গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারই বহুমুখী সমাধান by ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান ও মোশাররফ হোসেন মুসা

এক. শিরোনামটি একজন কলাম লেখকের কলাম থেকে ঈষৎ ধার করা। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে স্থানীয় সরকারের পক্ষে ঘন ঘন সভা-সেমিনার দেখে তিনি একটি জাতীয় দৈনিকে 'স্থানীয় সরকার সর্বরোগহারী বটিকা নয়' শীর্ষক এক কলাম লেখেন।
তিনি সুবিধাবাদীদের বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে গুরুত্বহীন দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং প্রমাণ করেছেন, আধুনিক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর তেমন কোনো ধারণা নেই। এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে, আধুনিক যুগের শাসন ও আইন-কানুনের ধারণা এসেছে স্থানীয় শাসন থেকে। সে জন্য আমরা বারবার বলে থাকি, যারা স্থানীয় সরকার বোঝেন না, তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থাও বোঝেন না। ওই কলাম লেখক বর্তমানে একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় নিয়মিত কলাম লেখেন। তবে তাঁর বর্তমান লেখাগুলো প্রতিক্রিয়ামূলক হলেও সরকারের ভাবনা আগের থেকে উন্নতি লাভ করেছে বলে অনেকে মনে করেন। শুধু এই কলাম লেখকই নন, বাংলাদেশের বহু গবেষক ও বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, তাঁরা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা বোঝেন না; কিন্তু রাজনীতি ও সরকার ব্যবস্থা নিয়ে লেখেন, তাঁরা গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও এর বহুমুখী উপকারিতা সম্পর্কে বুঝতে চান না বলে প্রতীয়মান হয়। সে ক্ষেত্রে আমরা প্রতিনিয়ত বলে আসছি, প্রস্তাবিত 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা' বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের বহু সমস্যার সমাধান রাতারাতি হতে পারে; কারণ এই রূপরেখায় স্থানীয়দের গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন, গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্থানীয়করণ, স্থানীয়দের দায়িত্বশীলকরণ, কর সংস্কৃতির বিস্তৃতকরণ, এক শ একশ প্রতিনিধিত্বে নারীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণ, নগর সরকারের নেতৃত্বে পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত নগরায়ণ সম্পন্নকরণ, নগরীয় কৃষির বিস্তৃতিকরণ, দুই প্রকারের সরকারব্যবস্থায় স্থানীয় সরকারের সমন্বিত স্তরবিন্যাসকরণ ঠিককরণ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ, তৃণমূলে ক্ষমতার পৃথক্করণ, স্থানীয় বিধানিক সংসদ প্রতিষ্ঠাকরণ, ২০২০ ও ২০৫০ সালকেন্দ্রিক সব উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকরণসহ বহু সমাধানমূলক ব্যবস্থা রয়েছে।
দুই. সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন সারা দেশে ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণের কাজ সমাপ্ত করেছে। জানা গেছে, যারা ১ জানুয়ারি ১৯৯৫ ও এর আগে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁরা নতুন ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। সেই সঙ্গে বিগত সময়ে যাঁরা ভোটার হয়েছেন এবং আইডি কার্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁদের কারো নাম-ঠিকানা ইত্যাদি ভুলত্রুটি থাকলে তাঁরাও সংশোধনের সুযোগ পাবেন। নির্বাচন কমিশন থেকে সরবরাহকৃত 'ফরম-১৪'-তে এক জায়গায় প্রশ্ন করা হয়েছে, 'ভোটার হতে ইচ্ছুক ব্যক্তি সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড- কোনটিতে