বিশেষ সাক্ষাৎকার : ইলিয়াস কাঞ্চন-বিআরটিএতে দুর্নীতি হয় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায়

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করছেন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। তাঁর 'নিরাপদ সড়ক চাই' স্লোগানটি এখন গণ-স্লোগানে পরিণত হয়েছে। তার পরও নিত্য ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা, ঘটছে প্রাণহানি। এর কারণ, প্রতিরোধের উপায় ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন ইলিয়াস কাঞ্চন।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন মোস্তফা হোসেইন কালের কণ্ঠ : 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনের শুরু এবং বর্তমান অবস্থা কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন : আন্দোলনের শুরুতে আমরা আবেগপ্রবণ ছিলাম। এটা ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু একসময় আমরা বুঝতে পারলাম, আসলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে শুধু আবেগ দিয়ে কাজ হবে না, মূলে যেতে হবে। মূল জিনিস উদ্ঘাটন করতে না পারলে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা কোনোমতেই সম্ভব হবে না। সমস্যা চিহ্নিত করে তার পরই সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনার বিবেচনায় দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো কী?
ইলিয়াস কাঞ্চন : এর পেছনে অনেক কারণ আছে। একটা দিক খেয়াল করুন। ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এক লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হলো। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই এক লাখ লাইসেন্স পাওয়ার জন্য কোনো চালককেই লিখিত কোনো পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়নি। তাদের গাড়ি চালানোর মতো সাধারণ জ্ঞান আছে কি না তা না জেনেই লাইসেন্স দেওয়াটাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন আপনি? এই যে এক লাখ চালক গাড়ি চালাতে রাস্তায় নেমে গেল, তারা দুর্ঘটনা ঘটালে এর জন্য কাকে দায়ী করবেন আপনি?
কালের কণ্ঠ : এর জন্য কি শুধু চালকই দায়ী?
ইলিয়াস কাঞ্চন : এটা তো একটা চিত্র। যেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল, অমনি আমরা চালকের ফাঁসি চাইতে শুরু করি। অথচ পরিবেশগত দিকগুলো একবারও চিন্তা করি না। একজন চালকের দক্ষ হওয়ার জন্য যে সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন, তা কি আমরা তাদের দিয়েছি? তার শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি কি আমরা? সে ড্রাইভিং প্র্যাকটিস করবে, তার সুযোগ আছে কি? সেই সুযোগ কি আমরা তাকে দিয়েছি? কাজ শিখতে হলে অশিক্ষিত একজন চালকই ভরসা। যাকে ওস্তাদ বলা হয়। সেই ওস্তাদের অধীনে চাকরি নিতে হয় একজন হেলপারকে। সে প্রথম প্রথম ওস্তাদকে পান-সিগারেট কিনে দেওয়া, পানির বোতল এগিয়ে দেওয়ার মতো কাজ করে। এভাবেই সে একসময় ওস্তাদের শাগরেদ হিসেবে নিজেই স্টিয়ারিং ধরে। কোনোমতে স্টিয়ারিং ধরতে পারলেই তার উত্তরণ ঘটতে শুরু করে। সেই লোকটি কি করতে পারে রাস্তায় গেলে? ওর শিক্ষা তো ওভারটেকিং আর বেপরোয়া গাড়ি চালানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেটুকু করতে পারলেই নিজেকে দক্ষ চালক ভাবতে শুরু করে। ওভারটেকিং আর ওভারস্পিডের জন্য বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। অশিক্ষিত ওস্তাদ রোড সাইন সম্পর্কে শিক্ষা দেয় না। কোনো নির্দেশিকা সে মানে না।
কালের কণ্ঠ : সরকারি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলো কী করছে?
