কক্সবাজার বিমানবন্দরের ঠিকাদার নির্বাচন-অর্থমন্ত্রীর যুক্তিই মানলেন প্রধানমন্ত্রী by রেজা রায়হান

কক্সবাজার বিমানবন্দরের ঠিকাদার নির্বাচন নিয়ে অর্থমন্ত্রীর যুক্তিই শেষ পর্যন্ত মানলেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় ঠিকাদার নিয়োগের জন্য আবার দরপত্র আহ্বানের সুপারিশ করা হলে প্রধানমন্ত্রী তা অনুমোদন না করে পরবর্তী সভায় বিষয়টি আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বলেন।


কিন্তু অর্থমন্ত্রী কী কারণে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা সম্ভব নয় তা ব্যাখ্যা করলে প্রধানমন্ত্রী আবার দরপত্র আহ্বানের সুপারিশ অনুমোদন করেন।
কক্সবাজার বিমানবন্দর নির্মাণকাজের ঠিকাদার নির্বাচন নিয়ে গত কয়েক মাসে নানা ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে সংবাদপত্রে প্রতিযোগী দুই ঠিকাদারের পক্ষে-বিপক্ষে সত্যাসত্য অনেক কথাই লেখা হয়েছে। বিমানবন্দর নির্মাণকাজের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও শুধু সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) তুরস্কের কুয়ান্টা ইনসাটকে ঠিকাদার নিয়োগের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেবিচকের সাবেক চেয়ারম্যান এয়ার কমোডর (অব.) ইকবাল হোসেন কুয়ান্টার 'অনুমোদিত স্থানীয় প্রতিনিধি'। অন্যদিকে কুয়ান্টার পক্ষে ঢাকা ব্যাংকের স্থানীয় কার্যালয় থেকে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ইস্যু করা চার কোটি ১৪ লাখ টাকার বিড বন্ডে দেখা যায়, করোলা করপোরেশন কুয়ান্টার পক্ষে বিড বন্ডটি দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, কুয়ান্টার দুটি 'স্থানীয় প্রতিনিধি'। সরকারি ক্রয়বিধি (পিপিআর) অনুযায়ী আন্তর্জাতিক দরপত্রের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যাংক থেকে বিড বন্ড দেওয়ার নিয়ম, যা স্থানীয় ব্যাংক থেকে সত্যায়িত হতে হয়। অনভিজ্ঞ কুয়ান্টাকে সামনে রেখে করোলা করপোরেশনই কাজ পেতে চায় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিমানমন্ত্রী সম্মত না হলেও নানা চাপের কারণে প্রস্তাবটি ক্রয় কমিটিতে পাঠাতে বাধ্য হন। গত ২০ মে ক্রয় কমিটিতে বিবেচিত হলেও প্রস্তাব ঠিকমতো উপস্থাপিত না হওয়ায় এ বিষয়ে কিছু ব্যাখা চাওয়া হয়। গত ২০ জুন ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় ঠিকাদারের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বেবিচকের ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়। প্রস্তাব পাঠানোর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিষয়টি দুদকে পাঠানোর সুপারিশও করা হয়। এ ছাড়া তুরস্কে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জুলফিকার রহমান ৪ জুন কুয়ান্টার অভিজ্ঞতা রয়েছে মর্মে চিঠি দেওয়ায় ক্রয় কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানোর সুপারিশ করে। তবে রাষ্ট্রদূত ২০ জুন এক ফ্যাক্সবার্তায় দাবি করেন, কুয়ান্টার অভিজ্ঞতার বিষয়ে আগের চিঠিতে কিছুই বলা হয়নি। যদিও রাষ্ট্রদূতের ৪ জুনের চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে বিমান মন্ত্রণালয়ের সচিব ক্রয় কমিটিতে পাঠানো সারসংক্ষেপে কুয়ান্টার অভিজ্ঞতার প্রমাণ তুলে ধরেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রদূত ২৭ জুন আরেক ফ্যাক্সবার্তায় অভিযোগ করেন, বিমান মন্ত্রণালয় তাঁর ফ্যাক্সবার্তাকে কুয়ান্টার পক্ষে অপব্যবহার করেছে।
এদিকে, ক্রয় কমিটির সুপারিশ অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে প্রধানমন্ত্রী গত ২৭ জুন লেখেন : 'আলোচ্য বিষয় পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। যে সব বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে তার যথাযথ যুক্তি আছে বলে মনে হয় না। কক্সবাজার বিমানবন্দরের কাজ দ্রুত করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সমুদ্রসীমা বিজয়ের পর দেশের নিরাপত্তা রক্ষার বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। পরবর্তী সভায় বিষয়টি পুনরায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।'
