জনদুর্ভোগ-সদিচ্ছা প্রমাণের এটাই সুযোগ by এমএ হাসান

ব হাইওয়েতে স্থায়ী ও অস্থায়ী ডিভাইডার দিতে হবে। সে সঙ্গে সব ব্রিজ ও কালভার্টের দু'পাশে এবং দু'প্রান্তে লম্বা মজবুত রেলিং দিতে হবে। ব্রিজ ও কালভার্টের শুরু ও শেষে যেমন 'স্পিড ব্রেকার' থাকতে হবে, তেমনি ওজন মাপক ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিটি চেকপোস্টেও ওজন মাপক ব্যবস্থা, গতিরোধক বার এবং টোল ব্যবস্থা থাকতে হবে।


রাস্তায় চলাচলে লেন পদ্ধতি এবং 'ফাস্ট ট্রাক' পদ্ধতি চালু করতে হবে। স্কুল, অফিস ও কারখানার জন্য বাধ্যতামূলক বাসসহ পিক আওয়ারে নির্দিষ্ট পথে অগ্রাধিকার যাত্রার জন্য টোল পদ্ধতি চালু করতে হবে


ক্ষতবিক্ষত পথঘাট, বিপর্যস্ত পরিবহন ব্যবস্থা, নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাফিক ব্যবস্থা, নানা অপঘাত ও অব্যবস্থার কারণে জনদুর্ভোগ এবং মৃত্যু নিয়ে অনাবশ্যক তথা বিভ্রান্তিকর রাজনীতি পরিহার করে সামাজিক বিপল্গব সাধন ফলদায়ক হতে পারে_ এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এতে রাজনীতির আয়েশি মজা নেই। রাতারাতি নায়ক বা নেতা হওয়ারও সুযোগ নেই। কাজটা কষ্টসাধ্য এবং এর পেছনে নিরন্তর সময়, শ্রম ও মেধা দেওয়া প্রয়োজন। ফটকাবাজদের মতো আমাদের বুদ্ধিজীবীরা চটজলদি ফলাফল চান। দ্রুত রোগমুুক্তি সবারই কাম্য। কিন্তু ভেতর থেকে দেশকে রোগমুক্ত করে একটা সুস্থ সমাজ এবং সামগ্রিক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য প্রয়োজন মেধা ও নিরলস শ্রম।
একই সঙ্গে সরকারকে অর্থবহ 'প্রাইভেট পাবলিক পার্টিসিপেশন অ্যান্ড গুড গভর্নেস'কে কার্যকর করতে হলে জনগণকে আস্থায় নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিজেদের সপ্ত আকাশের জীব না ভেবে নানা মানবিক দুর্বলতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে ব্যর্থতায় পূর্ণ সাধারণ মানুষ মনে করতে হবে। মানুষের ব্যথার কান্না, স্বাভাবিক ক্ষোভ ও প্রতিবাদকে বিরোধিতা হিসেবে পাঠ করলেও চলবে না। আর সুস্থ বিরোধিতা রাজনীতির সংজ্ঞায় নিন্দনীয় নয় বরং গণতন্ত্রের স্বার্থে এর প্রয়োজন রয়েছে। নিঃসন্দেহে সুশাসন ও ন্যায়সঙ্গত কর্তৃত্বের অভাবে তথা রাষ্ট্রের সেবকদের দায়িত্ববোধের অভাব ও সর্বগ্রাসী দুর্নীতি বর্তমান সময়কার অরাজক পরিস্থিতি এবং নাগরিক দুর্ভোগের কারণ। প্রশাসনিক দুর্নীতির কথা সরকারের অনেকেই স্বীকার করেছেন। জনগণও দেখছে এবং পদে পদে অনুভব করছে।
রাস্তা নির্মাণ, নদী খনন, পরিবেশ রক্ষা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস সরবরাহসহ সব সেবাধর্মী কর্মে অব্যবস্থার কারণ কেবল সম্পদের অভাব নয়। এর সঙ্গে সরকার ও জনগণের দৃঢ় ইচ্ছা, সংকল্প, উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগে ব্যর্থতা ও নিঃস্বার্থ কর্মযজ্ঞের অভাব জড়িত। দুর্নীতি দমনে এবং উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে দেশপ্রেমিক জনগণকে আস্থায় নিয়ে সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে কর্ম সম্পাদন করতে পারলে দেশের মৌলিক সমস্যার অনেকগুলোরই সমাধান সম্ভব। স্থানীয় জনগণ যখন দুর্নীতি প্রতিরোধে সংঘবদ্ধ হবে এবং এগিয়ে আসবে, তখন সরকার যদি তাদের সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এবং আইনগত সমর্থন নিশ্চিত করে, তাহলে দেশের অনেক সমস্যা নিরসন হতে পারে।