ইলিয়াস কাঞ্চন : আমরা বছরের পর বছর সরকারকে বলে আসছি। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করার অনুরোধ করছি। কোনো কাজ হচ্ছে না। অথচ বিআরটিসির অধীনে ১১-১২টি ইনস্টিটিউট ছিল। এর মধ্যে গাজীপুরে একটি মাত্র ইনস্টিটিউট খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। গাড়ি চালানো শেখে গরিব মানুষ। তাদের পক্ষে বেশি টাকা দিয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়া সম্ভব নয়। আমরা বলেছি, গরিব মানুষকে বিনা পয়সায় শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। এসএসসি পাস করে যেসব ছেলে কলেজে ভর্তি হতে পারে না, তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুন। সরকার বয়স্কভাতা, বিধবাভাতার মতো এদের জন্য তহবিল গঠন করতে পারে। ঋণ সুবিধাও দেওয়া যায়। কোনো বেকার যুবক হয়তো প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ঋণ নিল। সেই ছেলেটি চাকরি করে সরকারের টাকা কিস্তিতে পরিশোধ করে দেবে।
কালের কণ্ঠ : নৌমন্ত্রী বলেছেন, চাহিদা অনুযায়ী চালক সৃষ্টি হয় না বলেই পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হয়েছে। পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন : বিভিন্ন সময় চাপ থাকে। বিআরটিএকে বাধ্য করা হয় লাইসেন্স ইস্যু করার জন্য। এটা কিন্তু সরকারের কানেকটিং লোকজনই করে। যখন যে দল সরকারে আসে সেই দলের লোকজনই চাপ সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক দুর্নীতির জন্যই এমনটা হচ্ছে। এর পেছনে একটা চক্র কাজ করে।
কালের কণ্ঠ : সম্প্রতি যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ও সড়ক ব্যবস্থাপনার আলোকে এই দাবিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন : আমি দ্বিমত পোষণ করি এই দাবির সঙ্গে। সড়ক ব্যবস্থাপনা ও সড়ক দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে যোগাযোগমন্ত্রী দায়ী হবেন কেন? সড়ক দুর্ঘটনা রোধ কিংবা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে অনেক মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম জড়িত। যেমন সচেতনতা সৃষ্টির জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় কাজ করতে পারে। তারা তথ্যচিত্র করতে পারে। চলচ্চিত্র তৈরি করতে পারে। আমার তো মনে হয়, তথ্য মন্ত্রণালয় জানেই না বিষয়টি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা কারিকুলামে সড়ক ব্যবহার ও আত্মরক্ষার বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের শেখানোর ব্যবস্থা করতে পারে। তারা কি তেমন কিছু করে? তাদের অধীনে ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট আছে ৫৩টি। তারা কি সেসব স্থানে সিমিউলেটর মেশিন কিংবা একটি করে গাড়ি দিয়েছে, যাতে শিক্ষার্থীরা কিছু শিখতে পারে? আইন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আইন প্রণয়ন করা। এই সংশ্লিষ্ট আইন কি তারা প্রণয়ন করেছে? আইন কার্যকর করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তাদের ভূমিকা কী? অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ বরাদ্দ না করলে কোনো কাজই হবে না। এই যে রাস্তা মেরামতের জন্য ৬৯০ কোটি টাকা শেষ মুহূর্তে বরাদ্দ করা হলো, তা কি জলে যাওয়ার শামিল নয়? আগে বরাদ্দ করা হলো না কেন? শ্রম মন্ত্রণালয় চালকদের শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ করবে। তাদের নিয়োগবিধির বিষয় নিশ্চিত করবে। তাদের অধিকারগুলো যাতে নিশ্চিত হয় সেদিকে নজর দেবে। যোগাযোগ মন্ত্রণালয় তার সঙ্গে যুক্ত। সড়ক ব্যবস্থাপনায় তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত। সুতরাং শুধুই তারা ব্যর্থ, তা বলা ঠিক হবে না।
