নাইন-ইলেভেনের এক দশক by লুৎফর রহমান রনো

সপ্তাহে পত্রপত্রিকা বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় স্মরণ করা হয়েছে নাইন-ইলেভেনের মর্মান্তিক ঘটনাকে। এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে এমন একটি ঘটনা শক্তি-মদমত্ত যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণকেন্দ্রে ঘটে যাওয়ার কারণে পুরো বিশ্বে অবাঞ্ছিত অস্থিরতা শুরু হয়। এর পরিসমাপ্তি কী অবস্থায় ঘটবে, অথবা আদৌ এর রেশ কখনো শেষ হবে কি না_তা নির্ভর করে মার্কিন ক্ষমতাকেন্দ্রের সুদূরপরিকল্পিত চিন্তাভাবনার ওপর।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বরাজনীতির চালচিত্র ছিল মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ। এক দিকে জাপান ও ইউরোপীয় দেশগুলোর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অপর দিকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমরাস্ত্রের প্রতিযোগিতা চলছিল। মানবসভ্যতার ইতিহাসজুড়ে অশুভ শক্তির প্রতিযোগিতা বরাবরই ছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে অশুভর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিন্তা বা তত্ত্বজগতে যেমন অভূতপূর্ব মানবিকতার প্রসার ঘটেছিল, স্নায়ুযুদ্ধের সঙ্গে সমরাস্ত্র যেমন বেড়েছে, তেমনি চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞানের পাশাপাশি মানুষের সুকুমারবৃত্তির শিল্প-সাহিত্য ও চিত্রকলার বিকাশ ছিল সভ্যতার ইতিহাসে বিশাল সংযোজন। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ ছিল দর্শনে, বিজ্ঞানে, সাহিত্যে তথা মানবতার উত্তরণের জন্য তুলনামূলক সুফলা সময়। সেই সময়ব্যাপী আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে ইসরায়েলি আগ্রাসন, হত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতন ঠিকই চলছিল ফিলিস্তিনের নিরস্ত্র জনগণের ওপর। তেলসমৃদ্ধ সম্পূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য আমেরিকার পরোক্ষ কর্তৃত্ব বা আধিপত্যের মধ্যে চলে আসে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ায় গাদ্দাফি, মিসরে মুবারক_এসব স্বৈরশাসক আমেরিকার আশীর্বাদে সুদীর্ঘকাল শাসন করে আসছিল। ঠিকঠাক চলছিল সব কিছুই। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের জনগণ, বিশেষত বর্তমান তরুণ প্রজন্ম এই পরম্পরাগত স্বৈরশাসকদের মেনে নিতে পারছিল না। গণতন্ত্রের নৈতিক ও মানবিক নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নেওয়ার তৃষ্ণায় অস্থির হয়ে ওঠে আরব জগতের তরুণরা। শুরু হয় তিউনিসিয়া থেকে স্বৈরতন্ত্র হটানোর সফল আন্দোলন। আমরা দেখছি, আজ আমেরিকা ওই সব দেশের বিজয়ী জনতার পাশে গণতন্ত্রের কীর্তন করছে হাতে হাত মিলিয়ে।
সবারই জানা, সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আফগানিস্তান থেকে উৎখাত করার লক্ষ্যে লাদেনকে দিয়ে আল-কায়েদা সৃষ্টি ও তাদের অস্ত্রসজ্জিত করা হয়েছিল আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে। কিছুদিন আগে যে কথা হিলারি ক্লিনটন নিজেই স্বীকার করেছেন। মোল্লা ওমর গং ও লাদেন সোভিয়েত বাহিনীকে হটিয়ে দিলে আল-কায়েদা বা লাদেনের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। অতঃপর গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে খোদ সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক শাসনের আপাত অবসান ঘটে গেলে ঠাণ্ডা লড়াইসহ আমেরিকার প্রচারিত কমিউনিজমের ভূত সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন ও স্ব-স্বার্থ হাসিলের রাজনীতি অকার্যকর হয়ে পড়ে। যাহোক, স্নায়ুযুদ্ধকালীন সমরাস্ত্রের প্রতিযোগিতা বা কমিউনিজম ঠেকানোর জন্য পৃথিবীজুড়ে আমেরিকা-ইউরোপের যে সর্বক্ষণ সাজ সাজ অস্থিরতা বিরাজ করত, তা বন্ধ হয়ে যাওয়া ছিল কাঙ্ক্ষিত ও যৌক্তিক। কিন্তু দেখা গেল বিপরীত অবস্থা। মধ্যপ্রাচ্যের সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখল কেন এমন অতর্কিতভাবে ঘটল, প্রকৃত ঘটনা জানা অসম্ভব। মধ্যপ্রাচ্যকে জব্দ করা হলো সাদ্দামভীতি দিয়ে। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো টুইন টাওয়ারে শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা হলো। আল-কায়েদাকে দোষারোপ করে আফগানিস্তান যুদ্ধ ও ইরাক যুদ্ধ শুরু করা হলো_'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' ঘোষণা করা হলো। ইরানের বিরুদ্ধে চোখ রাঙানি, উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধেও অনুরূপ ধমকানি চলল আমেরিকার। পৃথিবীময় পুনর্বার অস্থিরতা, যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব ও সাজ সৃষ্টি হয়ে গেল। সবচেয়ে বড় কথা হলো, ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের দমন-পীড়ন বেড়ে গেল_ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে মুসলমানকে সন্ত্রাসী চিহ্নিত করার সূত্র ধরে। সম্পদশালী মুসলিম বিশ্বকে (মধ্যপ্রাচ্য) কবজা করে তো রেখেছেই। তদুপরি টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন তথ্যসাম্রাজ্য যে প্রচার-প্রচারণা (টাওয়ার ভেঙে পড়ার ভিডিওসহ) চালাল, তাতে ইসরায়েলের বর্বরতা ঢাকা পড়ে গেল? এমনকি আমেরিকার সৃষ্ট হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো কলঙ্কও বুঝি ম্লান হয়ে পড়ল_ভাবখানা যেন এমনই। বিশ্ববাসী কি আমেরিকার আধিপত্যবাদী রাজনীতির ছলাকলা টুইন টাওয়ার বিনাশের বদৌলতে ভুলে যাবে?
একবিংশ শতাব্দীর এই অশুভ সূচনার ভেতরেও ক্ষীণ আশার সঞ্চার করেছে আরব বিশ্বের তরুণ প্রজন্ম। আমেরিকার ক্ষমতাকেন্দ্রকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে নিশ্চয়ই। লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এডওয়ার্ড সাঈদ তাঁর 'কবে আমরা প্রতিবাদী হব' নিবন্ধের শেষে লিখেছিলেন, 'কেউ কি আছেন, যিনি একদিন প্রখর সূর্যালোকে বেরিয়ে এসে বলবেন, 'ডোনাল্ড রামসফেল্ড ও পল উলফোউইটজের হাতে আমাদের ভবিষ্যৎ রচিত হবে না, আমরা তা মানব না, আমরা তা প্রতিহত করব?' আমি আশা করি, আমার এই বাক্য কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ একজন হলেও শুনেছেন।' সশ্রদ্ধচিত্তে তাঁকে স্মরণ করে বলি, হ্যাঁ, আপনার কথা আজ সারা বিশ্ব শুনতে পাচ্ছে। আরব জনগণসহ পুরো পৃথিবীর মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠছে।
লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.