কর্মবীর অশ্বিনী কুমার দত্ত by শ্যামল সেন

নবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলায় নবজাগরণের ঢেউ জেগেছিল। ব্রিটিশ বেনিয়াদের শৃঙ্খল ভাঙতে তখন ভারতবর্ষে ক্রমশ বিতৃষ্ণা দানা বেঁধে উঠছে। এ রকম মুহূর্তে যে মহাব্রতী শিক্ষক জননেতা বরিশালের মাটিতে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন, তিনি মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্ত। জন্ম ২৫ জানুয়ারি ১৮৫৬, তৎকালীন বরিশাল জেলার পটুয়াখালী মহকুমায় মুন্সেফ ম্যাজিস্ট্রেট পিতা ব্রজমোহন দত্তের কর্মস্থলে। পৈতৃক বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলাধীন বাটাজোর গ্রামে।


পিতার সরকারি চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে বিদ্যালয়পর্ব শেষ করেন। এলাহাবাদ হাইকোর্টে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২৩ বছর বয়সে বিএ এবং এক বছর বাদে এমএবিএল হন। ৯ বছর ওকালতির মাথায় মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয় বলে তিনি আইন ব্যবসা ত্যাগ করেন। ১৮৮৪ সালে অশ্বিনী কুমার দেশপ্রেমিক প্রকৃত আদর্শবান শিক্ষিত বাঙালি ছাত্র ও যুবসমাজ তৈরির স্বপ্ন লালন করে প্রতিষ্ঠা করেন ব্রজমোহন ইনস্টিটিউশন। এ বিদ্যালয় ছিল বঙ্গভঙ্গ, অসহযোগ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের পাদপীঠ। জ্ঞান, সততা, নিষ্ঠা এবং চরিত্রমাধুর্যে মহিমান্বিত শিক্ষকদের সমন্বয়ে অশ্বিনী কুমার এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার মানকে এত উন্নত করেন, ভারতবর্ষে যার তুলনা পাওয়া ভার ছিল। ব্রজমোহন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৫ বছর পর ১৮৮৯ সালে অশ্বিনী কুমার ব্রজমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। বরিশালে রেনেসাঁর অগ্রদূত অশ্বিনী কুমার শিক্ষা বিস্তার ও জনসেবাকে মুখ্য উদ্দেশ্য করে রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। গণতন্ত্রের পূজারি অশ্বিনী কুমার নিজে বরিশাল পৌরসভা ও লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলেন। জনগণই ক্ষমতার উৎস এবং জনপ্রতিনিধিরা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে_ এ দাবির সমর্থনে তিনি ১৮৮৫-৮৬ সালে ৪০ হাজার বরিশালবাসীর স্বাক্ষর জোগাড় করে আইন সভা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে প্রেরণ করেন। ১৯০৫ সালে বাংলা বিভক্তির প্রতিবাদে অশ্বিনী কুমারের নেতৃত্বে বরিশালে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। সে এক বিস্ময়কর জাগরণ। তীব্র বিদ্রোহের কথা শুনে পূর্ববাংলার ছোট লাট ব্যামফিল্ড ফুলার বরিশালে ছুটে আসেন। বরিশালে অশ্বিনী কুমারের হুকুম ছাড়া কোনো বিলাতি দ্রব্য প্রদর্শন বা বিক্রয় নিষিদ্ধ ছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট মহাসভায় ভারত সাম্রাজ্যের দুটি দুর্দমনীয় শক্তি মাথাব্যথার কারণ হয়ে রইল_ একটি ভারতের উত্তর-পশ্চিম পার্বত্য জাতি, অন্যটি বরিশাল। অশ্বিনী কুমার কংগ্রেসকে সক্রিয় করতে ব্যর্থ হয়ে 'বরিশাল স্বদেশবান্ধব সমিতি' নামে এক নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলেন। জেলার সর্বত্র এর শাখা ছড়িয়ে পড়ল। এ উপলক্ষে তিনি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যালয় স্থাপন, সালিশির মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি এবং মৃতপ্রায় কুটির শিল্পের পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করতে লাগলেন। তার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে চারণ কবি মুকুন্দ দাস জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা তৈরি করেন এবং জাগরণী গান গেয়ে স্বদেশী গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন।
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ও ১৫ এপ্রিল বরিশালে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষে সরকারি আদেশ সর্বপ্রথম অমান্য করা হলো বরিশালে। ১৪ এপ্রিল, বাংলা ১৩১৩ সনের ১ বৈশাখ বীরের রক্তে রঞ্জিত হলো বরিশালের রাজপথ। এ সময়ই বরিশালে দেখা দিল নিদারুণ দুর্ভিক্ষ। স্বদেশবান্ধব সমিতির হাতে স্বদেশী আন্দোলনের কার্যভার ন্যস্ত করে অশ্বিনী কুমার আর্তসেবায় আত্মনিয়োগ করলেন। এদিকে অশ্বিনী কুমারের আহ্বানে স্বদেশী আন্দোলন বরিশালকে প্রমত্ত করে তুলল। বহু লোক কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলো, অত্যাচার চলল গুর্খা সৈন্যের। ১৮১৮ সালে পার্বত্য দস্যু দমনের জন্য প্রবর্তিত তিন আইনে অশ্বিনী কুমারসহ ৯ নেতাকে গ্রেফতার করে নির্বাসন দেওয়া হলো। স্বদেশী আন্দোলনের খাটুনি ও দুর্ভিক্ষের কাজে পরিশ্রমের কারণে তার শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়ে। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ নভেম্বর এই মহাপ্রাণ ব্যক্তিত্ব কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের এক ক্ষুদ্র জনপদ বরিশালকে কেন্দ্র করে পুণ্যব্রত মহাপুরুষ অশ্বিনী কুমার সমগ্র ভারতের চিন্তানায়ক কর্মবীর হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.