বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে নতুন যাত্রা-মিয়ানমার by ব্যারটিল লিন্টনার

মিয়ানমার অবশ্য চীনের দিক থেকে পুরোপুরি মুখ ঘুরিয়ে ফেলতে পারে না। দুই দেশের রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে অনেক দূরের শক্তি। দৈনন্দিন ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে গেলে মিয়ানমারকে তার নিকট প্রতিবেশী দেশকে লাগবেই। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের বেলায় সে দায় নেই।


সে কারণে মিয়ানমারের কাছে চীনের
সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের
গুরুত্ব অপরিসীম

যুক্তরাষ্ট্র এবং মিয়ানমারের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। গত ১৩ জানুয়ারি মিয়ানমার সরকারের দুই শতাধিক রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তিদান এবং এর পরপরই দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পাঠানোর প্রস্তুতির কথা ঘোষণা করা এই উদ্যোগের সর্বশেষ উদাহরণ। ১৯৮৮ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গণতন্ত্রপন্থি আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করা ও ১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত দেশটির সাধারণ নির্বাচনে ন্যাশনাল লীগ ফের ডেমোক্রেসির নিরঙ্কুশ বিজয়কে দেশটির সেনা শাসকরা অগ্রাহ্য করার পর যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের প্রচণ্ড সমালোচকে পরিণত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা দেশটির সেনা সরকার ও তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের ওপর বাণিজ্যিক এবং আর্থিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
গত ডিসেম্বরের প্রথম দিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন মিয়ানমার সফর করেন। তার এই সফর ছিল অর্ধশতাব্দীর মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের কোনো মার্কিন কর্মকর্তার প্রথম মিয়ানমার সফর। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল প্রেসিডেন্ট থেইন শেইনের নেতৃত্বাধীন মিয়ানমারের নতুন সরকারের গণতান্ত্রিক সংস্কারের তিনি প্রশংসা করেন। গণতন্ত্রপন্থি আইকন অং সাং সু চির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় হিলারি বলেন, মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছে দেখে তিনি উৎসাহবোধ করছেন। হিলারির সঙ্গে আলোচনার সময় থেইন শেইন চীনের সঙ্গে তার দেশের সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরেন এবং এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অভিপ্রায় জানার চেষ্টা করেন। মিয়ানমারের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্কও যুক্তরাষ্ট্রের আরেক উদ্বেগের বিষয়। ২০০০ সালের প্রথম দিক থেকে প্রতি মাসে অন্তত একবার উত্তর কোরিয়ার জাহাজ মিয়ানমারের বন্দরে ভিড়েছে। শিপিং রেকর্ড অনুযায়ী জাহাজগুলো সিমেন্ট ও সাধারণ মালপত্র পরিবহন করে। এগুলো ফেরার সময় সেখান থেকে চাল নিয়ে যেত। অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশ দুটির মধ্যে পণ্য বিনিময় পদ্ধতি চালু ছিল। মিয়ানমারের কাছে যথেষ্ট চালের মজুদ থাকত। আর উত্তর কোরিয়ার ছিল খাদ্য সংকট। উত্তর কোরিয়ার হাতে বৈদেশিক মুদ্রাও তেমন থাকত না। তাই তারা পণ্য বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যবসা চালাত। তাছাড়া উভয় দেশের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সহায়তাও পেত না।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, উত্তর কোরিয়ার মিয়ানমারে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি হস্তান্তর ও সেখানে তাদের জনবল প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষকদের পাঠানো। উত্তর কোরিয়ার সহায়তায় মিয়ানমারের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি আঞ্চলিক কৌশলগত ভারসাম্যকে জটিল করবে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে গোপন সম্পর্ক ত্যাগ করার আহ্বান জানায়। তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার শর্তের মধ্যে এটিও রয়েছে।
তবে সম্পর্ক আরও স্বাভাবিক হয়ে এলে দেখা যাবে, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে গোপন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির প্রকল্প থেকে সরে আসা, মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নই কেবল যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে নেই, এর সঙ্গে আরও কৌশলগত বিষয়ও রয়েছে। ১৯৮৯ সালের মার্চের পর থেকে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন নতুন কৌশল অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এশিয়া গুরুত্বপূর্ণ। রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের কয়েক মাস পর মিয়ানমারে নিযুক্ত তৎকালীন রাষ্ট্রদূত বারটন লেভিন ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছিলেন, দেশটিতে যেহেতু কোনো মার্কিন সামরিক ঘাঁটি নেই, সেহেতু দেশটিতে তেমন স্বার্থও নেই। তাই এখানে ওয়াশিংটন তার আদর্শ আপস করে থাকার কোনো মানে হয় না।
