পার্বত্য চট্টগ্রাম-ঘরের সমস্যা ঘরেই সমাধান সম্ভব by অভয় প্রকাশ চাকমা

পার্বত্য চুক্তিবিরোধীদের কথা আমলে নিয়ে যদি ১৯৯৭ সালে সরকার চুক্তি না করত, দেশের সামগ্রিক অবস্থা কেমন হতো? পার্বত্য চট্টগ্রামের রক্ত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ত, যুদ্ধের ভারে নাজুক হতো দেশের অর্থনীতি। লাভবান হতো কিছু যুদ্ধবাজ নেতা ও কর্মকর্তা।


কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসবের কোনো কিছুকেই সুযোগ না দিয়ে রাজনৈতিক দূরদর্শিতাগুণে করে ফেলেছিলেন ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি


দেশে কোনো আদিবাসী নেই বলা হলেও অন্য বছরের চেয়ে আরও অধিক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে দেশে পালিত হলো এবারের আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। দেশের আনাচে-কানাচে যেখানেই আদিবাসী রয়েছে সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ দিবস উদযাপন করেছে। এবারের মতো কোনো বছরই এত সাড়ম্বরে এবং সমন্বিতভাবে দিবসটি পালিত হয়নি। ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রত্যেক আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব ছিল। স্থানীয়ভাবেও প্রত্যেক সম্প্রদায় দিবসটি উদযাপন করেছে। তবে এবারের আদিবাসী দিবসে আনন্দের সঙ্গে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও বেশ লক্ষণীয়।
দেশের আদিবাসীদের নিয়ে বেশ বিতর্ক চলছে। দেশে ভিন্নভাষী যেসব জাতিগোষ্ঠী আছে তারা আদিবাসী নয়, আর আদিবাসী আছে কিন্তু স্বীকৃতি দিলে দেশের অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়বে, এ দুটি ভিন্ন বিষয়। বিষয় দুটি নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে।
আদিবাসী দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান আক্ষেপ করে বলেছেন, 'আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ বছর আইন পড়িয়েছি, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, এ দেশে বাসকারী ভাষাগত সংখ্যালঘু সবাই আদিবাসী। আমি কী করে তাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারি!' এ বক্তব্যের বিপক্ষে কোনো অধুনা আদিবাসী বিশেষজ্ঞ বা বিরোধিতাকারী কিছু বলেননি। নিশ্চিত হওয়া যায় যে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দেশের ভিন্নভাষী জাতিগোষ্ঠী সবাই আদিবাসী।
আদিবাসী বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষক ও নৃবিজ্ঞানী যে মতামত দিয়েছেন, জাতিসংঘে কর্মরত গবেষকরাও সে মতামত দিয়েছেন। তাতেও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় এ দেশের সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী সবাই আদিবাসী। এ বিষয়ে বহু উদ্ধৃতি আগে বিভিন্ন নিবন্ধে উল্লেখ করেছি, গিলিত চর্বণ আর করতে চাই না। জনশ্রুতি আছে, ঘুমন্ত লোককে জাগানো যায়, ঘুম ভানকারীকে জাগানো যায় না।
দেশে আদিবাসীরা যে অভিধায়ই আখ্যায়িত হোক, জাতিসংঘে আদিবাসী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘে অনুমোদিত সনদ মানতে বাধ্য। জাতিসংঘ বাংলাদেশের ভিন্নভাষী জাতিসত্তাকে আদিবাসী হিসেবেই গ্রহণ করেছে। আদিবাসী স্বীকৃতি দেওয়া হলে স্বাধিকার দিতে হবে বলে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। স্বাধিকার শব্দটিকে স্বাধীনতার অনুরূপ শব্দে পরিণত করা হচ্ছে।
জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত অধিকাংশ অধিকার পার্বত্য আদিবাসীরা ভোগ করছে। ১৯৮৯ সালের স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন এবং পরে আঞ্চলিক পরিষদ আইন, পার্বত্য চুক্তি এগুলো আদিবাসীদের স্বাধিকারের অংশ। পার্বত্য আদিবাসীদের এত অধিকার দিয়ে কি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে? বিশ্বের আদিবাসী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কোনো দেশের আদিবাসী অধ্যুষিত ভূখণ্ড কি আলাদা হয়ে গেছে? এটাই কি বুঝে নিতে হবে দেশের যারা আদিবাসীদের বিরোধিতা করছেন তারা আদিবাসীদের অস্তিত্ব চান না?
