বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন পুনরুদ্ধার by এম আবদুল হাফিজ

বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্প যাত্রারম্ভের আগেই প্রচণ্ড হোঁচট খেল। বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক আনুষ্ঠানিকভাবেই পদ্মা সেতু অর্থায়ন চুক্তি বাতিল ঘোষণা করলেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। অন্য দুটি সহযোগী সংস্থা আইডিবি ও জাইকা যে একই পথে হাঁটবে তা শুধু সময়ের ব্যাপার।


পদ্মা সেতুর এ অর্থায়ন চুক্তি বাতিল একাধিক কারণে একটি জাতীয় বিপর্যয়। ফলে উদ্ভূত সংকট ইতিমধ্যেই ঘনীভূত হতে চলেছে_ আমাদের ভয়াবহ বিভক্তি, বিষয়টি সম্পর্কে বিভক্ত অবস্থান এবং জাতীয় নেতৃত্বে তীব্র অনৈক্যের কারণে। সমস্যা শুধু এ বিভক্তি ও অনৈক্যেই থেমে নেই, এর উত্তাপ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এ চুক্তি বাতিলকে সরকারের ব্যর্থতা আখ্যায়িত করে তার দুর্নীতির কারণেই এ বিপর্যয় পুরো জাতিকে কলঙ্কিত করেছে দাবি করে অবিলম্বে সরকারকে পদত্যাগ করতে বলেছে। অন্যদিকে মারমুখী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বিএনপিকে তার অতীতের দুর্নীতিসহ ন্যক্কারজনক কার্যকলাপের কথা স্মরণ করিয়ে মিটিং-মিছিলে রাজপথ উত্তপ্ত করে তুলছে। এতে করে মূল প্রতিপাদ্য পদ্মা সেতু ও চুক্তি বাতিলের পর এর ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার কথাই গৌণ হয়ে পড়েছে। ফলে আলোচ্য সেতুর ভাগ্য শুধু অনিশ্চিতই হয়ে পড়েছে।
প্রকল্প শুরু হওয়ার আগেই যে দুর্নীতির আভাস পেয়ে বিশ্বব্যাংক চুক্তিটি বাতিল করেছে সে সম্পর্কে আমার মতো নগণ্য ব্যক্তির কিছু মন্তব্য করা শুধু অশোভনীয়ই নয়, অনধিকার চর্চাও। ওইসব বিষয় সরকারের অন্দর মহলের চর্চার উপাদান এবং সেখানে বিচরণকারীরাই এসব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকার কথা। কিন্তু সরকার, দুদক চেয়ারম্যান এবং মন্ত্রিসভার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা প্রকল্পে কোনো ধরনের দুর্নীতি না হওয়া সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হয়েও বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির সম্ভাব্যতার আঁচ পাওয়ায় অর্থায়ন স্থগিত করার সঙ্গে সঙ্গে সংস্থাটির বিরুদ্ধে কোনো স্ট্যান্ড না নিয়ে কেন তড়িঘড়ি করে অর্থায়নের বিকল্প উৎস খোঁজায় তৎপর হয়ে উঠল? তাহলে কি আসলেই কিছুটা দুর্নীতি হয়েছিল, যার কারণে সরকার শেষ পর্যন্ত ঋণ পাওয়া সম্পর্কে সন্দিহান ছিল? বিকল্প হিসেবে কখনও মালয়েশিয়া, আমিরাত, চীন এবং সেতু নির্মাণে এমনকি স্বনির্ভরতার কথাও উচ্চারিত হতে শুনেছি। সেই পাকিস্তান আমল থেকেই আমরা সাধারণ মানুষ শুধু এটুকুই জানি যে, যতটা না রাষ্ট্রীয় স্বার্থে সরকার ঋণ নেয় তার চেয়ে অনেক বেশি স্বার্থ জড়িয়ে থাকে এক ধরনের রাজনীতিক ও আমলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম সময়ে মিত্রশক্তির একমাত্র ধনতন্ত্রবিরোধী শরিক তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চোখ ফাঁকি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের ব্রেটন উডে পশ্চিমা স্বার্থ সংরক্ষণে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছিল তারই অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অস্তিত্বে আসা দাতা সংস্থাগুলোর অন্যতম বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ আমলারাই উৎসাহিত করে। এমনটি করায় তাদের ফায়দাও নগণ্য নয়। ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়ায় আমলারা বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলে, যাতে সরকারি চাকরির অন্তিম সময়ে ওইসব প্রতিষ্ঠানে কোনো এক লাভজনক নিয়োগ কপালে জোটে। ২০০৭ সালে ডক্টর ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানের পদ প্রাপ্তি, তা তার ওই বিশ্বব্যাংক ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণেই, আমাদের অর্থমন্ত্রীরও বিশ্বব্যাংক অভিজ্ঞতা তার ওই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার কারণে।
হঠাৎ করেই এখন আমাদের সরকার ও তার সমর্থকরা বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেছেন। কিন্তু তাতে কি সংস্থাটির আমাদের সম্পর্কে দুর্নীতির ধারণাকে বদলাতে পারবে, না উল্টো ফল বয়ে আনবে? বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্টও আমাদের দুর্নীতি সম্পর্কে একই ধারণা পোষণ করেন। বিশ্বব্যাংকের নিজস্ব দুর্নীতি আরও উচ্চমার্গের ব্যাপার। ওগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে আমরা আরও প্রতিকূল অবস্থায় পড়ব। কোটি কোটি ডলারের পদ্মা সেতু প্রকল্পে এ দেশের সংস্কৃতিতে লালিত রাজনীতিক বা আমলাদের এক-আধটু ভাগ বসানোয় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তবে অর্থায়ন হওয়ার এবং সুনিশ্চিত দুর্নীতিতে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই চুক্তি বাতিল এবং দৃশ্যত আমাদের জন্য সংস্থাটির দ্বার একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া বেশ নিষ্ঠুরই মনে হয়। অর্থনীতির একাধিক এক্সপার্টের সুবিজ্ঞ বক্তব্য থেকে যেটুকু বোঝা যায় তাতে পদ্মা সেতুকে অস্তিত্বে আনতে বিশ্বব্যাংক ও সহযোগী দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়ন ও সহযোগিতার বিকল্প নেই।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.