এর পরের বছর বারটন মিয়ানমার ছেড়ে যান, সেই থেকে দেশটিতে আর কোনো রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া হয়নি। আর এরপর থেকে মিয়ানমার চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক অংশীদারিত্বের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়াস পায়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, পশ্চিমা দেশগুলোর এ ধরনের বিচ্ছিন্নকরণ নীতি প্রয়োগের কারণেই দেশটি তার প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে উৎসাহী হয়। মিয়ানমার থেকে ভারত মহাসাগরের মধ্য দিয়ে চীনের পরিকল্পিত গ্যাস ও তেল পাইপলাইন নির্মাণ এবং তার সম্ভাব্য নিরাপত্তা ছাতার ব্যবস্থা ভারত তার জন্য উদ্বেগজনক বলে মনে করে।
তাই যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তন ও সেখানে তার রাষ্ট্রদূত পাঠানোর এটাই প্রকৃষ্ট সময়। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারকে কী কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেটা অনুমানের বিষয়। তবে মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা আংশিক প্রত্যাহার ও দেশটিকে আন্তর্জাতিক অর্থ প্রতিষ্ঠানগুলোর নাগাল পেতে অনুমোদন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। যতদূর মনে হয়, মিয়ানমার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর প্রমাণ হিসেবে গত ৩০ সেপ্টেম্বর মিয়ানমার সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করা যায়। এ সময় মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট কাচিন প্রদেশে চীন সমর্থিত ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের মাইতসোন যৌথ বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ করার ঘোষণা দেন।
এটা ভুলে গেলে চলে না যে, চীন ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দিকে মিয়ানমারের কমিউনিস্ট বিদ্রোহীদের ব্যাপক সমর্থন দিয়েছিল। অতিসম্প্রতি অবৈধ চীনা অধিবাসীদের ব্যাপকভাবে মিয়ানমারে আসা ও সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি ভূমি ক্রয় করে বাড়িঘর নির্মাণ ইত্যাদি নিয়ে চীনের ওপর মিয়ানমারের সাধারণ নাগরিকদের ক্ষোভ বাড়ছিল। এ নিয়ে সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে পর্যন্ত মতদ্বৈধতা দেখা যাচ্ছিল। এতে সাধারণ মিয়ানমার নাগরিকদের মধ্যে চীনবিরোধী জাতীয়তাবাদী সেন্টিমেন্ট দানা বাঁধে।
চীন সরকার এ কারণে মিয়ানমার সরকারকে চুক্তি ভঙ্গের দায়ে মামলা করার হুমকি দেয়। তবে বেইজিং শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখার নীতি গ্রহণ করে। বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়কে ইস্যু বানিয়ে চীন কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ দেশটিতে তার পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল ও গ্যাস নেওয়ার প্রয়োজনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায়নি। গত কয়েক বছর থেকেই চীনের ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীলতা নিয়ে মিয়ানমার সামরিক জান্তার মধ্যে অস্বস্তি ক্ষোভে পরিণত হওয়ার দিকে যাচ্ছিল এবং এ বিষয়টি অনেকটা প্রকাশ্যও হয়ে পড়ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে কিছু সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট থেইন শেইন ও সামরিক বাহিনী মনস্থির করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশটির ওপর এতটা কড়া নিষেধাজ্ঞায় যায়নি। তারা ২০১০ সালে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশটিতে কিছুটা বেসামরিক আদলের সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ওই সরকারকে স্বীকার করে নেয়। সম্প্রতি মিয়ানমার সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দান এবং ইন্টারনেট ও প্রেসের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত জোরদার হয়েছে। সরকার অং সাং সু চির নেতৃত্বাধীন লীগ ফর ডেমোক্রেসিকে আগামী এপ্রিলের উপনির্বাচনে অংশগ্রহণে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছে। এ ব্যাপারে কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট থেইন শেইন এবং অং সাং সু চির মধ্যে। সরকার সু চিকে ডেমোক্রেটিক আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সিস্টেমের জনপ্রিয় বিরোধিতাকারীর ভূমিকায় না রেখে দিয়ে তাকে আত্তীকরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
মিয়ানমার অবশ্য চীনের দিক থেকে পুরোপুরি মুখ ঘুরিয়ে ফেলতে পারে না। দুই দেশের রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন হচ্ছে অনেক দূরের শক্তি। দৈনন্দিন ব্যবসা-বাণিজ্যসহ দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে গেলে মিয়ানমারকে তার নিকট প্রতিবেশী দেশকে লাগবেই। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের বেলায় সে দায় নেই। সে কারণে মিয়ানমারের কাছে চীনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম।
চীন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিয়ানমারের নতুন সম্পর্কের ব্যাপারে কোনো প্রতিক্রিয়া এখনও পর্যন্ত দেখায়নি। তবে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কৌশলগত স্বার্থ নেই, সেটা বলার সময়ও শেষ হয়েছে। বরং মিয়ানমার ক্রমবর্ধমানভাবেই বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হচ্ছে। এই দেশটিকে ঘিরে চীন ও আমেরিকার স্বার্থ সংঘাত দানা বাঁধছে।

ব্যারটিল লিন্টনার : থাইল্যান্ডভিত্তিক সুইডিশ সাংবাদিক। খালিজ টাইমস ও আউটলুকে প্রকাশিত দুটি লেখার সংক্ষেপিত যুক্ত ভাষান্তর সুভাষ সাহা

No comments

Powered by Blogger.