পরিবারের প্রতিবাদ by তৌহিদা শিরোপা

খনো স্টার কাবাব, কখনো ধাবা, কোনো দিন হয়তো ফাস্টফুডের দোকান হ্যালভেশিয়া। এসব জায়গায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকি। আমার ছেলের বয়সী ছেলেমেয়েরা আসে। তারা কী খায়, কী পছন্দ করে—এসব বসে বসে দেখি। আমার ছেলেটা এসব জায়গায় যেত। আর অফিস থেকে ফেরার পথে টিএসসির মোড়ে হাজারো মুখের ভিড়ে ছেলের মুখটা খুঁজি। যদি ওর মতো কাউকে দেখতে পাই! আমি তো এখনো বিশ্বাস করি না, ছেলেটা নেই।


’ সাইফদের ধানমন্ডির বাসায় ওর মা সামিয়া হালিম সেদিন কথাগুলো বলছিলেন। বসার ঘরটিতে তখন অন্য রকম নীরবতা। শুধু সাইফের মা নন, সেদিন সাইফদের বাসায় এসেছিলেন ্্্্্্্্্্্সড়ক দুর্ঘটনায় কাছের মানুষকে হারানো স্বজনেরা। কেউবা অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছেন। হুসন্ আফরোজ, জাকিয়া আকতার কিংবা রেহানা জামানরা একে অপরের কষ্টগুলোকে ভাগ করতে একত্র হন। দীর্ঘ সময় মুখ ফুটে তাঁরা কথাও হয়তো বলেন না। কিন্তু পরস্পরের পাশে থাকলে, কাছে থাকলে মনে শক্তি পান।
সামিয়া হালিম বলেন, ‘অনেকে আমাকে বলেছেন সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত পরিবারে গিয়ে কি নিজে সান্ত্বনা পান? তাঁর কী হারিয়েছে, সেই কষ্টটা তো আমি বুঝি। এ কষ্ট কারও না হলে সে বুঝবে না। সে যেন মনে করে, আমি তার কষ্টটা বুঝছি। এ জন্যই যাই। সাইফের মৃত্যুর পর আমরা সাইফ ফাউন্ডেশন ও ফ্যামিলিজ ইউনাইটেড অ্যাগেইনস্ট রোড অ্যাক্সিডেন্ট (ফুয়ারা) গড়ে তুলেছি। দুর্ঘটনার শিকার পরিবারগুলো ছাড়াও এখানে অন্যরা কাজ করছে। খবর পেলেই আমরা ছুটে যাই সেসব পরিবারের কাছে। সভা, সেমিনার ও মানববন্ধন করি। আমাদের একটাই চাওয়া, যে চলে যায়, সে তো আর ফিরে আসবে না, কিন্তু আর কেউ যেন এভাবে চলে না যায়। এখন সড়ক দুর্ঘটনায় ঘাতক চালকের শাস্তি সর্বোচ্চ তিন বছরের শাস্তি। আমরা চাই, ঘাতক চালকের দেশের সর্বোচ্চ শাস্তি এবং তাকে কোনো অবস্থাতেই জামিন দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ, সচেতনতা বৃদ্ধি এসব কার্যক্রম থাকবে।’
অদ্ভুত বিষয় হলো, সড়ক দুর্ঘটনাকবলিত পরিবারগুলোর মধ্যে নতুন একটা আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এমনও হয়েছে, কোনো একটা মানববন্ধনে গিয়েছি। সেখানে অপরিচিত অনেকে এসে যোগ দিয়েছেন। হুসন্ আফরোজ যেমন সাইফদের বাসায় এলে হাতে ফুল নিয়ে আসেন। সাইফের ছবির পাশে ফুলদানিতে ফুলগুলো রেখে দেন। তিনি বলেন, ‘ফুয়ারায় যোগ না দিলে এত মানসিক শক্তি পেতাম না। আমার স্বামী প্রায় দেড় বছর আগে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন তিনি। শুধু স্বামীকে হারিয়েছি, তা নয়। আমার ছেলেটা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে অনেক সময় লেগেছে। এ জন্য কৃতজ্ঞতা এসব পরিবারের কাছে। যাদের কাছে মনের কথা খুলে বলা যায়। অন্যরা হয়তো শুনবে। মন খারাপ করবে। কিন্তু এরা আমার সত্যিকার কষ্ট বুঝবে। সব কথা খুলে না বললেও এরা বোঝে। নতুনভাবে চলার শক্তি পাই।’ তেমনি কথা বলেন জাকিয়া আকতারও। ২০০২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় বাবাকে আর ২০০৮ সালে স্বামীকে হারিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক চাই। তাই একসঙ্গে হয়ে আন্দোলন করছি। কাজ করছি।’ রেহানা জামান বলেন, তাঁর স্বামী মাহমুদ জামান চৌধুরীর সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার কথা। মাহমুদ জামান চৌধুরী এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই ক্ষত।
ফুয়ারার আহ্বায়ক ও সাইফের বাবা ইকরাম আহমেদ বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি। নিয়মিতভাবে মানববন্ধন, সভা ও সেমিনারের আয়োজন করছি। ২০১০ সালের সেমিনারে রাষ্ট্রপতি, তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ও মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এসেছিলেন। তাঁরা আমাদের কথা, সুপারিশমালা শুনেছেন। আশ্বাসও দিয়েছেন এ সুপারিশমালা গ্রহণের। সুপারিশমালা বাস্তবায়িত না হলেও আমরা আন্দোলন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। তবে দুর্ঘটনার শিকার পরিবার ছাড়াও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অনেক ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিলে মহামারি রূপ ধারণ করবে, যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়। আমরা চেয়েছি নাগরিক সমাজ ও সরকারের মধ্যে বন্ধন গড়ে তুলতে। শুধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারই নয়, যাতে সবাই এগিয়ে আসে।’