ভোটার হতে ইচ্ছুক!' অর্থাৎ একজন নাগরিকের চার এলাকার যেকোনো একটিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার বিষয়টি স্বীকার করা হয়েছে। সরকারও এই চারটি ইউনিটকে স্থানীয় ইউনিট মনে করে; কিন্তু এগুলোকে স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট হিসেবে ঘোষণা প্রদান করেনি। তা ছাড়া ওই চারটি মৌলিক ইউনিটসহ অন্যান্য স্থানীয় ইউনিটের নামকরণ, প্রকারভেদকরণ, স্তরবিন্যাসকরণ, কাঠামো ইত্যাদি প্রসঙ্গে সরকারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। এমনকি তথাকথিত স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের মুখেও এসব বিষয়ে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। দাতাদের সাহায্যপুষ্ট এনজিওদের তরফ থেকে আসা 'স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে'- বাক্যটি এখন রাজনীতিক, গবেষক, বুদ্ধিজীবীসহ অনেকেই ব্যবহার করছেন। অথচ কেউ ভেবে দেখেন না, বাংলাদেশে বিদ্যমান স্থানীয় সরকার অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ ও অগণতান্ত্রিক। এজেন্টধর্মী ও কেন্দ্রনির্ভর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা মানে এজেন্ট প্রথাকে আরো শক্তিশালী করা। এর বিপরীতে আমাদের বক্তব্য হলো, স্থানীয় সরকারকে গণতন্ত্রের বেইস হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে; যার মধ্যে স্বশাসন, স্বাবলম্বিতা, স্থানীয়দের ক্ষমতায়ন, শক্তিশালীকরণসহ সব কিছুই থাকবে; কিন্তু শুধু 'শক্তিশালীকরণ'-এর মধ্যে 'গণতন্ত্র' নাও থাকতে পারে। কারণ অতীতে দেখা গেছে, অনির্বাচিত সরকারগুলো স্থানীয় সরকারকে 'শক্তিশালীকরণ'-এর কথা বলে কার্যত এনজিওদের সহায়তায় গণতন্ত্রের সমূহ ক্ষতি করেছে।
তিন. এ দেশের প্রতিদিনকার পত্রপত্রিকা, সভা-সেমিনার, রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা ইত্যাদি লক্ষ করলে বোঝা যায়, এ দেশের অধিকাংশ মানুষ গণতন্ত্র ভিন্ন অন্য কিছু চায় না। আমরাও মনে করি, গণতন্ত্র একটি বাস্তবায়নযোগ্য বিষয় এবং সে লক্ষ্যে 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার' একটি উত্তম 'মাধ্যম'। সেই সঙ্গে এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থা, আয়তন, জনসংখ্যা, ইতিহাস-ঐতিহ্য ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, তথা স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা ও কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে পররাষ্ট্র, মুদ্রা, বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য, সমগ্র দেশের নিরাপত্তাসহ জাতীয়ভিত্তিক কাজগুলো ন্যস্ত থাকবে। আর অবশিষ্ট কাজগুলো এককভাবে করার জন্য স্থানীয় সরকারের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। ব্রিটিশ শাসনের আগে এ দেশে বর্তমানের মতো কোনো এজেন্টধর্মী স্থানীয় সরকার ছিল না। তখন দেশটি অনেক সুবায় (প্রদেশে), সুবাগুলো অনেক সরকারে এবং সরকারগুলো অনেক পরগনায় বিভক্ত ছিল। মোট কথা, তৎকালে শাসকদের সঙ্গে তৃণমূলীয় জনগোষ্ঠীর তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। ব্রিটিশ সরকার তার শাসনকার্য প্রলম্বিত করার স্বার্থে জেলা পর্যায়ে 'জেলা বোর্ড' এবং ইউনিয়নে 'ইউনিয়ন কমিটি' (ইউনিয়ন বোর্ড) গঠন করে। একই উদ্দেশ্যে বিভাগ, মহকুমা ও থানা সৃষ্টি করে। পৌরসভাগুলো চাকরিজীবীদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় এগুলোকে দীর্ঘদিন স্থানীয় সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি; কিন্তু স্বাধীন দেশে স্থানীয় সরকার থাকে উন্নয়নের উদ্দেশ্যে। উন্নয়ন হয় উন্নয়ন কস্টের চেয়ে সিস্টেম কস্ট কম হলে। সে জন্য অপ্রয়োজনীয় স্তরগুলো চিহ্নিত করাসহ গ্রামীণ কাজ, নগরীয় কাজ ও গ্রামীণ-নগরীয় কাজ সম্পন্ন করার স্বার্থে একটি সমন্বিত স্তরবিন্যাসকরণ গ্রহণ খুবই জরুরি। ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডকে স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে; ইউনিয়নে ইউনিয়ন সরকার এবং পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডকে বিলুপ্ত করে 'নগর সরকার' গঠন করতে হবে। তাহলে গ্রামীণ এলাকায় থাকবে ইউনিয়ন সরকার আর নগরীয় এলাকায় থাকবে নগর সরকার। বিভাগ অথবা জেলাকে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট ঘোষণা করতে হবে। উপজেলা মধ্যবর্তী ইউনিট হিসেবে থাকবে কি না তা মূল্যায়ন করতে হবে। এই স্তরবিন্যাসে প্রশ্ন দেখা দেবে, নগরীয় ইউনিটগুলো যদি একস্তর বিশিষ্ট হতে পারে এবং নগরীয় কাজগুলো যদি তারা একাই করতে পারে, তাহলে গ্রামীণ কাজগুলো করার জন্য একাধিক স্তর থাকার প্রয়োজন আছে কি না? এই স্তরবিন্যাসের আরেকটি বিশেষ দিক হলো, ২০৫০ সাল নাগাদ সমগ্র দেশটি অনেক নগরীয় ইউনিটে বিভক্ত হয়ে পড়বে, তখন নগরগুলো তত্ত্বাবধান করার জন্য জেলা কিংবা বিভাগ যেকোনো একটি সর্বোচ্চ ইউনিট হিসেবে রেখে দিতে হবে। চার. জনৈক গবেষক একটি পত্রিকায় একটি কলামে ঢাকার রমনা পার্কের দুরবস্থা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে বলেছেন, 'এই পার্কে দেশের গণ্যমান্য, বরেণ্য ও এমনকি দেশ পরিচালনার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরাও প্রাতর্ভ্রমণ করেন। তাঁরা স্বচক্ষে পার্কটির মৃত্যুযন্ত্রণা দেখছেন; কিন্তু কেউই পার্কটি রক্ষার জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। একে অপরকে দায়ী করে নিজ দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হলো, সমস্যাটি ঢাকা নগরের স্থানীয় সমস্যা; কিন্তু পার্কটি সিটি করপোরেশনের অধীনে নেই, রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধানে (যদিও একটি পত্রিকা মনে করে, ঢাকা নগরের সমস্যা মানে জাতীয় সমস্যা। সে জন্য তারা একসময় স্লোগান দিয়েছিল- 'ঢাকা বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে)। সিডিএলজির প্রস্তাবিত 'নগর সরকার' ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে পার্কটি তত্ত্বাবধান করবে 'ঢাকা দক্ষিণ নগর সরকার'। এই 'নগর সরকার' নগর প্রশাসন, নগর সংসদ ও নগর আদালত মিলে গঠিত হবে। এ ছাড়া নগর ন্যায়পাল ও নগর নির্বাচনিক বোর্ড থাকবে। নগর ন্যায়পাল নগর সরকারের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবেন এবং নগর নির্বাচনিক বোর্ড নগর সরকারের মেয়াদ শেষে স্বউদ্যোগে ও স্বাধীনভাবে নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে। মেয়রের অধীনে নগর প্রশাসন থাকবে এবং 'নগর পুলিশ' নগর প্রশাসনের অধীনে থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে। নগর সংসদে নগরকেন্দ্রিক যাবতীয় সমস্যা আলোচিত হবে এবং নগর সংসদের পাসকৃত সিদ্ধান্ত 'নগর প্রশাসন' বাস্তবায়ন করবে। নগর আদালত নগরকেন্দ্রিক অপরাধের বিচার করবে; এই ব্যবস্থা গৃহীত হলে নগরের সমস্যার জন্য কেউই কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করবে না। তখন নাগরিকরা নগর সরকারের অংশ হয়ে পড়বে। ফলে নগর রক্ষায় নাগরিকরাও সরাসরি সক্রিয় ভূমিকা পালন করার সুযোগ পাবে।

লেখকবৃন্দ : চেয়ারম্যান, জানিপপ; প্রফেসর রাষ্ট্রবিজ্ঞান,
বিসিএস শিক্ষা এবং সদস্য, সিডিএলজি
janipop1995@gmail.c

No comments

Powered by Blogger.