তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক-আলোচনার পথেই সমাধান খুঁজুন

বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিশ্বে অভিনব হিসেবেই স্বীকৃত। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে এ ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, যে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে এ পদ্ধতিকে সাংবিধানিক বৈধতা দেওয়া হয় তার নির্বাচন ছিল নিদারুণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।


১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন ছিল সম্পূর্ণ প্রহসনমূলক এবং প্রায় ভোটারবিহীন। টানা প্রায় দেড় মাস প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ওই সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান অনুমোদন দেওয়া হয় এবং এর আড়াই মাসেরও কম সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় আরেকটি সাধারণ নির্বাচন। পরের দুটি সংসদ নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। এসব নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল এবং তার ফলাফলে সরকারেরও পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য এখন পর্যন্ত অর্জন করা যায়নি। বর্তমান নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট দৃঢ়তার পরিচয় রেখে দায়িত্ব পালন করে চললেও তারাও পুরোপুরি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সত্তায় দাঁড়িয়েছে_ এমন দাবি করার উপায় নেই। এ প্রেক্ষাপটে সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে রায় প্রদান করলে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আদালতের রায়ের পর সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার সুযোগ নেই। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের কয়েকটি মিত্র দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে আগামীকাল রোববার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এর ধারাবাহিকতায় আরও হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ঘোষিত হতে পারে বলে জনমনে শঙ্কা প্রবল। আমরা মনে করি, বিরোধী দলগুলোর উচিত তাদের বক্তব্যের সমর্থনে জনমত সংগঠনে ভিন্ন ধরনের কর্মসূচি ও কৌশল গ্রহণ করা। জাতীয় সংসদে গিয়ে তাদের বক্তব্য প্রদানের সুযোগ রয়েছে এবং সেটা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে একটি কমিটি কাজ করছে এবং সেখানে বিএনপিরও বক্তব্য প্রদানের সুযোগ ছিল। রাজনৈতিক পাল্টাপাল্টি এবং প্রতিপক্ষের প্রতি আস্থাহীনতার মনোভাবের কারণেই হয়তো তারা এটা গ্রহণ করেনি। তবে এখনও আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি ফয়সালা করা অসম্ভব নয়। এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনা যেমন রয়েছে, তেমনি জনমতের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা যেতে পারে। সরকারেরও এ বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কারণেই অন্তর্ভুক্ত হয়। এ বিষয়ে জাতীয় সমঝোতা গড়ে তোলার জন্যও তারা সচেষ্ট ছিল। নতুন প্রেক্ষাপটে কোন পথে অগ্রসর হতে হবে তার নিষ্পত্তি এভাবেই হতে হবে। নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী করা অবশ্যই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। তবে পারস্পরিক আস্থার পরিবেশ সৃষ্টির জন্যও করণীয় রয়েছে এবং আলোচনার মাধ্যমেই তা অর্জন করতে হবে। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য এর আবশ্যকতা সবাই উপলব্ধি করে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার রদবদলের যে ব্যবস্থা আমাদের দেশে চালু হয়েছে তা কোনোভাবেই নস্যাৎ হতে দেওয়া চলে না। আমরা আশা করব, প্রধান দলগুলো আলোচনার পথেই সংকটের সমাধানে যত্নবান হবে এবং কোনোভাবেই জনজীবন ও অর্থনীতির জন্য দুর্দশার পথে দেশকে ঠেলে দেবে না।
 

No comments

Powered by Blogger.