শ্রদ্ধাঞ্জলি-নয়নের মাঝে নিয়েছো যে ঠাঁই by সুজেয় শ্যাম

নিজেকে নিয়ে অজিত রায়ের কোনো গর্ব ছিল না। সবসময় নিজের মধ্যে থাকতেন তিনি। সদা হাস্যোজ্জ্বল এ লোকটি কারও সঙ্গে কখনও কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াননি। তার মধ্যে কোনো রকমের হিংসা বা বিদ্বেষ কখনও দেখিনি। স্বাধীনতার পর তার সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়েছে।


কথা হয়েছে। তিন বছর আগে আমি একটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতারের ৫০টি গান নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিলাম। সেখানে তার গাওয়া বেশ কয়েকটি গান ছিল


গতকাল দুপুরে যখন শুনলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও সুরকার অজিত রায় মারা গেছেন, তখন বুকের ভেতরটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। গত শনিবার রাতেই বারডেম হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তখনই শুনেছিলাম তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিয়ে রাখা হয়েছে। তার পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বললাম। জানলাম, তিনি অনেকদিন ধরেই ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগছিলেন।
মনে আছে, ১৯৬০ সালে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তখন আমি সিলেটে থাকতাম। সেই সময় তিনি একবার সিলেটে এসেছিলেন গণসঙ্গীত পরিবেশন করার জন্য। তখন তিনি টগবগে তরুণ শিল্পী। সেই সময়ে তিনি সরকারবিরোধী অনেক গান করেন। সে জন্য আমি তাকে গণসঙ্গীতের মহারাজ বলে ডাকতাম। যা-ই হোক এরপর ১৯৬৪ সালে আমি চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম; সেখানে আবারও তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সেই থেকে আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন কলকাতার বালিগঞ্জে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র গঠন করা হলো তখন অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেল, তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে কুচবিহারে আছেন। তখন সেখানে যোগাযোগ করে তাকে স্বাধীন বাংলা বেতারে নিয়ে আসা হয়। এরপর সেখানেই আমরা অনেক গান করেছি। মনে আছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেতারে প্রথম গানটি করেছিলেন অজিতদা। 'বিজয় নিশান উড়ছে ঐ' শিরোনামের এ গানটি তিনিই গেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বালিগঞ্জে আমরা সবাই স্বাধীন বাংলার আভাস পাচ্ছিলাম। তখন কেউ একজন বললেন, এবার বিজয়ের নতুন গান করতে হবে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে কোথায় পাওয়া যাবে বিজয়ের গান? গীতিকার শহিদুল ইসলামকে বলা হলে তিনি তাৎক্ষণিক 'বিজয় নিশান উড়ছে ঐ' শিরোনামে একটি গানের চার লাইন লিখে দিলেন। পরে আমরা কোনার একটি ঘরে গিয়ে গানটা সুর দিয়েই ছুটলাম অজিতদার কাছে। তাকে গিয়ে গানটির কথা বললাম। বিনয়ের সুরে তিনি জানতে চাইলেন, 'আমি কি পারব?' আমরা তাকে বললাম, আপনি গণসঙ্গীতের মহারাজ। আপনি না পারলে আর কেউই এই গানটা করতে পারবে না। এরপর তিনি রাজি হলেন। ওইদিন বিকেল ৪টায় গানটি ধারণ করা হয়। ধারণ করার পরই প্রচার হয় গানটি। ১০-১৫ জন শিল্পী মিলে গানটি গেয়েছিলেন; কিন্তু সে গানটির লিড ধরেছিলেন তিনি। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে গানটির ইতিহাস রচিত হলো সেদিন।
নিজেকে নিয়ে অজিত রায়ের কোনো গর্ব ছিল না। সবসময় নিজের মধ্যে থাকতেন তিনি। সদা হাস্যোজ্জ্বল এ লোকটি কারও সঙ্গে কখনও কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াননি। তার মধ্যে কোনো রকমের হিংসা বা বিদ্বেষ কখনও দেখিনি। স্বাধীনতার পর তার সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। তিন বছর আগে আমি একটি প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতারের ৫০টি গান নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিলাম। সেখানে তার গাওয়া বেশ কয়েকটি গান ছিল। তিনিই সেগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন। সবাইকেই একদিন চলে যেতে হয়। তবে অজিত রায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশীয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটি অধ্যায়ের শেষ হলো বলে আমার মনে হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি যে গানগুলো করেছেন সেগুলো চির অমর হয়ে থাকবে। আমরাও তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব। নিজ কর্মের গুণেই তিনি আমাদের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবেন। তিনি আমাদের সবার নয়নের মাঝেই থাকবেন। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করি।

সুজেয় শ্যাম : স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী
 

No comments

Powered by Blogger.