এ নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী গত ১৮ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে দুই পৃষ্ঠার একটি সারসংক্ষেপ পাঠান। এতে অর্থমন্ত্রী বলেন, কক্সবাজার বিমানবন্দর-সংক্রান্ত ক্রয় প্রস্তাব এর আগেও ক্রয় কমিটিতে (গত ২০ মে) বিবেচিত হয়। প্রস্তাবটি ঠিকমতো উপস্থাপন করা হয়নি বলে পুনর্বিবেচনা করে যথাযথ প্রস্তাব পেশ করতে মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়। নির্দেশে মোটামুটি তিনটি ব্যাখ্যা চাওয়া হয়- (ক) কুয়ান্টা ইনসাট তুর্কি কম্পানির রানওয়ে পেভমেন্ট নির্মাণের বাস্তব অভিজ্ঞতা আছে কি? (খ) তাদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের পর মূল্য পরিশোধের সময় মার্কিন ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি টাকার বিনিময় হার কী হবে? কারণ বিষয়টি ৭০ টাকা বিনিময় হারে প্রদান করা হয়। (গ) আবদুল মোনেম এবং টিআরসিবি জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রস্তাবে কি দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং তাদের সময়মতো কাজ সম্পাদন করার সামর্থ্য বিবেচনা করা হয়েছে?
অর্থমন্ত্রী বলেন, কুয়ান্টার অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না। ২০ জুন কক্সবাজার বিমানবন্দরবিষয়ক ক্রয় প্রস্তাব ক্রয় কমিটিতে পুনর্বিবেচিত হয়। তাদের উপস্থাপনার ওপর আলোচনায় দেখা গেল, তারা পূর্বতন সভায় যেসব ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল তার দুটির (খ) ও (গ) গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে যে ব্যাখ্যা দিল তা গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রদূতের চিঠিতে তা স্পষ্ট। তুর্কি কর্তৃপক্ষ বলেছে, 'ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব ডিফেন্স' প্রত্যয়ন করতে পারে। তবে নিজস্ব প্রতিবেদনে রাষ্ট্রদূতকে কুয়ান্টা ইনসাট বলেছে, তাদের এই অভিজ্ঞতা আছে এবং তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রদূত প্রত্যয়নপত্র দেন। এটি কোনো মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ কুয়ান্টা ইনসাটের প্রতিবেদন অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ প্রত্যয়ন না করলে এটা বৈধ প্রত্যয়নপত্র নয়। ক্রয় কমিটি এই প্রত্যয়ন গ্রহণ করেনি।
অর্থমন্ত্রী জানান, 'কুয়ান্টার কোনো বৈধ বিড বন্ড নেই। তাদের ব্যাংক গ্যারান্টি ইতিমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে এবং তারা বেসামরিক বিমান পরিবহন সংস্থাকে বলেছে, চুক্তি সম্পাদনের সময় তারা যথাযথ আমানত জমা করবে। পিপিআরের ২২(২) ধারা মতে, কোনো ক্রয় প্রস্তাবের সঙ্গে বিড বন্ড না থাকলে তা বিবেচনা করা যায় না। দরদাতার একটি চিঠির বরাতে জানা যায়, এমনকি ১ জুলাইয়েও তারা বিড বন্ড দিতে পারেনি। তাই প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনা করলেও এটি গ্রহণের সুযোগ নেই বলে ক্রয় কমিটি আবার দ্রুত টেন্ডার আহ্বানের নির্দেশ দেয়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি পেশ করেছি। এ অবস্থায় বিষয়টি কি পুনর্বিবেচনা করব? বিমানমন্ত্রীও ক্রয় কমিটির সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করেন।'
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ২৪ জুলাইয়ের সারসংক্ষেপে লেখেন : 'ক্রয় কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।'
এভাবে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে কক্সবাজার বিমানবন্দরের কাজ দ্রুত করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় বর্তমান অবস্থায় পূরণ হওয়ার নয়। আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ থাকায় পুনরায় দরপত্র আহ্বান ও প্রক্রিয়াকরণ করে বর্তমান সরকারের মেয়াদে বিমানবন্দরের নির্মাণকাজ শুরুর সম্ভাবনা কম। তা ছাড়া বিলম্বের কারণে ব্যয়ও বাড়বে। ফলে মেয়াদ ও ব্যয় দুটোই বাড়ানোর জন্য তৃতীয় দফায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন নিয়ে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করতে হবে। পুরো প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ।

No comments

Powered by Blogger.