পাকিস্তান-দুর্বিপাক থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? by আবু সাঈদ খান

সেনা নিয়ন্ত্রিত নয়, সত্যিকার জনপ্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থাই পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে অদক্ষতা ও দুর্নীতির অভিযোগ; যা সত্য, কিন্তু সেনা ছায়াতলে কি যোগ্য


, সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠা সম্ভব? সেনাবাহিনীর অনুমোদন ছাড়া সেখানে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয় না


রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান ব্যর্থ কিনা এ প্রশ্ন গত এক দশক ধরেই নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত। সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে প্রসঙ্গটি নতুন করে আলোচিত হচ্ছে। অনেকে দেশটির সার্বভৌমত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। সম্প্রতি ইসলামাবাদের ৩০ কিলোমিটার দূরে এবোটাবাদ শহরে সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র কাকুল মিলিটারি একাডেমীর নিকটবর্তী একটি বাড়িতে মার্কিন বাহিনী সামরিক অভিযান চালিয়ে আল কায়দা প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছে। ঘটনাটির দুটি দিক। প্রথমত, ওসামা বিন লাদেন সেখানে বিনাবাধায় ৫ বছরের বেশি সময় অবস্থান করছিলেন। শুধু বিন লাদেনই নন, আল কায়দাসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা দেশটিতে ঘাঁটি গেড়ে আছে। সেখান থেকে সামরিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের অছিলায় সেখানে মার্কিন সেনা উপস্থিতিও যথেষ্ট। প্রতিনিয়ত চালকবিহীন বিমান-ড্রোনের সাহায্যে সন্দেহভাজন জঙ্গি এলাকায় হামলা চলছে। এর সঙ্গে নতুন সংযোজন, পাকিস্তানকে তোয়াক্কা না করে, এমনকি দেশটিকে না জানিয়ে দেশটির অভ্যন্তরে বিন লাদেন হত্যার সামরিক অভিযান। পাকিস্তান মার্কিনি অভিযানের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টে একটি নিন্দা প্রস্তাব নিয়েছে। সবার বোধগম্য যে, এটি মুখরক্ষার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। পাকিস্তান যে এমন একটি নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ল_ সেজন্য দায়ী দেশটির ভ্রান্ত রাজনীতিই।
পাকিস্তানের অতীত বিশ্লেষণ করলেই তা স্পষ্ট হবে। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনটি বৈশিষ্ট্য প্রধান হয়ে ওঠে। সেগুলো হলো_ রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সংমিশ্রণ, সামরিক-বেসামরিক আমলাদের প্রভুত্ব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অন্ধ আনুগত্য।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বীভৎস রূপ সবাই প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উপমহাদেশের ইতিহাসে নির্মম ও কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে রয়েছে। পাঠান, মোগল, ইংরেজদের ক্ষমতা দখল-বেদখলের খেলায়ও এত নর-নারী-শিশুর প্রাণ সংহার হয়নি। এই ধর্মীয় অস্ত্রের ব্যবহার যে পাকিস্তান রাষ্ট্রেও ভয়াবহ হতে পারে সে আশঙ্কা করেছিলেন স্বয়ং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহম্মদ আলী জিন্নাহ। তাই তিনি ধর্মীয় অস্ত্রকে খাপে পুরে ফেলতে চেয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন_ 'মুসলমানরা মসজিদে যেতে পারবে, হিন্দুরা মন্দিরে যেতে পারবে। কিন্তু আমরা মুসলিম বা হিন্দু নই। আমরা পাকিস্তানি।' পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায় জিন্নাহর মৃত্যুর পর আবার ধর্মীয় রাজনীতির জিগির মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। গণতন্ত্র, মানবিকতা, উন্নয়ন সবকিছুকে গ্রাস করে ধর্মীয় উন্মাদনা।
২৪ বছর ধরে পাকিস্তান আমলে বাংলার জনগণ ধর্মীয় রাজনীতির নামে বৈষম্য-শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়েছে। একাত্তরে ধর্মের দোহাই পেড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলার মাটিতে নির্মম গণহত্যা-নারী ধর্ষণ-লুটপাট-অগি্নসংযোগ করেছে। আমরা একাত্তরে এর জবাব দিয়েছি; কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি। পাকিস্তান সেদিনের সেনাসদস্যদের কৃতকর্ম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য তাদের কাঠগড়ায় না দাঁড় করিয়ে বরং তাদের প্রশংসা করে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না, জুলফিকার আলি ভুট্টোকে হত্যা করে সেখানে পরিপূর্ণ সামরিকতন্ত্র কায়েম হয়, অন্যদিকে দেশটি পরিণত হয় ইসলামী প্রজাতন্ত্রে। পাকিস্তানের প্রদেশগুলোর স্বায়ত্তশাসনের ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদার দাবিকে পদদলিত করে রাখা হয়।
পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ইসলাম ধর্মবিশ্বাসী হলেও দেশটি উপমহাদেশের সামাজিক চরিত্র থেকে ভিন্ন নয়, বহুত্ববাদী সামাজিক বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। এখানে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম সভ্যতা একাকার হয়ে আছে। এ প্রসঙ্গে ১৯৯৬ সালে করাচিতে 'পিপি-২১' আয়োজিত শান্তি ও সহনশীলতা শীর্ষক আঞ্চলিক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই। সম্মেলনটি শুরু হয়েছিল মঙ্গলপ্রদীপ জ্বেলে। সেখানে করাচি ক্লাবে কৃষক নেতা জাফর সাঙ্গী বিদেশি অতিথিদের সম্মানে একটি ভোজসভায় আমন্ত্রণ করেছিলেন। সেদিন লারকানা থেকে আসা লোকায়ত শিল্পীদের কণ্ঠে যে গান শুনেছিলাম, তা কেবল সুর-লয়ে নয়, বাণীতে আমাদের বাউল গানের সমার্থক। সেখানে সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীসহ সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে বুঝেছিলাম, ধর্মীয় রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অসাম্প্রদায়িক মানবিক ধারা বহমান রয়েছে। তবে আশঙ্কার কথা শুনেছিলাম, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপকভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার প্রসার ঘটছে। সেটি এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে জঙ্গিবাদের কারখানা। সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কারের উদ্যোগ নেন। কীভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কার করেছে, তা দেখতে একটি প্রতিনিধি দলও পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু এ ব্যাপারে সাফল্য সামান্যই।