কালের কণ্ঠ : নৌমন্ত্রী বললেন, গরু-ছাগল চিনতে পারলেই চালক লাইসেন্স পেতে পারে।
ইলিয়াস কাঞ্চন : এই মন্তব্যের সঙ্গে কোনোভাবেই একমত হতে পারছি না। এটা কী করে হয়! একজন চালককে অবশ্যই কমপক্ষে এসএসসি পাস হতে হবে। রোড সাইন সম্পর্কে তাকে জানতে হবে। আইন, শ্রমবিধি ইত্যাদি সম্পর্কেও তার ধারণা থাকতে হবে। বিমান চালানো আর গাড়ি চালানোর মধ্যে পার্থক্য নেই বলে আমি মনে করি। পাইলটকে যেমন লেখাপড়া জানতে হবে, তেমনি গাড়িচালককেও জানতে হবে। গাড়ির গতির হিসাব তাকে করতে হবে। প্রতি ঘণ্টায় কত মাইল গতিতে গাড়ি চালালে সেকেন্ডে কতটুকু পথ অতিক্রম করা যায়, ব্রেক চাপলে তার গাড়ি কতটা পথ দূরে গিয়ে থামবে_এসব তার জানা প্রয়োজন।
কালের কণ্ঠ : মহাসড়কের ওপর বাজার বসার কারণে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে বলে অনেকে বলে থাকেন।
ইলিয়াস কাঞ্চন : শুধু বাজারই নয়, মহাসড়কের পাশে বাড়িঘর থাকাও উচিত নয়। আমরা অনেক দিন ধরে জাতীয় সড়ক নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছি। কাজ হয়নি। দেখুন, আজকে যদি ঢাকা-সিলেট কিংবা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে চার লেন-বিশিষ্ট করতে হয়, এর জন্য কী পরিমাণ সিএনজি স্টেশন ভাঙতে হবে, চিন্তা করে দেখুন। কত স্থাপনা ভাঙতে হবে ভেবেছেন? মহাসড়কের পাশে কোনো জায়গা নেই।
কালের কণ্ঠ : সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের ব্যাপারে আইনগত দুর্বলতা নিয়ে প্রায়ই কথা হয়। ৩০৪ ধারা পুনর্বহালের কথা বলা হয়। বিষয়টি সম্পর্কে বলবেন কি?
ইলিয়াস কাঞ্চন : চালক মানুষ মারতে চায় না। সত্যি কথা। কিন্তু এমন কিছু কাজ যদি সে করে যার জন্য একজন মানুষের মৃত্যু হতে পারে, তার জন্য কি সে শাস্তি পাবে না? যেমন স্পিড লিমিট না মানা। এর জন্য একজনের মৃত্যু হলে তাকে শাস্তি পেতে হবে। এই শাস্তি বিধানের জন্য ফৌজদারি ৩০৪ ধারা বলবৎ ছিল। এরশাদ সাহেব এসে ৩০৪ ক ধারা করলেন। শাস্তির বিধান কমিয়ে দেওয়া হলো। ৩০৪ খ ধারা করা হলো। কিন্তু তারপর ছড়াকার বাপ্পি শাহরিয়ারকে এক মন্ত্রীর ছেলে হত্যা করল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলেকে রক্ষা করার জন্য ২৭৯ ধারা করা হলো। সর্বোচ্চ শাস্তি নির্ধারিত হলো তিন বছর জেল। ইচ্ছা করলে কাউকে এক দিনের জেল দিয়েও ছেড়ে দেওয়ার বিধান করা হলো সেই শাস্তি কমিয়ে আনার জন্য।
কালের কণ্ঠ : বিআরটিএতে দুর্নীতি হয়, এমন অভিযোগ আছে। আপনি কী মনে করেন?
ইলিয়াস কাঞ্চন : দুর্নীতি সব জায়গায়ই আছে। তবে ওখানে দীর্ঘদিন ধরে আছে। এমনও শোনা যায়, সেখানকার কাউন্টারেও বহিরাগতরা বসে কাজ করে। এটা হয় সরকারের ছত্রচ্ছায়ায়। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সরাসরি হস্তক্ষেপ থাকে সেখানে। রাজনৈতিক সততা না থাকলে এই দুর্নীতি বন্ধ করা কঠিন হবে। বাইরে থেকে যখন চাপ আসে তখন সংগত কারণেই ভেতরের লোকজনও প্রলুব্ধ হয়। তারাও জড়িত হয় দুর্নীতিতে।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
ইলিয়াস কাঞ্চন : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.