আইভরি কোস্টে লাল-সবুজের পাশে-দ্রগবার ছবি স্বাগত জানাল by আনিসুল হক

ফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ তরুণটি একেবারে বাংলায় বললেন, ‘বসো। ক্যামেরার দিকে তাকাও। ধন্যবাদ।’ তরুণটি কাজ করেন জাতিসংঘের দপ্তরে—আইভরি কোস্টের আবিদজান শহরের জাতিসংঘের অভিযানের (ইউএনওসি) কার্যালয় এটি। ভবনটি একটি পাহাড়ের ওপরে, জাহাজের মতো এর স্থাপত্যশৈলী। দূর থেকে মনে হবে ওই সবুজ পাহাড়ের ওপরে ওই জাহাজটা উঠল কী করে? আর ওই কার্যালয় থেকে তাকালে দেখা যাবে অপূর্ব সুন্দর শহর আবিদজান, ওই যে দেখা যাচ্ছে নীল জলাধার, যা কিনা যুক্ত আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে।


আফ্রিকা মহাদেশের পশ্চিম দিকে আইভরি কোস্ট, যদিও অতলান্ত মহাসাগর পড়েছে দক্ষিণে। সেই দক্ষিণেই, মহাসাগর ঘেঁষে এই আবিদজান শহর। এটি নাকি আইভরি কোস্টের সবচেয়ে সুন্দর শহর, সবচেয়ে উন্নত; এটি রাজধানী না হয়েও রাজধানী। কারণ, প্রেসিডেন্ট এখানেই থাকেন।
গত বিশ্বকাপ ফুটবলে আমি ঘোষণা করেছিলাম, এবার আইভরি কোস্টও আমার চোখে ‘ফেভারিট’। একে তো খেলা হচ্ছে আফ্রিকা মহাদেশে, তার ওপর আইভরি কোস্টের আছেন বিখ্যাত ফুটবলার দিদিয়ের দ্রগবা। আইভরি কোস্ট বিশ্বকাপে খুব ভালো করেনি, তবে ২৩ জানুয়ারি ২০১২ সকাল নয়টার দিকে বিমানবন্দর থেকে আবিদজান শহরে ঢুকতেই দ্রগবার বিলবোর্ড যখন আমাকে স্বাগত জানাল, তখন মনটা ভালো হয়ে গেল। ১৮ ঘণ্টার বিরামহীন উড়াল শেষে এই অভ্যর্থনাই একজন আইভরি কোস্ট সমর্থকের পাওনা ছিল বৈকি। আর, তারপর জাতিসংঘের দপ্তরে পরিচিতিপত্র করতে গিয়ে যখন কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের মুখে দেখতে পাই উজ্জ্বল হাসি আর শুনতে পাই বাংলা বাক্য, তখন পথের ক্লান্তি দূর হতে বাধ্য।
আমরা ১০ জনের একটি দল এসেছি আইভরি কোস্টে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তি মিশনে সবচেয়ে বড় অংশগ্রহণকারী দেশ। এ মুহূর্তে সশস্ত্র বাহিনী থেকে সাড়ে আট হাজারের মতো, আর পুলিশসহ ধরলে ১০ হাজারের বেশি বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী জাতিসংঘের মিশনে বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। ১১৩টি শান্তিরক্ষী দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। সংখ্যার হিসাবে, সুনামের বিচারেও। সুনাম ছাড়া সংখ্যাবৃদ্ধিও হয় না। এর মধ্যে আইভরি কোস্টে বাংলাদেশের রক্ষীসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। পুলিশসমেত ধরলে আড়াই হাজারের মতো।
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের কাজকর্ম ও সুবিধা-অসুবিধা দেখার জন্য সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা আর গণমাধ্যমকর্মী মিলে ১০ জনের একটি দল যাচ্ছে। এতে আমাকেও আমন্ত্রণ জানানো হলো। দ্রগবার দেশটিকে বিশ্বকাপে সমর্থন করেছিলাম বলে এই আমন্ত্রণ, নাকি দুই ছত্র লিখি বলে—তা আর খোঁজ নিতে যাইনি। বাংলাদেশের ওভারসিজ অপারেশন পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সেলিমের নেতৃত্বাধীন দলের পাশে নিজেকে শামিল করেছি।
