চিকিৎসা-সব অসুখে ওষুধ লাগে না by নুরুল ইসলাম

ব্যবস্থাপত্রে ভরপুর দরিদ্র বাংলাদেশে অসংখ্য ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ অসহায়ভাবে অযৌক্তিক ব্যবস্থাপত্রের শিকার হয়ে পড়ে। এতে তাদের মানসিক, শারীরিক এবং আর্থিক ক্ষতি হয়, এ জন্য দায়ী শুধু ব্যবসায়ীমহল নয়, যারা ব্যবস্থাপত্র লেখেন তারাও। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা যাতে জনসাধারণের কল্যাণে আসে এটি রক্ষা করা চিকিৎসকের নৈতিক দায়িত
ব্যাধিগ্রস্ত অগণিত মানুষের রোগমুক্তির জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার ব্যবস্থাপত্র বা প্রেসক্রিপশন লেখা হয়। উদ্দেশ্য
রোগমুক্তি অর্থাৎ উপশম। যে রোগ দুরারোগ্য এবং যে ব্যক্তি মৃত্যুর মুখোমুখি, যতটুকু সম্ভব তাদের কিছুটা কষ্ট লাঘব করা একটা নীতিগত ব্যাপার। এককথায় ব্যবস্থাপত্রের প্রথম এবং প্রধান উদ্দেশ্য ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের রোগ নিরাময়ে সাহায্য করা এবং সম্ভব না হলে কষ্ট লাঘব করা। এ উদ্দেশ্য সব সময় নীতিগত এবং মানগত দিক দিয়ে আমরা পালন করে আসছি। একটা ব্যবস্থাপত্র লেখার ব্যাপারে চিকিৎসক, ওষুধ ব্যবসায়ী এবং রোগী_ এ তিন পক্ষ সরাসরি অথবা কোনো না কোনোভাবে জড়িত। ব্যবসায় প্রসার লাভ প্রতিটি ব্যবসায়ীরই কাম্য। কোন ওষুধ কী পরিমাণে তৈরি হবে তা নির্ধারণ করা হয় বাজারের চাহিদা অনুযায়ী। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এগুলোকে সব সময় বিচার করে দেখা হয় না। ফলে যেখানে হাজার হাজার অপ্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে বাজারভর্তি, সেখানে জীবনরক্ষাকারী অনেক ওষুধই পাওয়া যায় না। রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রায়ই প্রচার করা হয়, জীবনরক্ষাকারী ওষুধ কোনো সহৃদয় ব্যক্তি দিতে পারলে রোগীর জীবন রক্ষা করা যেতে পারে। এসব রহস্যের ধূম্রজাল কে বা কারা তৈরি করছে তা সহজেই অনুমেয়। বুদ্ধিমান ব্যবসায়ীমহল নিজেদের তৈরি বিভিন্ন ওষুধের চাহিদা বাড়ানোর জন্য যারা ব্যবস্থাপত্র লেখেন তাদের প্রভাবিত করার বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে থাকে। কাগজে আকর্ষণীয়ভাবে এমন সব অবাস্তব তথ্য তুলে ধরা হয়, যা প্রাথমিক দৃষ্টিতে সত্য মনে হবে। চিকিৎসাক্ষেত্রে যারা অর্বাচীন, অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত তারাই বেশি প্রভাবান্বিত হয়ে থাকেন। সুন্দর কাগজে বাহারি লেবেলের ওপর বিভিন্ন উপাদানের সুদীর্ঘ তালিকা ও চাহিদার বিজ্ঞাপন সহজ-সরল জনগণের ওপর নিঃসন্দেহে প্রভাব বিস্তার করে। কাজেই এটি অস্বাভাবিক হলেও সত্য যে, অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপত্র লেখার আগে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ শেষে এক বা একাধিক ওষুধ লেখার জন্য রোগীরাই অনুরোধ জানান। যেমন ধরুন_ রক্তের ওষুধ, হজমি ওষুধ, ঘুমের ওষুধ, মাথাব্যথার ওষুধ, স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর ওষুধ ইত্যাদি। পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে ১৯৮১ সালেই বিভিন্ন ধরনের অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের জন্য খরচ হতো ১৫৩ কোটি টাকা। আর বাজারজাত হতো প্রায় চার হাজারের মতো বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। এগুলোর অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয়, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক। এমন এক দুঃখজনক পরিস্থিতিতে একটি জাতি বেশিদিন নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে পারে না। শুধু সরকারের ওপর দায়িত্ব দিয়ে নিজের গা বাঁচিয়ে চললে এটিকে নৈতিক দিক দিয়ে সমর্থন দেওয়া যায় না। আমরা যারা ব্যবস্থাপত্র লিখি তাদের উদ্দেশ্য যদি রোগের