প্রয়াত তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুতে সীমাহীন শোক একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তবে সব মৃত্যু বিশেষ করে সাধারণের নিত্য শোক, দুঃখ, অপমৃত্যু তথা দুর্ভোগকে সমভাবে মর্যাদা দেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রয়াত তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের আত্মার প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন সম্ভব। এ দেশের বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই স্বার্থপর ও নির্বোধ। তাই '৭১-এর মতোই সাধারণের মৃত্যু ও আত্মত্যাগকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখতে অভ্যস্ত। তাদের নিদ্রা ভাঙে কেবল কিছু এলিটের দুর্ভোগ ও মৃত্যুতে। স্পর্শকাতর ব্যাপারে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে এসব বুদ্ধিজীবী নিজেদের দায়িত্ববান প্রমাণ করতে চান। গাঁয়ের কৃষক বা বৃক্ষ তাদের আদর্শ নয়, স্বার্থচিন্তা ব্যতিরেকে কর্মযজ্ঞে তাদের উৎসাহ নেই। ভাগবদ গীতার নীতিকথা তাদের টানে না। ভয়াবহ স্বার্থচিন্তা ও অলক্ষ্য সুতোয় তারা বাধা। যানজট বিভ্রাট ও ড্রাইভিং হত্যাযজ্ঞ প্রতিরোধে এক নম্বর বা দুই নম্বর ড্রাইভিং লাইসেন্স না বেছে 'ক্রাশ প্রোগ্রামের' অধীনে সেনাসদস্য, পুলিশ, বিআরটিএর ট্রেইনার ও অভিজ্ঞ ভলান্টিয়ার্স সমন্বয়ে সারাদেশে কয়েক হাজার ট্রেনিং সেন্টার খোলা যেতে পারে। এসব সেন্টারের প্রতিটিতে দৈনিক ২০০ জন হিসেবে প্রত্যেককে দুই মাসব্যাপী ট্রেনিং প্রদান করলে দুই মাসে কমপক্ষে ৪ লাখ প্রশিক্ষিত ড্রাইভার বের করা সম্ভব। তাদের মধ্যে যারা পরীক্ষায় পাস করবে তারাই লাইসেন্সপ্রাপ্ত হবে। পরীক্ষা পদ্ধতি যথাসম্ভব স্বচ্ছ, সহজ ও বেগবান হতে হবে। এ ব্যাপারে ভালো এনজিওগুলো সহায়তা দিতে পারে। ব্র্যাক এমন একটা উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে। তারা বুঝিয়ে দিতে পারে যে তারা চটকদার স্লোগানে বিশ্বাসী নয়।
সুষ্ঠুভাবে সড়ক যাতায়াত উন্নয়নের জন্য অবিলম্বে সারাদেশে দুই থেকে পাঁচ হাজার হাইওয়ে পুলিশ এবং তাদের জন্য সারাদেশে কমপক্ষে এক হাজার গতি নিয়ন্ত্রণ ছাউনি, সমসংখ্যক স্পিডমিটার, দুই থেকে ৪শ' 'পেট্রোল জিপের' ব্যবস্থা করতে হবে। বুয়েটের পরামর্শমতো দেশের ঝুঁকিপূর্ণ সড়কের তিনশ' বাঁক এবং সরু রাস্তা মেরামত করে রাস্তাগুলো যথাসম্ভব সরল করে কমপক্ষে ৩৬ ফুট প্রশস্ত করতে হবে।
সব হাইওয়েতে স্থায়ী ও অস্থায়ী ডিভাইডার দিতে হবে। সে সঙ্গে সব ব্রিজ ও কালভার্টের দু'পাশে এবং দু'প্রান্তে লম্বা মজবুত রেলিং দিতে হবে। ব্রিজ ও কালভার্টের শুরু ও শেষে যেমন 'স্পিড ব্রেকার' থাকতে হবে, তেমনি ওজন মাপক ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রতিটি চেকপোস্টেও ওজন মাপক ব্যবস্থা, গতিরোধক বার এবং টোল ব্যবস্থা থাকতে হবে।
