে গাড়িপ্রতি জোর করে ১শ’ থেকে ২শ’ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। হেলালের পক্ষে চাঁদাবাজির মূলহোতা তথাকথিত পরিবহন নেতা সেলিম। কেউ যদি চাঁদা দিতে অস্বীকার করেন তাহলে তাকে হত্যার হুমকি, রাস্তায় গাড়ি ভাংচুর, বিভিন্ন রুটে জোর করে গাড়ি বন্ধ করে দেয়া হয়। এছাড়াও সার্জেন্ট টিআইদের মাধ্যমে গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠিয়ে দেয়াসহ আর্থিক ও মানসিকভাবে হয়রানির চেষ্টা করা হচ্ছে।
র‌্যাবের কাছে লিখিত অভিযোগে বলা হয়, রাশেদীন খান সেলিম ওরফে টোকাই সেলিম হিসেবে সে এলাকায় পরিচিত। মোহাম্মপুরে চাঁদা তুললেও সে বাসবাস করে শেওড়াপাড়া এলাকায়। ১৯৯৯ সালে ১২ নম্বর রুটের শ্রমিক নেতা সাব্বির হোসেনকে দিনের বেলায় বাসটার্মিনালে গুলি করে হত্যা করে। পরবর্তীতে সে বাসটার্মিনাল দখল করে চাঁদাবাজি শুরু করে। ২০০০ সালে মিরপুর থানা পুলিশের হাতে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হয় সে। ২০০৩ ও ০০০৬ সালে বিভিন্ন অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেলিমের সহযোগী চাঁদাবাজদের মধ্যে রয়েছেÑ শহীদুজ্জামান, বাবু, দবির, কলোনির টিপু, মাউরা লাল্লা, ওয়াহিদুজ্জামান, আব্দুল মান্নানসহ অনেকে। মোহাম্মদপুরের পরিবহন মালিক মোঃ শহীদ মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী পিচ্চি হেলাল জেলাখানায় থেকে পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছে। তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে আমরা অসহায়। সে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব তারেক জিয়ার বন্ধু হিসেবেও এলাকায় পরিচিত। চাঁদাবাজি দমনে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানান তিনি।

শিমরাইলে চাঁদাবাজি থামেনি
টাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইলে পরিবহন চাঁদাবাজি থামেনি। ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় দেড় হাজার বাস থেকে বেপরোয়াভাবে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন সায়েদাবাদ পরিবহন মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ। নারায়ণগঞ্জের শিমরাইল পয়েন্টে বিভিন্ন ভূুইফোঁড় সংগঠনের নামে বাসপ্রতি আদায় করা হচ্ছে ৫০-২শ’ টাকা পর্যন্ত। মাসে চাঁদাবাজি হচ্ছে দেড় কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হোসেন চেয়ারম্যান এই চাঁদাবাজির মূলহোতা। সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খায়রুল আলম মোল্লা জানান, পুলিশের সহযোগিতায় এই পয়েন্টে চাঁদাবাজি হচ্ছে। এদিকে রবিবার শিমরাইল পয়েন্টে চাঁদাবাজির সময় কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বলছেন, কাউন্টার থেকে বিভিন্ন সংগঠনের নামে এখন চাঁদা তোলা হচ্ছে।

তারাবতে বাসপ্রতি ৩শ’ টাকা
তারাবতে গাড়িপ্রতি ৩শ’ টাকা করে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন পরিবহন মালিকসহ শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। তাঁরা বলছেন, চলন্ত অবস্থায় চালকদের মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু অনেক চালক মোবাইল ব্যবহার করছেন দিনের পর দিন। তাই ঈদ সামনে রেখে ভিন্ন অজুহাতে এই পয়েন্টে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। প্রভাবশালী এই চাঁদাবাজ চক্রের অযুহাত মোবাইল ব্যবহার করলে চাঁদা বাধ্যতামূলক। বাংলাদেশ বিপ্লবী সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা মোঃ আলী রেজা জনকণ্ঠকে জানান, সায়েদাবাদ পরিবহন মালিক সমিতির নামে এই চাঁদা তোলা হচ্ছে। চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিচ্ছেন টার্মিনাল শ্রমিক ইউনিয়নের এক শীর্ষ নেতা। দেলোয়ার হোসেন দিলু, মজিদ, মিজান, সাঈদসহ আরও কয়েকজন তারাব এলাকায় নিয়মিত চাঁদা তুলছেন।
মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ জনকণ্ঠকে বলেন, টঙ্গী ব্রিজসহ কয়েকটি পয়েন্টে বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি হলেও এখন নিযন্ত্রণে এসেছে। টঙ্গী ব্রিজ এলাকা থেকে পুলিশ কয়েক চাঁদাবাজকে গ্রেফতার করেছে। তবে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নামে কোন চাঁদাবাজি হচ্ছে না। তিনি জানান, ঈদ আসন্ন। তবে টার্মিনালে যাত্রী নেই। রবিবার বৃষ্টির কারণে একেবারেই যাত্রী ছিল না। সোমবারও তুলনামূলক যাত্রী কম। যাত্রী সঙ্কটের কারণে অনেক বাস চালানো হচ্ছে না।
চট্টগ্রামের বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির কার্যকরী সভাপতি কফিল উদ্দিন আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, প্রায় ৬০ রুটে দিন ৭শ’-৮শ’ গাড়ি প্রতিদিন বিভিন্ন প্রান্তে ছেড়ে যাচ্ছে। এসব সড়কের কোথাও অযাচিত কোন চাঁদাবাজির ঘটনা নেই। অর্থাৎ মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নির্ধারিত চাঁদার বাইরে কোথাও কোন চাঁদাবাজি হচ্ছে না। কলারম্যানদের চালকরা খুশি হয়ে যা বকশিশ দিচ্ছে, তারা তাই গ্রহণ করছে। এই টাকা চাঁদাবাজির মধ্যে পড়ে না।
যশোর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির অতিরিক্ত মহাসচিব আলী আকবর জানান, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ঘাটে চাঁদাবাজি হলেও এখন তুলনামূলক কম। মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের আন্দোলনের মুখে বলতে গেলে এখন চাঁদা তোলা প্রায় বন্ধ। এছাড়া যশোর অঞ্চলে ব্যাপক চাঁদাবাজির কোন ঘটনা নেই।

No comments

Powered by Blogger.