অনেক বাধা ও সমালোচনা সত্ত্বেও ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তি করেছে। এ চুক্তির সময়ও একই অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু চুক্তির পর তাদের সেই অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তারপরও আদিবাসীদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতার অভিযোগ থামেনি। আদিবাসীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া থেকে সরকারকে নিবৃত্ত করা গেছে। পার্বত্য চুক্তি থেকে তৎকালীন সরকারকে নিবৃত্ত করা না গেলেও চুক্তি বাস্তবায়ন ঠেকানোর জন্য একই মহল এখন ভিন্ন অবস্থান থেকে উঠে-পড়ে লেগেছে।
পার্বত্য চুক্তিবিরোধীদের কথা আমলে নিয়ে যদি ১৯৯৭ সালে সরকার চুক্তি না করত, দেশের সামগ্রিক অবস্থা কেমন হতো? পার্বত্য চট্টগ্রামের রক্ত দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ত, যুদ্ধের ভারে নাজুক হতো দেশের অর্থনীতি। লাভবান হতো কিছু যুদ্ধবাজ নেতা ও কর্মকর্তা। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসবের কোনো কিছুকেই সুযোগ না দিয়ে রাজনৈতিক দূরদর্শিতাগুণে করে ফেলেছিলেন ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি।
বিশ্বের অনেক দেশের সংঘটিত বিদ্রোহের অবসান ঘটাতে মধ্যস্থতাকারী তৃতীয় পক্ষ দেখা গেছে। রাজনৈতিক সংকট মেটাতে এবং যুদ্ধরত উভয় পক্ষকে সমঝোতায় নিয়ে আসতে মধ্যস্থতাকারীর প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু দেশের কুশলী রাজনীতিক শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনার ভার গ্রহণের দুই বছরের মধ্যে কোনো মধ্যস্থতাকারী ব্যতিরেকে নিজ উদ্যোগে শান্তিচুক্তি করে রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিয়েছেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা না থাকলে দুই দশক ধরে চলা পার্বত্য অসন্তোষ ও সশস্ত্র সংগ্রাম এত স্বল্প সময়ের মধ্যে থামানো যেত না।
তবে ১৯৯৬ সালের শেখ হাসিনার গৌরবময় নেতৃত্ব এবারের মেয়াদে পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যা খুবই আশ্চর্যজনক। আদিবাসীদের দাবি এখন জাতিসংঘে চলে গেছে। দেশের আদিবাসীদের দাবি কি এতই অপূরণীয় যে তাদের দেশের বাইরে জাতিসংঘে যেতে হলো?
বিরোধী দলসহ প্রভাবশালী বিভিন্ন মহলের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও তৃতীয় কোনো পক্ষের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকে সেদিন শেখ হাসিনা পার্বত্য শান্তিচুক্তি করে বিরোধিতাকারীদের আপত্তি ও অভিযোগ ভুল প্রমাণিত করেছেন। আন্তরিকতা ও দূরদর্শিতা না থাকলে এ চুক্তি কখনও সম্ভব ছিল না। পার্বত্য চট্টগ্রামের সশস্ত্র আন্দোলনে ভারতের পরোক্ষ সমর্থন ছিল, যুদ্ধের সময় অর্ধলক্ষাধিক শরণার্থীকে ভারত আশ্রয় দিয়েছিল।
সশস্ত্র সংগ্রামে সৃষ্ট অন্তর্দ্বন্দ্বের কারণে বেশ কয়েকজন নেতা ভারতে স্থায়ীভাবে চলে গেছেন। চুক্তির আগে সমঝোতা বৈঠক চলাকালীন অনেকে মনে করেছিলেন তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ভারতের অংশগ্রহণ থাকবে। কিন্তু তৃতীয় পক্ষের মোড়লিপনার কোনো সুযোগ না দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সফলভাবে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, নিশ্চিত দীর্ঘস্থায়ী এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থেকে দেশকে রক্ষা করেছেন।
কিন্তু বহুল প্রশংসিত সেই শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কেন বিদেশি সংস্থা সরকারকে আহ্বান জানাবে, অন্য দেশ কেন চাপ দেবে? আদিবাসী ইস্যুতে কেন জাতিসংঘের কোনো সংস্থা নাক গলানোর সুযোগ পাবে? চুক্তি বাস্তবায়ন এবং আদিবাসী ইস্যু দুটিই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বিষয় দুটি সুরাহা করতে তৃতীয় কোনো পক্ষের প্রয়োজন নেই। ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির মতো দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞাবলে তৃতীয় কোনো পক্ষকে সুযোগ না দিয়ে নিজ দেশের সমস্যা নিজে সমাধান করে বিরোধিতাকারীদের অমূলক আশঙ্কাকে আরেকবার ভুল প্রমাণিত করবেন কি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?

অভয় প্রকাশ চাকমা : কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.