চরাচর-আর কত অত্যাচার সইবে মাটি? by মো. নূর-ই-আলম সিদ্দিকী

মানবসভ্যতার উষালগ্ন থেকেই মানবগোষ্ঠী ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য খেয়েপরে ভালোভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে যখন বনজঙ্গল উজাড় করে কৃষিজমি সৃষ্টি করতে থাকে এবং কৃষিব্যবস্থাকেই একমাত্র উপায় হিসেবে গ্রহণ করে, বস্তুত সেদিন থেকে ভূমিক্ষয় শুরু হয়। মাটিকে অবিরাম, যথেচ্ছ ও অবৈজ্ঞানিকভাবে ব্যবহারের ফলে ভূমিক্ষয়ের বিষয়টি এখন বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।


প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি কৃষি ব্যবসা প্রচলনের পর কৃত্রিমভাবেও দ্রুত ও মারাত্মকভাবে ভূমিক্ষয়ের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। কৃষিজমিতে সার প্রয়োগ না করে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ লক্ষ না করে এবং ফসলের পর্যায়ক্রম না মেনে বছরের পর বছর ফসল জন্মানোর ফলে মাটির উপরিভাগের ক্ষয় আরো প্রকট আকার ধারণ করে। এগুলো ছাড়াও হালচাষ, বন উজাড়করণ, বৃক্ষনিধন, রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং কৃষিযন্ত্রের প্রয়োগ ইত্যাদি মাটিক্ষয়ের কারণগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবাধ খননকাজ, অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন, শিল্পকারখানা ও নগরায়ণের কার্যক্রম। জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির ফলে জমিকে নির্বিচারে ব্যবহারের ফলে মাটির প্রাকৃতিক ক্ষয়ের হারের তুলনায় কৃত্রিম ক্ষয় দ্রুততর হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী জমিতে নতুন মাটি জমা হওয়ার হারের চেয়ে আবাদি জমির ক্ষয় ৩৫ শতাংশ বেশি হচ্ছে। সময়মতো এ ক্ষয় রোধ করা না গেলে সারা পৃথিবীর পরিবেশ-ব্যবস্থা একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। তাই ভূমিক্ষয়কে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। মানুষের সৃষ্ট এই ভূমিক্ষয়ের ফলে পৃথিবীর বহু উর্বর অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। অনেক সভ্যতা মাটির বুক থেকে মুছে গেছে। এভাবে ইরান, সিরিয়া ও মিসরের বহু অংশ মরুভূমি ও বালুতে পরিণত হয়েছে। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা এবং মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা হয়তো এভাবে একদিন পৃথিবীর বুক থেকে বিলীন হয়ে গেছে। বিখ্যাত মার্কিন ভূতত্ত্ববিদ শ্যালডন জুডসন ভূমিক্ষয়জনিত সমস্যাকে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেন। ১৯৬৮ সালে তাঁর গবেষণা থেকে তথ্য পাওয়া যায়, ভূমিক্ষয়ের কারণে প্রতিবছর প্রায় ২৪ হাজার মিলিয়ন টন মাটি নদীবাহিত হয়ে সমুদ্রের তলদেশে জমা হচ্ছে। প্রতিবছর পৃথিবীর প্রধান নদীগুলো দিয়ে প্রবাহিত সমুদ্রে জমা হওয়া মাটির পরিমাণ_চীনের হোয়াংহো নদী দিয়ে এক হাজার ৬০০ মিলিয়ন, ভারতের গঙ্গা নদী দিয়ে এক হাজার ৪৫৫ মিলিয়ন। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে ভূমিক্ষয়ের সমস্যা প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে ভুট্টা ও গমের চাষ করা হয় এমন জমিতে দীর্ঘদিন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে আমেরিকার বিজ্ঞানী লিওন লেসিস প্রমাণ পান যে জমির উপরিস্তর এক ইঞ্চি ক্ষয় হয়ে গেলে উৎপাদন ৬ শতাংশ কমে যায়। কিন্তু এ কথা তো সত্য যে উর্বর মাটির ক্ষয় মানে সে দেশের উন্নতির বা সভ্যতার ক্ষয়। প্রাণিকুলের বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান মাটি, যা প্রকৃতির অবারিত দান। প্রকৃতির সেই দানকে আমরা অজ্ঞতা, অদূরদর্শিতা আর বিবেকহীন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিনষ্ট করে ফেলছি। আগামী প্রজন্মের জন্য রেখে যাচ্ছি এক দুঃসহ সময়। সরিয়ে ফেলছি তাদের পায়ের তলার মাটি। আমাদের বংশধরদের জন্য এ মাটি আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে পরিবেশ। পরিবেশের অন্যতম উপাদান ভূমিক্ষয় রোধ করতে হলে পরিবর্তন করতে হবে আমাদের চাষের ধরন, বন্ধ করতে হবে বৃক্ষনিধন এবং সর্বোপরি জমিকে বিশ্রাম দিতে হবে।
মো. নূর-ই-আলম সিদ্দিকী

No comments

Powered by Blogger.