রাস্তায় চলাচলে লেন পদ্ধতি এবং 'ফাস্ট ট্রাক' পদ্ধতি চালু করতে হবে। স্কুল, অফিস ও কারখানার জন্য বাধ্যতামূলক বাসসহ পিক আওয়ারে নির্দিষ্ট পথে অগ্রাধিকার যাত্রার জন্য টোল পদ্ধতি চালু করতে হবে।
রাস্তার দু'পাশে গাছ লাগানো যেমন বাধ্যতামূলক হতে হবে তেমনি হাইওয়েতে গাড়ির গতিবেগ ৬০ কিলোমিটারে বেঁধে দিতে হবে। ধীরগতির গাড়ির জন্য সাইড লেনসহ পথ পারাপারে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে।
রাস্তা নির্মাণে সেনাবাহিনীকে ব্যবহারসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং সুশীল সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
হাসপাতাল, গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্রসহ সব সেবামূলক প্রতিষ্ঠানেই এ কাজ করতে হবে এবং তা বহুপক্ষের তত্ত্বাবধানে আনতে হবে। এসব পরিদর্শনের জন্য নানা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসহ ভ্রাম্যমাণ আদালত কাজ করবে। রাস্তার গুণগত মান নির্ণয়ে বুয়েট অথবা সেনাবাহিনীর পরামর্শ নিতে হবে এবং তা পথপাশর্ে্ব উলেল্গখ করতে হবে।
২০ বছরের অধিক পুরনো গাড়ি রাস্তায় চলাচল করলে তার শাস্তি বিআরটিএসহ মালিক পক্ষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর বর্তাবে।
ট্রেনসহ মাস কমিউনিকেশন এই মুহূর্তেই জোরদার করতে হবে। দেশটিকে বাসওয়ালা, বাসওয়ালাদের সর্দার এবং লঞ্চওয়ালাদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। রিভার ট্রান্সপোর্টে সরকারি বিনিয়োগ বাধ্যতামূলক হতে হবে।
নদীর নাব্যতাসহ নদীপথের নিরাপত্তা বিধান করবে বাংলাদেশ নেভি ও কোস্টগার্ড। অচল ও অযোগ্য জলযানের চলাচলসহ অতিরিক্ত যাত্রী বহনের দায়িত্ব নৌ মন্ত্রণালয়কে নিতে হবে এবং এ বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা আশা করা যায়।
স্কুল-কলেজে দুর্নীতি, দলবাজি, অস্ত্রবাজি ও অফিসে টেন্ডারবাজি প্রতিরোধে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সর্বদলীয় কমিটি এবং নাগরিক কমিটি কাজ করবে। সে সঙ্গে কমিউনিটি পুলিশ ও স্থানীয় সরকার সম্পৃক্ত থাকবে। সরকারের প্রশাসন তো দায়ী থাকবেই।
দুর্নীতি, অপশাসন ও ব্যবস্থাপনার অভাব প্রতিরোধে গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায় সুশীল সমাজ এবং ছাত্র-জনতার ঐক্য গড়তে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি এবং নাগরিক অধিকার কমিটি কেবল একটি টেলিফোন বা হুইসেলের অপেক্ষায় থাকবে। সংকেত এলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং অপশক্তিকে তাৎক্ষণিক শাস্তি দেবে। সরকারের সদিচ্ছা এবং দেশপ্রেম প্রমাণের এটাই সুযোগ। সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে যে, জীবনের প্রয়োজনেই জনগণ যাবতীয় সমস্যার সমাধান চাইবে। এ সময় তারা মুখ ফিরিয়ে নিলে জনগণ নাস্তিচিন্তা এবং নৈরাজ্যেই ডুববে। সহনশীলতার সীমা ভাঙার আগেই সব পক্ষের বোধোদয় কাম্য।

ডা. এমএ হাসান :কলাম লেখক
 

No comments

Powered by Blogger.