আর্জেন্টিনা ৩ : নাইজেরিয়া ১, বাংলাদেশ ০ : ভারত ০ by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

দের খুশি মিলিয়ে যেতে না যেতেই বাংলাদেশে দুটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেল। এর ভেতর বিশ্ব ফুটবলের পরাশক্তি আর্জেন্টিনা বাংলাদেশে এসেছিল, এসেছিল আফ্রিকার সুপার ঈগল নাইজেরিয়া। বার্সেলোনার ফুটবল জাদুকর মেসিও আর্জেন্টিনা দলের সঙ্গে এসেছিলেন। অনেক দিন ধরে বাংলাদেশের ফুটবলামোদীরা অপেক্ষায় ছিলেন এ ম্যাচটির জন্য। বিশ্ব ফুটবল পরাশক্তি আর্জেন্টিনার সঙ্গে পেরে ওঠার কথা ছিল না আফ্রিকান ঈগল নাইজেরিয়ার। খেলার মাঠে নেমে যা হওয়ার কথা ছিল তা-ই হলো।

আর্জেন্টিনা কোনো অঘটন ঘটার সুযোগই দিল না। যথেষ্ট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ফুটবল উপহার দিয়ে ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচটি আর্জেন্টিনা জিতে নিয়েছিল। ফলাফল আর্জেন্টিনা ৩, আর নাইজেরিয়া ১ গোল। আর্জেন্টিনা-নাইজেরিয়া ম্যাচের রেশ কাটতে না কাটতেই ঢাকায় হয়ে গেল আরো একটি ম্যাচ, সেটি ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ। আপাত দৃষ্টিতে এটি কোনো ফুটবল ম্যাচ না হলেও বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য এটি ছিল একটি ফাইনাল ম্যাচ। এ খেলায় একদিকে খেলেছেন শেখ হাসিনা, তাঁর মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা; অন্যদিকে ভারতীয় পক্ষে খেলেছেন মনমোহন সিং, তাঁর মন্ত্রী ও প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরা। প্রায় এক যুগ পর বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। সফরটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাংলাদেশের জন্য; কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু ও প্রতিবেশী। ভারতের সঙ্গে রয়েছে আমাদের সাংস্কৃতিক মিল আবার ভারতের সঙ্গেই রয়েছে আমাদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা। কারণ ভারত প্রতিটি অভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশের সীমান্তের তিন দিকেই রয়েছে ভারতের কাঁটাতারের প্রাচীর। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গেই রয়েছে বেশি ঘাটতি আর ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করছে ভারত।
মনমোহনের এবারের সফরে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আশা করেছিল তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে অচলাবস্থা চলছে বহুদিন আগে থেকে। শেখ হাসিনা আশা করেছিলেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি হয়ে গেলে বিরোধী দলগুলোকে একটা বড় জবাব দিতে পারবেন।
তিস্তার পানি বণ্টনের ক্ষেত্রে যেখানে বাংলাদেশ প্রস্তাব করেছিল, নাব্যতার জন্য ২০ শতাংশ রেখে তিস্তার পানি সমান দুই ভাগে ভাগ করে নেবে। সেখানে ভারত প্রস্তাব করেছিল, ১০ শতাংশ নাব্যতার জন্য রেখে বাকি পানির ৫৫ শতাংশ ভারত নিজের জন্য রেখে ৪৫ শতাংশ বাংলাদেশকে দেবে। বাংলাদেশ প্রথম দিকে রাজি না হলেও ভারতের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল এ জন্য যে চুক্তিটি হয়ে গেলে এটি বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য একটি বড় সাফল্য বলেই বিবেচিত হতো। তিস্তা চুক্তি হয়ে গেলে দৃশ্যত বাংলাদেশ ১-০ গোলে এগিয়ে থাকত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একরোখা মনোভাব মনমোহনের বাংলাদেশ সফরের সব সাফল্য ম্লান করে দিয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের এই খেলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে এত বড় একটা ফাউল করবেন, এটা কেউ আগেভাগে ধারণা করতে পারেননি, এমনকি খোদ শেখ হাসিনাও ধারণা করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না।
পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লেখা হচ্ছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেখ হাসিনার বহুদিনের ঘনিষ্ঠ। ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক তাঁদের এত বেশি যে তিস্তা চুক্তি না হয়ে যায় না। এমনকি ভারত সরকার শেষমেশ চেয়েছিল একটি অন্তর্বর্তী চুক্তি করে আপাতত মনমোহনের সফরের সাফল্য ধরে রাখতে; কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটা বড় সবক দিয়েছেন এ সফরে যে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক আর বন্ধুত্বের চেয়ে যেকোনো রকমেই দেশের স্বার্থই সবচেয়ে বড়, আর সে জন্য একইভাষী হওয়ার পরও বাংলাদেশের স্বার্থে একটুও ছাড় দেননি মমতা।
পুরো খেলায় বাংলাদেশও কিছু ফাউল করেছে। এর ভেতর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রসচিব ও উপদেষ্টারা একেক সময় একেক রকম ঘোষণা দিয়েছেন তিস্তা চুক্তি নিয়ে। অন্যদিকে আমাদের অর্থমন্ত্রী আরো আগ বাড়িয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী তিন মাসের মধ্যে তিস্তা চুক্তি হবে। বাংলাদেশের এই ফাউল ঢাকতে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডাকা হয়েছিল তিস্তা চুক্তি না হওয়ার ব্যাখ্যা দিতে। রাষ্ট্রদূত যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তাতে অবশ্য খুশি হয়নি বাংলাদেশ সরকার।
ভারত-বাংলাদেশের এ খেলা দৃশ্যত কোনো পরিণতি ছাড়াই শেষ হয়েছে। যদিও হয়েছে নানা সমঝোতা স্মারক সই, উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তি। এ ছাড়া তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখা এবং ভারতের বাজারে ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মূল এজেন্ডা তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত না হওয়ায় বলা যায়, ভারত-বাংলাদেশের খেলাটি অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়েছে। মানে ফলাফল ভারত ০ : বাংলাদেশ ০।
যা হোক, ভারত ও বাংলাদেশের এই ম্যাচের আগে যোগাযোগমন্ত্রীকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল দেশের সুধীসমাজ। মনমোহনের বাংলাদেশ সফরের পর যোগাযোগমন্ত্রীর অপসারণের আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে গেছে। সুতরাং ফলভোগের কথা বিবেচনা করে বলা যায়, ভারত-বাংলাদেশ এই ম্যাচ থেকে আর কেউ লাভবান না হলেও এ থেকে লাভবান হয়েছেন একজন। তিনি আমাদের যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন।
লেখক : গবেষক, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ, ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রিয়া
shahnewaybiplob@hotmail.com

No comments

Powered by Blogger.