গুম, খুন ও গুপ্তহত্যা বন্ধ হবে কবে? by আবুল কাসেম হায়দার

মানুষ আজ অসহায় জীবন কাটাছে। সরকারি দলের নেতা-কর্মী, এমনকি সমর্থক পর্যন্ত বিষয়টি বুঝতে পারছেন না। জীবনের ভয়ে সমাজের অনেক সচেতন ব্যক্তি আজ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। প্রতিদিনের গুমের ঘটনা মানুষকে একেবারই বাক্রুদ্ধ করে ফেলেছে। অনেক গুমের খবর পত্রিকায়ও প্রকাশিত হচ্ছে না। কয়েক দিন আগে বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান দেশে গুম, গুপ্তহত্যা ও নির্যাতনের নানা চিত্র জাতির সামনে তুলে ধরেছে।
বর্তমান নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গত তিন বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৬০৬ জন নিহত হয়েছে। ২০১১ সালে গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। ক্রসফায়ারের নামে হত্যাকাণ্ডের পরিবর্তে বর্তমানে গুমের ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। আর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রাষ্ট্রই এ 'কৌশল' বেছে নিয়েছে। জাতীয় প্রেসক্লাবে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার আয়োজিত ২০১১ সালের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য প্রকাশ করা হয়। অধিকারের সভাপতি ড. সি আর আবরারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রতিবেদন পাঠ করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আদিলুর রহমান খান।
প্রতিবেদনে বর্তমান সরকারের গত তিন বছরে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি, রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, রাজনৈতিকীকরণের মধ্য দিয়ে বিচারপ্রক্রিয়া সংকুচিতকরণ, সরকারের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধি, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়াসহ বিভিন্ন প্রসঙ্গ স্থান পায়। এতে বলা হয়, রাষ্ট্র যদি গণতান্ত্রিক নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে শুধু একটি নির্বাচন জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। প্রতিবেদনে গত তিন বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ক্রসফায়ারের নামে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বদলে এখন গুমের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দাবির মুখে রাষ্ট্র এমন কৌশল বেছে নিয়েছে। ক্রসফায়ার করতে করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ধারণা হয়েছে, তারা (আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) টাকার বিনিময়ে খুন বা গুম করতে পারে। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, বর্তমান সরকারের গত তিন বছরে ৫২৯ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
অধিকারের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির না করে থানা-হাজতে আটকে রেখে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা শুধু ফৌজদারি অপরাধই নয়, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। ২০১১ সালে সীমান্তে ৩১ জন নিহত হয়েছে। কিন্তু ভারত সরকারের কাছ থেকে কোনো রকম ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেনি বাংলাদেশ।
রাজনৈতিক সহিংসতায় ছয় শতাধিক নিহত : অধিকারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারের গত তিন বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় মোট ৬০৬ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ২৫১, ২০১০ সালে ২২০ এবং গত বছর ১৩৫ জন নিহত হয়। প্রতিবেদনে আওয়ামী লীগের ছাত্র ও যুব সংগঠনের ৯৮ জন এবং একই সময় বিএনপির ১২ জনের নিহত হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ঘটনাগুলো ঘটেছে অন্তর্দ্বন্দ্ব, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, ছাত্রাবাসের আসন দখল, হল দখল ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে।
বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড : প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে রাষ্ট্র এখন গুমের কৌশল বেছে নিয়েছে, যা জনগণকে জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে। গত তিন বছরে ৩৬৫ জন বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ১৫৪, ২০১০ সালে ১২৭ এবং ২০১১ সালে ৮৪ জন নিহত হয়েছে। গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ২০০৯ সালে ১২৭, ২০১০ সালে ১৭৪ এবং ২০১১ সালে ১৬১ জন।
মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি : ২০১১ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অধিকার বলছে, নারী নির্যাতনে যৌতুক, সহিংসতা ও ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। গত তিন বছরে যৌতুকের কারণে এক হাজার ২১৩ জন নারীকে নির্যাতন করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছে গত বছর, যা ৫১৬ জন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সময় এক হাজার ৭২৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, এসিডদগ্ধ হয়েছে ৩৩৯ জন নারী। অন্যদিকে কারাগারে মৃত্যুবরণ করেছে ২১৫ জন। প্রতিবেদনে এভাবে ১৫টি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে বলা হয়, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে না পারার কারণে মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে। সভায় অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হায়দার আকবর খান রনো, বৈশাখী টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয় পরিষদের সদস্য আবদুস সালাম, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য জেড আই খান পান্না, ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক গোলাম মাহমুদ, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরাম ঢাকা মহানগরীর সুলতানা আক্তার প্রমুখ। মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, গত কয়েক দশকে সাংবাদিক হত্যা বা নির্যাতনের মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। সরকারের গাফিলতি ধরিয়ে দেওয়া প্রতিটি নাগরিক ও সাংবাদিকের দায়িত্ব। হায়দার আকবর খান রনো বলেন, 'ক্রসফায়ার করতে করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ধারণা হয়েছে, তাঁরা টাকার বিনিময়ে খুন করতে পারেন।'
এখন উপায় কী?
১. এখন আমাদের বাঁচার জন্য উপায় সরকারকে বের করতে হবে। সরকার জনগণের নিরাপত্তার মালিক। জনগণের জানমালের নিরাপত্তাবিধান সরকারের প্রধান কাজ। কিন্তু গুম সম্পর্কে সরকার নীরব। অনেক সংস্থা ও ব্যক্তি গুম সম্পর্কে সরকারের বক্তব্য চেয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ব্যাখ্যা বা বিবৃতি দেওয়া হয়নি। সরকারের এই নীরবতায় সবাই হতবাক। এ কী রাষ্ট্র চলছে? মানুষ গুম হচ্ছে। মানুষের কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। একটি স্বাধীন দেশে মানুষের লাশের পর্যন্ত কোনো সংবাদ পাওয়া যাবে না, তা কিভাবে হয়। অনতিবিলম্বে সব ধরনের গুম, গুপ্তহত্যা, বিচার-বহির্ভূত সব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা উচিত। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনোক্রমেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চলতে পারে না।
২. রাষ্ট্রকে আইনের শাসনে ফিরে আসতে হবে। সব ধরনের বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম থেকে সবাইকে সরে আসতে হবে। একটি স্বাধীন দেশের মানুষ এভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে না। আইনের সত্যিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সব ধরনের অন্যায়, হত্যা, গুম ও নির্যাতনের বিচারের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। তা না হলে অচিরে সাধারণ মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিলে দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এখনো কিছু ঘটনা সাধারণ মানুষ ঘটাচ্ছে। সরকার সতর্ক না হলে আইনশৃঙ্খলা আরো বেশি খারাপের দিকে যাবে।
৩. সমাজের সব রাজনৈতিক দল, সমাজসচেতন মানুষকে গুম, হত্যা ও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সব শিক্ষক, ছাত্র, শ্রমিক তথা সুশীল সমাজকে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
৪. দেশের ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই, সব চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের গুম ও হত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। বেআইনিভাবে মানুষকে হত্যা ও গুম করার ষড়যন্ত্র থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসার জন্য সব বাণিজ্যিক সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে। সারা দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা আজ গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছে।
৫. সব নিউজ মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে দেশের মানুষকে আরো বেশি সচেতন করার ভূমিকা পালন করতে হবে। সব মিডিয়াকে গুম ও হত্যার বিরুদ্ধে কঠিন ও দৃঢ় আওয়াজ তুলতে হবে। জাতি আজ মিডিয়ার কাছে এই দাবি করেছে, যেহেতু জাতির বিবেক হচ্ছে মিডিয়া।
৬. সব এনজিও, বিদেশি ও দেশি সাহায্য সংস্থাকে দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি সম্পর্কে সরকার ও জনগণকে সচেতন করার কাজে এগিয়ে আসতে হবে। গুম ও গুপ্তহত্যা বন্ধ করার জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে বাধ্য করার মতো কর্মসূচি নিতে হবে। আইনের শাসন কায়েমের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সরকারকে বাধ্য করতে হবে।
৭. বিচার বিভাগের এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা প্রয়োজন। সব বিচারক ও বিচার প্রতিষ্ঠানকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুম, গুপ্তহত্যা বন্ধের দাবিতে সোচ্চার ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিচার বিভাগকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গুপ্তহত্যা ও গুমের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে রুল জারিতে এগিয়ে আসতে হবে।
দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য আইনের শাসন অত্যন্ত জরুরি। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এভাবে দেশে গুম ও গুপ্তহত্যা বৃদ্ধি হতে দেখলে বিনিয়োগের জন্য এগিয়ে আসবে না। অর্থনীতির এই ক্রান্তিকালে সুশাসন ও ন্যায়ের শাসন অত্যন্ত জরুরি। যেকোনো উপায়ে গুম ও গুপ্তহত্যার রাজনীতি থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে।
১৭.০১.২০১২
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও
সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআই

No comments

Powered by Blogger.