চরাচর-জপমালা রানীর গির্জা by আলম শাইন

উপমহাদেশের ভাগ্যটা কখনো ভালো যায়নি। এ উপমহাদেশের অধিবাসীরা একসময় ছিল সহজ-সরল বা বোকা কিসিমের। আর তাদের সে সরলতার সুযোগ নিয়েছে ভিনদেশিরা। বিভিন্ন সময়ে বাণিজ্যের সুবিধা নিয়ে উপমহাদেশে এসে শত শত বছর শাসন-শোষণ দুটিই করে গেছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে প্রচুর।


অনেক রক্তক্ষরণ শেষে নিজেদের মাটি নিজেরা বুঝে পেতে সক্ষম হয়েছেন আমাদের পূর্ব-পুরুষরা। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে অবশ্য শত শত বছর। পৃথিবীর আর কোনো দেশেই অমনটি ঘটেনি, যা ঘটেছে এতদঞ্চলে। যার ফলে আমাদের কৃষ্টি-কালচার এমনকি ভাষায়ও এসেছে পরিবর্তন। শত শত বছর ধরে এ উপমহাদেশ শাসন করেছে নানা জাতি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতি হচ্ছে মোগল, ফরাসি, গ্রিক, আর্মেনিয়ান, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ ও ইংরেজরা। তারা শাসন-শোষণের পরও কিছু স্থাপনা তৈরি করে গেছে, যা নিয়ে এখন আমরা গর্ববোধও করি। বলা যায় আমাদের পুরাকীর্তির ভাণ্ডারটা তারাই সমৃদ্ধ করে গেছে। আজ সেসব দেখতে ভিনদেশিরাও আসে। ফলে পর্যটন খাতে কিছুটা হলেও রাজস্ব আদায় হয়। তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হচ্ছে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অবস্থিত ক্যাথলিক গির্জা। যার নাম 'জপমালা রানীর গির্জা'। গির্জাটি স্থাপিত হয় ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে (সাল-তারিখ নিয়ে মতভেদ রয়েছে)। ইতিহাস থেকে যতদূর জানা যায়, ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গদেশে প্রথম পর্তুগিজদের আবির্ভাব ঘটে। উল্লেখ্য, তখনকার সময়ে ভিনদেশিরা প্রবেশদ্বার হিসেবে চট্টগ্রামকে ব্যবহার করত। সে সময় পর্তুগিজরা এ দেশে এসেছে মূলত ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। তারা ঢাকায় মিশন গাড়ে ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে। তখন ঢাকার শাসনভার ছিল সুবেদার শায়েস্তা খানের হাতে। জানা যায়, তাঁর শাসনে যৎসামান্য দুর্বলতা ছিল। সে সুযোগ নিয়েই পর্তুগিজরা রাজনীতিতে প্রবেশ করে এবং শুরু করে অনৈতিক কর্মকাণ্ড। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি মোগল সুবেদার। তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং যুদ্ধে জয়ীও হন। পরাজিত পর্তুগিজরা চুক্তির আওতায় এসে আবার বসবাস করার সুযোগ পায়। ওই চুক্তি অনুসারে ঢাকার তেজগাঁওয়ে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতিও পায়। সে সুবাদে তারা গির্জাটি স্থাপন করে। গির্জাটির কাঠামো বেশ সুন্দর। এটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২১০ ফুট, প্রস্থ ৩২ ফুট, উচ্চতা ২৫ ফুট আর দেয়ালের পুরুত্ব ২০ ইঞ্চি। গির্জাটির প্রবেশদ্বার মোট পাঁচটি। গির্জায় আলো-বাতাস প্রবেশের জন্য মোট ১৮টি জানালাও রয়েছে। এর ভেতরে রয়েছে ইংরেজ, গ্রিক, আর্মেনীয়দের ৪৩টি কবর। এর মধ্যে একটি কবরের এপিটাফের বর্ণনা অনুযায়ী ৩০০ বছর ধরা পড়েছে। গির্জাটি এখনো ব্যবহৃত হয়। একসঙ্গে এটিতে প্রায় ৯০০ লোক প্রার্থনা করার সুযোগ পায়। সেই সঙ্গে আমাদেরও প্রার্থনা গির্জাটির আয়ুষ্কাল যেন বৃদ্ধি পায়। এতে আমাদের পুরাকীর্তির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ থাকবে।
আলম শাইন

No comments

Powered by Blogger.