২২ জানুয়ারি রাতে শাহজালাল বিমানবন্দর ছেড়েছি। কিন্তু এই যাত্রায় আমার প্রথম কাজটি ছিল একটি ইনজেকশন নেওয়া। ইয়েলো ফিভারের প্রতিষেধক। সুচ ফোটানোর সময় সিএমএইচের ডাক্তার বলেছিলেন, বেশ শক্ত হাত, ব্যায়াম করেন নাকি? এর চেয়ে মধুর মিথ্যা আমি আর জীবনে শুনিনি, শুনে লজ্জিত ভঙ্গিতে বললাম, ১৫ দিন হলো জিমে যাই। দ্বিতীয় কাজটি করতে হয়েছে ম্যালেরিয়ার ওষুধ আরম্ভ করে দেওয়া। আফ্রিকার ম্যালেরিয়া নাকি সাংঘাতিক। এখানকার আড়াই হাজার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীর অন্তত ১০ জন প্রতি সপ্তাহে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন।
হাতে-পায়ে মশক-তাড়ানিয়া ওষুধ মেখে এই লেখাটি লিখছি। রাত তিনটায় ঘুম ভেঙে গেছে, তাই হওয়ার কথা, কারণ বাংলাদেশে এখন বাজে সকাল নয়টা। মিয়া, কত ঘুমাইবা?
২২ জানুয়ারি শাহজালাল বিমানবন্দরেই দেখি, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর পোশাকপরা প্রায় ১৬০ জনের দল অপেক্ষা করছে। তাঁদের বাহুতে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকার ব্যাজ। তাঁরাও যাচ্ছেন আইভরি কোস্টে। তাঁদের বিদায় দিতে এসেছেন পরিবার-পরিজনেরা। বৃদ্ধা পিতা-মাতা এসেছেন কারও, স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কাউকে কাউকে বিদায় দিচ্ছেন। যেকোনো টার্মিনালে এ খুব সাধারণ দৃশ্য। কিন্তু যখন বাবার হাত থেকে সন্তানের হাতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, আর স্বামীর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন স্ত্রী, সৈনিকটি আস্তে আস্তে ইমিগ্রেশন পার হয়ে অদৃশ্য হয়ে চলে যায়, বুকের মধ্যে কেমন যেন লাগে।
স্থানীয় সময় সকাল নয়টায় প্লেন আবিদজানের মাটি ছুঁল।
ইউএন লেখা গাড়িতে আমরা চললাম জাতিসংঘের দপ্তরের সেই জাহাজরূপী ভবনটির দিকে। সেবরোকো নামের এলাকার এই চত্বরের ভেতরেই বাংলাদেশের সৈন্যদের একটা কোম্পানি আছে, ২১০ জনের দল নিয়ে, লে. কর্নেল আফজালের নেতৃত্বে। তাঁদের কাজ জাতিসংঘের এই দপ্তরটি, যা ইউএনওসি (ওঁরা বলেন, উনোচি) বলে পরিচিত, তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আইভরি কোস্টে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী দলের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মাহবুবুল হক। এখানকার একজন সেক্টর কমান্ডার। তিনি আমাদের স্বাগত জানালেন।
আইভরি কোস্ট ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ফরাসি উপনিবেশ ছিল। এখানকার ভাষা ফরাসি। যদিও হয়তো স্থানীয় ভাষাও কয়েকটি প্রচলিত। ফ্রান্সের সৈন্য এখানে বহাল আছে। বিমানবন্দর থেকে আসার পথে কাঁটাতারের বেড়াঘেরা ফরাসি সৈন্যাবাসটা দেখা গেল।