পত্রিকার পাতায় কোনো খবর পেলেই ছুটে যাই
অগ্রণী স্কুলের শিক্ষক ফেরদৌসী ঝুমুর। ২০০১ সালের ১২ জানুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তিনি। এ মানুষটি ছাড়া আজ তাঁর পরিবারের চিত্র বদলে গেছে। ঝুমুরের বড় বোন নাজমুন নাহার বলেন, ‘সেই কবে ঝুমুর চলে গেছে। ওর মৃত্যুর পর আমাদের মা কোথাও কোনো দুর্ঘটনার খবর শুনলেই তাদের কাছে যেতেন। মায়ের সঙ্গে আমিও মাঝেমধ্যে যেতাম। ২০০৫ সালে মা মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর আমি পত্রিকায় কোনো মানববন্ধন, সভা ও সেমিনার কিংবা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের খবর পেলেই ছুটে যাই। একটি দুর্ঘটনা পরিবারকে তছনছ করে দেয়। কত শত দুর্ঘটনা ঘটে, তবু আমাদের টনক নড়ে না। আমাদের আরও সোচ্চার হতে হবে। তাই সবার সঙ্গে থাকার চেষ্টা করছি। পরিবারের কান্নার আড়ালে আরও যন্ত্রণা, ক্ষত থাকে। যার যায় সে ছাড়া এ যন্ত্রণা কেউ বুঝবে না।’

আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়
হামিমের ছোট্ট একটি বোন হয়েছে। বয়স দেড় বছরের কাছাকাছি। হামিমকে হারিয়ে ওর মা সোনিয়া শেখ আজও আতঙ্কিত। ভয়ে মেয়ে ইকরাকে নিয়ে বাইরে বের হতে চান না। যদি একেও হারিয়ে ফেলেন। কারও জীবনের তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। নিরাপত্তা নেই। সোনিয়া শেখ বলেন, ‘কারও এমন দুর্ঘটনার খবর শুনলে ছুটে যাই। কারণ, আমরা জানি তাঁর কষ্টটা কী। তাই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করেছি। আমার কোনো কাজে যদি আরেকটি মানুষ সচেতন হয়। এটাই তো চাওয়া। ফুয়ারার মাধ্যমে নানা ধরনের কর্মসূচিতে অংশ নিই। দুই বছর হয়ে গেল কোনো কার্যকর পদক্ষেপ তো কেউ নিল না। প্রতিদিন টেলিভিশনে দুর্ঘটনার খবর দেখি। বুকটা কেঁপে ওঠে। সুস্থ মানুষ বাইরে যায়, ফেরে লাশ হয়ে। আজও আমার ছেলের ঘাতক চালকের শাস্তি হয়নি। আর কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। অন্যায়কারীর যেন মৃত্যুদণ্ড হয়। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।’

কলম হোক প্রতিবাদের ভাষা
মঞ্জুলী কাজীসড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন তাঁর স্বামী মিশুক মুনীরকে। এই শোক প্রতিবাদের ভাষায় প্রকাশ করছেন কলমের সাহায্যে। দেশে থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন মানববন্ধনে, সভায় অংশ নিয়েছেন। কানাডা গিয়েও সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে লেখালেখি করছেন। কলমই হয়েউঠেছে তাঁর প্রতিবাদের ভাষা।

No comments

Powered by Blogger.