রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষ এবং জাপান by প্রবীর বিকাশ সরকার

বছর কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী। বিশ্বের অনেক দেশেই তা উদযাপিত হচ্ছে, যদিওবা তেমন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। ১৯৬১ সালে শততম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আমেরিকা, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, কানাডা, জাপান, সিঙ্গাপুর, চীন প্রভৃতি দেশ কবিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছিল। বিশেষ করে জাপানে যেভাবে সাড়ে তিন বছর ধরে নানা রকম পরিকল্পনা ও আয়োজনের মধ্য দিয়ে উৎসবটি উদযাপিত হয়েছিল তা এক কথায় বিরল।
যুদ্ধে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত জাপান রবীন্দ্রনাথ থেকে পুনরায় মানসিক শক্তি অর্জনের লক্ষ্যেই এই মহাপদক্ষেপ নিয়েছিলেন একদল বুদ্ধিজীবী।
এ বছরও জাপানে সীমিত আকারে কবির ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছে। আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মূল উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম আমি ও আমার এক জাপানি বান্ধবী রবীন্দ্রভক্ত তামিকো ওওবা। ব্যবসায়ী, ফাউন্ডেশন, ধনী ব্যক্তি অনেকের কাছেই গিয়েছি, আবেদন করেছি যারা শততম জন্মবর্ষে স্বতঃস্টম্ফূর্তভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন, জাপানের লাগাতার অর্থনৈতিক মন্দার কারণে। আবার মার্চ মাসের ভূমিকম্প ও সুনামির মতো মহাপ্রলয়ের কারণে বাণিজ্য ও অর্থনীতি আরও লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। তথাপি রবীন্দ্রনাথ ও জাপান সম্পর্ক বলে কথা। অনেকেই সীমিত সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। জুন মাসে কোবে শহরে অনুষ্ঠিত হয়েছে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ইতিমধ্যে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গেও যৌথভাবে অনুষ্ঠান হয়েছে। গত ২৩ জুলাই হলো ইয়োকোহামাতে আলোচনা, সেতার বাদন এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে আবৃত্তি।
আমরা অনেকেই জানি না যে, জাপানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক অন্য আর যে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের চেয়ে ছিল গভীরতম। পাঁচ বার তিনি এ দেশে এসেছিলেন। লিখেছেন অবিস্মরণীয় গ্রন্থ 'জাপান যাত্রী', শুধু তাই নয়, জাপানের প্রভাব তার জীবনে সবচেয়ে বেশি পড়েছিল। তাকে নিয়ে যত সংখ্যক জাপানি বুদ্ধিজীবী চিন্তা ও গবেষণা করেছেন এমনটি আর কোনো দেশে দেখা যায়নি। এখনও তাকে নিয়ে জাপানিদের কৌতূহলের শেষ নেই! তার চিন্তা ও রচনা নিয়ে গবেষণা করছেন নতুন প্রজন্মের জাপানিরা। প্রকৃতি ও পরিবেশ সমস্যার কারণে রবীন্দ্রনাথের নাম জাপানিদের কাছে নতুন করে আবির্ভূত হচ্ছে, এটা শুভ লক্ষণ। কবিগুরুর অনেক জাপানি বন্ধুর বংশধররা কবির স্মৃতি সযত্নে সংরক্ষণ করে যাচ্ছেন আজও।
কবির সার্ধশত জন্মবর্ষে ভারতীয় দূতাবাসও সীমিত পরিসরে অনুষ্ঠানাদি করছে। আমাদের উদ্যোগকেও দূতাবাস সহযোগিতা দিচ্ছে। অবশ্য জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান করা যেত যদি বহুশ্রুত নাম জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কাজুও আজুমা সচল থাকতেন। ৭৯ বছর বয়সে ২৮ জুলাই তিনি ইহধাম ত্যাগ করেছেন। আজুমা স্যার গত দু'বছর ধরেই হাসপাতালে এক রকম মৃতপ্রায় ছিলেন।
বাংলাদেশ দূতাবাস সার্ধশত জন্মবর্ষে কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে না। ভারত ও বাংলাদেশ যৌথভাবে দু'দেশে অনুষ্ঠান করেছে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ও দায়সারা গোছের অনুষ্ঠানাদি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ইউনেসকো শান্তিনিকেতনকে তাদের 'বিশ্ব সাংস্কৃতিক সম্পদে'র তালিকাভুক্ত করবে বলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ফলাফল হলো শূন্য। ইউনেসকো অন্ততপক্ষে একটি স্মারক প্রকাশনা প্রকাশ করতেই পারত, তা হয়নি এখন পর্যন্ত। ভারত ও বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে না। অথচ রবীন্দ্রনাথের ৭০তম জন্মবর্ষে মূল্যবান একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল 'গোল্ডেন বুক অব টেগোর' নামে। তাতে জাপানি তিন জন রবীন্দ্রভক্তের রচনা স্থান পেয়েছিল। তখন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জীবিত ছিলেন বলেই কি সেটা করা হয়েছিল? ১৫০তম এই বিরল জন্মবর্ষে উপমহাদেশের কোনো দেশেই রবীন্দ্রনাথের একটি স্মারক মূর্তি জাতীয়ভাবে স্থাপিত হয়নি। অন্ততপক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পদ্মাবিধৌত রাজশাহীতে হতেই পারত। শিশু-কিশোর প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথ ও তার জন্মবর্ষের গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য বড় কোনো সমাবেশ বা অনুষ্ঠান বাঙালি সমাজে হয়নি। কোনো বাঙালি গবেষক আজ পর্যন্ত বিশ্বমাপের একটি রবীন্দ্রবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করতে পারেননি বলেও অনেকেই মনে করেন।
probirsrkr06@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.