আন্দোলনে মেডিক্যালে ভর্তীচ্ছুরা রিট-বিক্ষোভ

সরকারি সিদ্ধান্তের পরদিনই মাঠে নেমেছেন মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে এমবিবিএস এবং বিডিএস কোর্সে ভর্তীচ্ছুরা। তাঁরা প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিতেই ভর্তি প্রক্রিয়া বহাল রাখার দাবিতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছেন।


অন্যদিকে পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করে জিপিএর ভিত্তিতে ভর্তির সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে।
গত রবিবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে ভর্তির জন্য চলতি বছর থেকে আর ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হবে না মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক জানান, এখন থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের জিপিএর ভিত্তিতেই এমবিবিএস এবং বিডিএস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। সে জন্য এসএসসি এবং এইচএসসিতে মিলে অন্তত জিপিএ ৮ থাকতে হবে।
রিট : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন্দ বাদী হয়ে গতকাল সোমবার রিট আবেদনটি দাখিল করেন। বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাইকোর্ট বেঞ্চে আজ মঙ্গলবার এর ওপর শুনানি হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবেদনকারী। রিট আবেদনে সরকারি সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা স্থগিত করা এবং ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তির জন্য বিজ্ঞাপন প্রকাশের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তির সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না এবং ওই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার ও বাতিল করতে বিবাদীদের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারির আবেদন করা হয়েছে। রিট আবেদনে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বিবাদী করা হয়েছে।
রিটের পর ইউনুস আলী আকন্দ সাংবাদিকদের বলেন, সরকার ও বিরোধী দল যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় বুয়েট অচল হয়ে গেছে। এখন মেডিক্যাল ধ্বংসের পাঁয়তারা চলছে। পরীক্ষা ছাড়া মেডিক্যালে ভর্তি করলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ধস নেমে আসবে। এর ফলে মেধাবীরা বঞ্চিত হবে। পরীক্ষা না হলে ভর্তিতে দুর্নীতি বাড়বে। তিনি বলেন, দেশে সাধারণ শিক্ষায় আটটি ও একটি মাদ্রাসা বোর্ড রয়েছে। সব শিক্ষা বোর্ডে একদিনে পরীক্ষা শুরু হলেও প্রশ্নপত্র অভিন্ন হয় না। একেক বোর্ড একেক রকম প্রশ্ন করে। আলাদা প্রশ্নপত্রে নেওয়া পরীক্ষার ভিত্তিতে সঠিকভাবে মেধা যাচাই করা যায় না।
বিক্ষোভ সমাবেশ : ভর্তি পরীক্ষা বহালের দাবিতে ঢাকায় দিনভর বিক্ষোভ করেছেন মেডিক্যালে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবকরাও বিক্ষোভে অংশ নেন। গতকাল সোমবার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ বিক্ষোভ চলে। দুপুর আড়াইটা থেকে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন ভর্তীচ্ছুরা। রাস্তা অবরোধ করায় শাহবাগ, পল্টন ও হাইকোর্টের দিকে যান চলাচল থেমে যায়।
ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীরা বলছেন, মেডিক্যালে পড়ালেখার বিষয়টি একেবারেই আলাদা। ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া এখানে জিপিএর ভিত্তিতে মেধা যাচাই হবে না বরং মেধার অবমূল্যায়ন হবে। সরকার এ সিদ্ধান্ত হুট করে চাপিয়ে দিতে পারে না। ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত অন্তত দুই বছর আগে ঘোষণা করা উচিত ছিল।
সকাল ১০টা থেকে সোয়া ২টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থানের পর ভর্তীচ্ছুরা একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শাহবাগের উদ্দেশে যাত্রা করেন। পুলিশ বাধা দিলে সেখানেই বসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশের সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডার একপর্যায়ে ভর্তীচ্ছুরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সচিবালয়ের উদ্দেশে রওনা হলে প্রেসক্লাব-সংলগ্ন রাস্তায় তাঁদের থামিয়ে দেওয়া হয়। সেখানেই অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। পরে ১০ জনের একটি প্রতিনিধি দল সচিবালয়ে স্মারকলিপি নিয়ে গেলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে না পেয়ে ফিরে এসে ওই রাস্তায়ই অবস্থান নেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সরে যাবেন না বলেও ঘোষণা দেন। বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটের দিকে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তা অবরোধ করেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা সেখানেই থাকবেন বলে মাইকে বারবার ঘোষণা দেওয়া হয়।
সচিবালয়ের সামনে অবস্থানের সময় ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থী শান্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সবাই এখানে জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থী। মাথা ব্যথা করলে মাথা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত মানি না।'
ভর্তীচ্ছু ছাত্রীর সঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নিতে এসেছিলেন অভিভাবক শামীমা। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই রাস্তায় যারা আছে তারা সবাই আমার সন্তান। আমাদের সন্তানদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিন।' অভিভাবক সেলিম এমদাদ বলেন, 'মেডিক্যালে ভর্তির আর খুব বেশি দিন নেই। সরকার এ সিদ্ধান্ত দুই বছর আগে দিল না কেন? কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ হোক- এটা সবার চাওয়া; কিন্তু এভাবে নয়।'
আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে। মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষাও কাছাকাছি সময়ে হয়ে থাকে। গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর সারা দেশে একযোগে সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা হয়। বাংলাদেশের সব মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ মিলিয়ে মোট আট হাজার ৪৯৩টি আসন রয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে।
আমাদের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় আলাদাভাবে মেডিক্যালে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। তাঁরা আগের মতো ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে এমবিবিএস এবং বিডিএস র্কোসে ভর্তির দাবি জানান। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে 'চট্টগ্রামে সকল ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থী' ব্যানারে প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থী কর্মসূচিতে অংশ নেন। এরপর সেখান থেকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হেঁটে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় যান। সেখানে তাঁরা বেলা ৩টা পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে মানববন্ধন কমসূচি পালন করেন। কর্মসূচিতে চট্টগ্রাম কলেজ, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন কলেজ, সরকারি সিটি কলেজ, বিএফ শাহীন কলেজ, নৌবাহিনী কলেজসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রামের প্যারেড মাঠে অবস্থান নিয়ে আবারও তাঁরা মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন।
রাজশাহী অফিস জানায়, গতকাল সকালে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন শত শত শিক্ষার্থী। এ সময় তাঁদের হাতে বিভিন্ন দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার ছিল। সকাল ১০টার দিকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের সামনে জড়ো হয়ে কয়েক শ শিক্ষার্থী প্রথমে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধন চলাকালে বক্তব্য দেন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থী রাশেদুল হক হীরা, তুষার, তানজিয়া বিনতে এলিট, সোনিয়া সাবরিন বৃষ্টি প্রমুখ। পরে শিক্ষার্থীরা মেডিক্যাল কলেজের সামনে থেকে মিছিলসহ রাজশাহী নগরীর সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে গিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
বরিশাল অফিস জানায়, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট নামের একটি বামপন্থী সংগঠন সকাল ১১টার দিকে অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সমানে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এ সময় অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ শাখার আহ্বায়ক মনীষা চক্রবর্তী।
অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থী সাইফুল রহমান, সাবিহা আলম, জান্নাতুল নাইম, ইমরুল কায়েস, অভিভাবক মো. মজিবুর রহমান, খাদিজা বেগম, ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইমরান হাবিব রুমন প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.