আইভরি কোস্টকে এরা বলে কুতদি ভোয়া। এ দেশের রাজধানী ইয়ামোসুকরো। ওখানে প্রেসিডেন্টের বাড়ির চারদিকে কুমিরভরা পরিখা আছে। তবে এখনকার প্রেসিডেন্ট আবিদজানে থাকেন। দেশটি বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় আড়াই গুণ বড়, লোকসংখ্যা বাংলাদেশের ১০ ভাগের এক ভাগ। দেশটি একসময় হাতির দাঁতের জন্য বিখ্যাত ছিল, কিন্তু এখন সেসবের চিহ্ন নেই। অধিবাসীদের ৩৭ ভাগ মুসলিম, ৩৭ ভাগ খ্রিষ্টান। এ দেশে কোকোয়া উৎপাদন হয় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এখন আমাদের দেশে শীত, এই দেশে গরম। আর বাতাস খুব শুকনো। গাছপালা, ফুলফল অনেকটাই বাংলাদেশের মতো। এখানকার বাংলাদেশি সেনাকর্তারা বারবার বলছেন, আফ্রিকা আর আমাদের উপমহাদেশ একই ভূখণ্ডে ছিল বলে যে মতটা প্রচলিত আছে, এই গাছপালা দেখলে তা বোঝা যায়।
২০১০ সালে দেশে নির্বাচন হয়েছে, এখন পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। তার আগে এই দেশে হয়েছে গৃহযুদ্ধ। রাতের বেলা লেগুনের ঠিক পাশে ‘লা তেরাস’ নামের রেস্তোরাঁয় আমরা নৈশভোজ করছিলাম, আর জলাধারের ওই পারের আলোর পসরা দেখে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। ওই সময় অনেক সেনাকর্তা বললেন, গৃহযুদ্ধের সময়ে, গোত্রে গোত্রে সহিংসতার নানা নিষ্ঠুর নজির তাঁরা দেখেছেন, মানুষকে আগুনে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বাহিনীর পোস্টের কাছেও প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে গুলি করতে করতে স্থানীয় বিবদমান দলগুলো ছোটাছুটি করত। এখন তো পরিস্থিতি শান্ত।
এই দেশে থাকব দিন দশেক। বিভিন্ন প্রান্তে যেখানেই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা আছেন, সেখানে যাওয়ার কথা। কাজেই ভবিষ্যতে আইভরি কোস্টের রাজনীতি, গৃহযুদ্ধ, সংঘাত আর বাংলাদেশিদের ভূমিকা নিয়ে আরও কথা বলা যাবে।
শুধু এটুকুই আজ বলি, বাংলাদেশের রক্ষীদের মনোবল খুব উঁচু, প্রশংসা সর্বত্র, এটাকে তাঁরা নিজেকে গড়ে তোলা, বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে কাজ করে অভিজ্ঞ হওয়া এবং দেশে দেশে শান্তিরক্ষার মহান ব্রত নিয়ে কাজ করার একটা চমৎকার সুযোগ হিসেবেই দেখছেন। আমরা যেখানটায় আছি, সেখানকার দেয়ালে লেখা, প্রাউড টু বি আ পিসকিপার।
তবু দেশের কথা মনে করেন সবাই। এক বছরের জন্য শান্তিরক্ষা মিশনে আসেন তাঁরা। এখন অনেকেরই ফেরার সময় হয়ে এল। তাঁরা প্রতিটি ঘণ্টা হিসাব করছেন, কবে দেশে ফিরবেন। মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানেরা যে মুখ চেয়ে আছেন। মেজর ইশরাত এবং লে. (নেভি) ফারজানা আমাদের সঙ্গে একই ফ্লাইটে এসেছেন, দুজনেই বললেন, দেশে তাঁরা দুই বছরের সন্তান রেখে এসেছেন।
নিজেদের পারিবারিক সুখ বিসর্জন দিয়ে তাঁরা পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের কাজ করছেন। দেশের জন্য সুনাম, মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বয়ে আনছেন। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০০৫ থেকে ২০১০ সালে সশস্ত্র বাহিনীর শান্তিরক্ষীরা ৮৪ কোটি ডলারের বেশি টাকা দেশে পাঠিয়েছেন।
আবিদজান শহর দেখতে বেরিয়ে গাড়ি থেকে নামছি অরকা নামের একটা মার্কেটের সামনে। আফ্রিকান তরুণেরা গাড়ির দরজা খুলে দিতে দিতে সম্ভাষণ করছেন, বাংলা? কেমন আছেন? আসেন, আসেন। ধন্যবাদ।
বিদেশিদের মুখে বাংলা শুনতে কার না ভালো লাগে!

No comments

Powered by Blogger.