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সৌহার্দ্যও (কার্যত অন্ধ আনুগত্য) পাকিস্তানকে বিপথগামী করেছে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ভারত জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে। আর পাকিস্তান সিয়াটো ও সেন্টোর সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে মার্কিন মিত্রে পরিণত হয়। এ বন্ধুত্বের কারণে সাহায্য-অনুদান লাভ করে সত্য, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্বকীয় ও স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি। ১৯৮০ সালে আফগানিস্তানে সোভিয়েত সমর্থিত সরকার উৎখাতে পাকিস্তান হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত সহযোগী। তখন আফগানিস্তানে তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর যে হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়, তা কেবল তালেবানদের যাত্রাকে সহায়তা দেয়নি, এ থেকেই পাকিস্তানে অঙ্কুরিত হয় জঙ্গিবাদের বীজ।
৯/১১ ঘটনার পর সন্ত্রাসবিরোধী মার্কিন যুদ্ধে পাকিস্তান সাড়া দিয়ে আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপক মার্কিনি সাহায্য লাভ করে। ৯/১১-এর পর প্রথম তিন বছরে সেই সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সে সাহায্য পাওয়ার পর থেকেই জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইঁদুর-বিড়াল খেলা শুরু করে।
এই ভ্রান্ত রাজনীতি পাকিস্তানের দারিদ্র্য ঘোচাতে পারেনি। সেভাবে বাড়েনি স্বাস্থ্য-শিক্ষা সুবিধা। ব্যাপক জনগোষ্ঠী দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এ দারিদ্র্যকবলিত, বেকার হতাশাগ্রস্ত যুবকরা জঙ্গিবাদের খাতায় নাম লেখাচ্ছে। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জঙ্গিবাদ।
পাকিস্তানের আয়-উপার্জনের সিংহভাগ খেয়ে ফেলছে সেনাবাহিনী। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আজ পৃথিবীর সপ্তম বৃহৎ সেনাবাহিনী। তারা কেবল রাজনীতিতেই হস্তক্ষেপ করছে তা নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যও নিয়ন্ত্রণ করছে। পাকিস্তানে এখন বিত্ত-বৈভবের প্রতিযোগিতায় ভূস্বামী, শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের কাতারে শামিল হয়েছেন সেনা কর্মকর্তারা।
পাকিস্তানের জনগণকে আজ বোঝানো হচ্ছে, পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনী দরকার। সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছে, ভারতের মতো তাদেরও পারমাণবিক বোমা রয়েছে। সম্প্রতি পারমাণবিক প্রকল্পের বিজ্ঞানী কাদির খান বলেছেন, একাত্তরে পারমাণবিক অস্ত্র থাকলে পাকিস্তান ভাঙত না। এই মূর্খতাই পাকিস্তানের সর্বনাশের জন্য দায়ী। পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়ে জনতার শক্তি যে কত বড়, তা তারা বুঝতে অক্ষম।
সেনা নিয়ন্ত্রিত নয়, সত্যিকার জনপ্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থাই পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ। তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে অদক্ষতা ও দুর্নীতির অভিযোগ; যা সত্য, কিন্তু সেনা ছায়াতলে কি যোগ্য, সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠা সম্ভব? সেনাবাহিনীর অনুমোদন ছাড়া সেখানে কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয় না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তথা জনগণ ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী; কিন্তু সে ক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে সামরিক কর্তৃপক্ষ। তবে সম্পর্কোন্নয়নে ভারতের দিক থেকে কোনো বাধা নেই, তা আমি বলতে চাইছি না।
পাকিস্তান রাষ্ট্রটি একই সঙ্গে ধর্মীয় শাসনের কথা বলবে, শরিয়া আইন চালু করবে আর মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ঠেকাবে, তা কি বাস্তবসম্মত? রাজনীতি ও ধর্ম এক রেখায় থাকলে ধর্মান্ধতা দূর হবে না। আজ সেখানে 'সেক্যুলার মোল্লা' খুঁজে মোল্লাতন্ত্রের মোকাবেলার কথা বলা হচ্ছে। এ তত্ত্ব হাস্যকর। মোল্লার লক্ষ্য মোল্লাতন্ত্র, গণতন্ত্র নয়। তাই গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করতে হলে রাজনীতি থেকে ধর্মের ব্যবচ্ছেদ ঘটাতে হবে; পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সে সত্য মুহম্মদ আলী জিন্নাহ উপলব্ধি করেছিলেন।
এ সত্য ধারণ করার মধ্য দিয়ে বর্তমানের সৃষ্ট দুর্বিপাক থেকে পাকিস্তান বেরিয়ে আসতে পারে। যদিও এ এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে সামনে দুটি ব্যারিকেড_ সেনাতন্ত্র ও জঙ্গিতন্ত্র। এই দুই শক্তিকে মোকাবেলা করে পাকিস্তানকে শান্তি, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে; এ ভিন্ন কোনো শর্টকাট পথ নেই।

আবু সাঈদ খান : সাংবাদিক
ask_bangla71@yahoo.com
www.abusayeedkhan.com
 

No comments

Powered by Blogger.