উপশম হয় তাহলে সেদিকে আমরা কতটুকু ভুলের মধ্যে এখনও ডুবে আছি একটি দৃষ্টান্ত তা-ই প্রমাণ করবে। কিছুদিন আগে কোনো একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের একজন পদস্থ কর্মচারী চিকিৎসার জন্য আমার সঙ্গে দেখা করেন। অনিদ্রা, বুক ধড়ফড় করা, বদহজম, মাথাব্যথা, হাত-পায়ে ঝিনঝিন করা_ এগুলোই ছিল তার প্রধান উপসর্গ। বিগত সাত-আট মাস ধরে একে একে চার পাঁচজন চিকিৎসকের পরামর্শ তিনি নেন। বিভিন্ন রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অনেক ব্যবস্থাপত্র তাকে দেওয়া হয়। ঘুমের বড়ি, হজমি টনিক, ভিটামিন ইনজেকশন ইত্যাদি ওষুধ বিভিন্ন সময়ে দেওয়া হয়েছে। সব ওষুধের তালিকা একসঙ্গে যোগ করলে প্রায় অর্ধশতকের কাছাকাছি হবে অথচ রোগের উপশম হয়নি। রোগীর ভিড়ের মধ্যে আগাগোড়া রোগের ইতিহাস শোনা এবং পারিবারিক ও পারিপাশর্ি্বক অবস্থার বিশদ বিশ্লেষণ করে দেখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়_ এই ভেবে ভদ্রলোককে অনুরোধ জানালাম সবকিছু নিজ হাতে লিখে সে যত লম্বাই হোক, আমার সহকর্মীর কাছে একসময় রেখে যেতে। সপ্তাহখানেক পর আমার সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সময় ধার্য করা হলো। তিনি নির্দেশনা অনুযায়ী দু'এক দিনের মধ্যেই সব ইতিহাস এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক ঘটনা লিখে অঙ্গীকার অনুযায়ী কাজ করলেন। এর মধ্যে তার ইতিহাস সম্পূর্ণ পড়ে নিয়ে যেখানে যেখানে দরকার লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত করলাম। নির্ধারিত দিন তিনি এলেন। রোগীর ইতিহাস পাশের ড্রয়ার থেকে তুলে নিয়ে তাকে দেখালাম। বললাম আর কোনো ওষুধ দরকার নেই। অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আপ্রাণ চেষ্টা করেও মতের মিল ঘটাতে না পারায় তার এ উপসর্গ দেখা দিয়েছে। ওষুধের ব্যবহারে এগুলোর উপশম হবে না।
অবস্থার সঙ্গে খাপ খাইয়ে, এমনকি কিছুটা দুঃখজনক পরিস্থিতিকে সত্য করে নিতে হবে; নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছি_ এ মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মানসিক শান্তি থেকে দৈহিক শান্তি আসবে। ট্যাবলেট কিংবা টনিক দিয়ে কোনো দিনও উপশম হবে না। বরং অহেতুক অর্থব্যয়ে পারিবারিক অশান্তির সৃষ্টি হতে পারে। আমার এসব কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারায় পরিবর্তন দেখতে পেলাম। কিছুক্ষণ আগেকার বিমর্ষ আশঙ্কাজড়িত ভদ্রলোকের চোখে-মুখে হাসি ফুটে উঠল। অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে এবং আর ওষুধ ব্যবহার করবেন না_ এ অঙ্গীকার করে তিনি বিদায় নিলেন।
ব্যবস্থাপত্রে ভরপুর দরিদ্র বাংলাদেশে অসংখ্য ব্যাধিগ্রস্ত মানুষ অসহায়ভাবে অযৌক্তিক ব্যবস্থাপত্রের শিকার হয়ে পড়ে। এতে তাদের মানসিক, শারীরিক এবং আর্থিক ক্ষতি হয়, এ জন্য দায়ী শুধু ব্যবসায়ীমহল নয়, যারা ব্যবস্থাপত্র লেখেন তারাও। মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা যাতে জনসাধারণের কল্যাণে আসে এটি রক্ষা করা চিকিৎসকের নৈতিক দায়িত্ব। সীমিত আর্থিক সঙ্গতির সঙ্গে অবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপত্র তৈরি করে সামাজিক সংঘাত। এর প্রতিবিধান করা আমাদের জাতীয় কর্তব্য। নিতান্ত অসহায়, অনেকাংশে নিরুপায় রোগীদের সমস্যাজর্জরিত না করে সংকটমুক্ত করাকে নৈতিকভাবে এবং বিবেক ও অনুভূতির মাধ্যমে বিচার করতে হবে। রোগ থাকলে রোগের মূল উদ্ঘাটন না করে ব্যবস্থাপত্রের পর ব্যবস্থাপত্র লিখে সংকটের সৃষ্টি করা একটি অমার্জনীয় অপরাধ। রোগী এলেই যে ব্যবস্থাপত্র দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অসুখ হলেই ওষুধ লাগবে_ এমনও কোনো কথা নেই।

ডা. নুরুল ইসলাম: জাতীয় অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.