চরাচর-আলো ছড়ানো বোমাবাতি by ফাহমিদা আক্তার রিম্পি

'কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি/ শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি/ মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল স্বামী/ আমার যেটুকু সাধ্য, করিব তা আমি।' কবিগুরুর কী অসাধারণ পর্যবেক্ষণ! সত্যিই তো সূর্যের আলো তো আর কেউ দিতে পারবে না। তবু রবিহারা রাতের ঘোর অন্ধকার দূর তো করতে হবে। রাত মানেই তো অন্ধকারে ডুবে থাকা নয়।


অন্ধকার দূর করার মতো চেষ্টার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সামান্য মাটির প্রদীপ। সামান্য এই প্রদীপের অসামান্য অবদান কি আমরা কেউ ভেবে দেখেছি কোনো দিন? আমরা আজ যে ইলেকট্রিক্যাল বাল্ব দেখছি, তা তো মাত্র সেদিনের জিনিস। ১৮০২ সালে বাল্ব তৈরি হয়। এর আগে হাজার বছর অন্ধকার রাতের ভরসা ছিল প্রদীপ বা বাতি। একটু বড় আকারের বাতিকে বলা হয় বোমাবাতি। এর সলতে হয় একটু মোটা। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কেরোসিনের ট্যাংকটাও হয় একটু বড়। বোমাবাতি কিন্তু বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এই ঢাকা শহরেও বহাল তবিয়তে আছে। বিশ্বাস হচ্ছে না? রাজধানীর রেললাইনের পাশে যে সবজিবাজার বসে, সেখানে গিয়ে দেখুন। বোমাবাতির উপস্থিতি যতটা প্রয়োজনে, ততটাই কাব্যে। রাতের আঁধারে পদ্মার বুকে যে আকাশ নেমে আসে, তা জানেন তো? রাতের আকাশের মতো মিটিমিটি বহু তারা ভেসে থাকে রাতের পদ্মায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, 'কাব্য পড়ে যেমন ভাবো/ কবি তেমন নয় গো।' আপনিও পদ্মার বুকে যে আকাশের প্রতিচ্ছবি দেখেন, তা আসলে আকাশের প্রতিচ্ছবি নয়; পদ্মার বুকে ভেসে বেড়ানো মাছের নৌকার বুকে জ্বলে থাকা বোমাবাতি। আর কোনো দিন যদি শীতের রাতে গ্রামের মেঠো পথে জীবনানন্দের পেঁচাডাকা অন্ধকারে হাঁটার অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে তো কথাই নেই! দূর থেকে দূরে দেখবেন ছোট্ট আলোকনাচন। যতই কাছে যাবেন, দেখবেন আলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। কাছে গিয়ে আবিষ্কার করবেন, ছোট্ট টং পেতে কানমোজা পরে বসে আছে কোনো এক পড়ন্ত বয়সী মানব। আর তার সামনে আলোকবর্তিকা হয়ে জ্বলছে বোমাবাতি। বোমাবাতির প্রয়োগ আসলে বাণিজ্যিক। ছোট দোকান কিংবা রাস্তার পাশে টুকরি নিয়ে বসে থাকা সবজিওয়ালাই এর পৃষ্ঠপোষক। আজ বোমাবাতি নিয়ে লিখতে গিয়ে কেবলই কবিগুরুকে মনে পড়ছে। আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী। হ্যাঁ, আলো হাতে গ্রামের বাড়িতে সাধারণত মানুষজন হাঁটে। এই কাজটা করা হয় এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়িতে অপরিচিত কোনো মানুষকে পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে। পরিচিতজনের বোমাবাতি তো দূরে থাক, প্রদীপেরও প্রয়োজন নেই। কারণ গ্রামের পথ, সে যতই দুর্বোধ্য হোক, গ্রামের মানুষের জন্য তা একেবারে নখদর্পণে। যে অপরিচিত মানুষটি রাতের আঁধার ভেদ করে গ্রামের আঁকাবাঁকা পথে হেঁটে যায়, সে হয়তো একটিবারও বোমাবাতিকে ধন্যবাদ দেয় না। সে ধন্যবাদ দেয় বোমাবাতির বাহককে। আজ দিন এসেছে আলোকের প্রশংসা করার। আজ দিন এসেছে আঁধার বিনাশিনীর গুণের স্বীকৃতি দেওয়ার। বোমাবাতি, তুমি রবে নীরবে।
ফাহমিদা আক্তার রিম্পি

No comments

Powered by Blogger.