বাংলাদেশ-ভারত-প্রত্যাশার সফর by কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

মার মতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি ইতিবাচক রূপ লাভ করবে, তা হচ্ছে কানেকটিভিটি। অনেকটা জুজুর ভয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহ দেখিয়েছি। জুজুর ভয় থেকেই আমরা অতীতে এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যোগদান থেকে বিরত থেকেছি।
কী এক ভ্রান্তি থেকে আমাদের নীতিনির্ধারকরা সবসময় আঞ্চলিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতে চেয়েছে। এই যুগে যে বিচ্ছিন্ন থেকে উন্নতি সম্ভব নয়, আমরা বুঝতে চাইনি। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে একটি সুদৃঢ় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল


ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বাংলাদেশ সফর শুরু হচ্ছে আগামীকাল। আমরা দেখছি, দু'দিনের এই রাষ্ট্রীয় সফরকে কেন্দ্র করে প্রতিবেশী দুই দেশ বেশ ভালোভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে ড. মনমোহন পণ্ডিত, সজ্জন। বাংলাদেশে তার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। কিন্তু এ দেশের নাগরিক হিসেবে মনমোহন সিংয়ের সফর আমাদের মনে আশা জাগায় অন্য কারণে।
মনমোহন সিংয়ের এই সফরে যেসব চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে, তার মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতারও নতুন দুয়ার খুলে যাবে আশা করা যায়। আমি নিজে যে বিষয়টিতে বেশি সম্ভাবনা দেখছি, তা হচ্ছে, বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে দুই দেশ দৃঢ় ও ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছে। গত চার দশক বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি সময় ধরে ঝুলে থাকা এসব সমস্যার সমাধান ছাড়া দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নতুন নতুন দ্বার উন্মোচন প্রায় অসম্ভব।
দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে প্রথমেই বলতে হবে তিস্তাসহ অভিন্ন আরও কয়েকটি নদ-নদীর পানি বণ্টনের কথা। দীর্ঘদিন থেকে দুই দেশ বারবার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও কোনো সুরাহা সম্ভব হয়নি। ভাগাভাগীর ব্যাপারে সদিচ্ছা থাকলেও কে কত ভাগ পানি পাবে, সে নিয়ে মতৈক্যের অভাবে কোনো চুক্তিতে উপনীত হওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তাব ছিল নাব্যতার জন্য নদীতে ২০ ভাগ রেখে বাকি পানি সমভাবে বণ্টন করা হোক। এই প্রস্তাব ন্যায়সঙ্গত। কিন্তু ভারতের দিক থেকে তা মানতে আপত্তি ছিল। শেষ পর্যন্ত তিস্তার পানি বণ্টনে একটি চুক্তি হচ্ছে। আশা করা যায় তাতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকবে । আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, কোনো চুক্তি না থাকায় এতদিন বাংলাদেশ খুব স্বল্প পানি পেয়েছে, পায়ওনি। চুক্তি হলে তা অনেক বেড়ে যাবে এবং একই সঙ্গে জবাবদিহিতার বিষয়টিও সামনে এসে যাবে। চুক্তি না থাকাতে বাস্তবে তো তিস্তায় শুকনো মৌসুমে পানিই থাকে না। এও স্বীকার করতে হবে যে, তিস্তার বিষয়টি জটিল। কারণ এই নদীতে সীমান্তের দুই পাশেই ব্যারাজ ও সেচ প্রকল্প রয়েছে।
ভারত ফেনী নদী থেকে শুষ্ক মৌসুমে পানি উত্তোলন করতে চায়। এ ব্যাপারে একটি চুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে। পানি উত্তোলন করতে দিতে বাংলাদেশের আপত্তি নেই; কিন্তু পরিমাণ নিয়ে মতভিন্নতা ছিল। এখন জানা যাচ্ছে সমান সমান ভাগাভাগী হবে। কারণ ওই নদীতে বাংলাদেশের একটি সেচ প্রকল্প রয়েছে। সেটাকে সচল রাখতে হলে পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। আরও কয়েকটি নদীর পানি ভাগাভাগী নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চলছে। আসলে অভিন্ন সব নদীর ব্যাপারেই একটি সমঝোতায় আসা দরকার। আমি আশা করি, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমার নদীর ক্ষেত্রেও অগ্রগতি হবে।
বাংলাদেশ-ভারতের দীর্ঘ সীমান্তে সামান্য কয়েক কিলোমিটার এলাকা অচিহ্নিত ছিল। আমি বলব, দুই পক্ষ আন্তরিক হলে অনেক আগেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা সম্ভব হয়নি। এখন সমঝোতায় পেঁৗছানো গেছে। ইতিমধ্যে অচিহ্নিত ও অপদখলীয় এলাকায় জরিপ কাজ সম্পন্ন করা গেছে। দুই দেশে নিযুক্ত ভারত ও বাংলাদেশের হাইকমিশনাররা মানচিত্রের মাস্টার কপি স্বাক্ষর শুরু করেছেন। সবাই ধারণা করছে, মনমোহন সিংহের বাংলাদেশ সফরের সময় অচিহ্নিত সীমান্তের বিষয়টি ফয়সালা হয়ে যাবে। একই সঙ্গে সীমান্তের অন্যান্য সমস্যাও দূর হবে আশা করা যায়।
সীমান্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত বিভাগের পর থেকেই বিষফোঁড়া এবং একই সঙ্গে অনেক মানুষের জন্য অশেষ যন্ত্রণা ও দুর্ভোগের কারণ হয়েছিল পারস্পরিক ছিটমহলগুলো। এগুলোর অধিবাসী যেন কোনো দেশেরই 'পরিচয়' বহন করে না। নাগরিক হিসেবে টিকে থেকেও যেন কোথাও নেই। যে দেশের নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার রয়েছে, সেখানকার কোনো নাগরিক সুবিধা গ্রহণ করতে পারে না। আবার যে দেশের নাগরিক সুবিধা তাদের হাতের নাগালে, তাতে তাদের অধিকার নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের মতো মৌলিক মানবাধিকারগুলো থেকে তারা দশকের পর দশক বঞ্চিত থেকেছে। মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় তাদের বঞ্চনার অবসান হবে আশা করা যায়।
আমার মতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি ইতিবাচক রূপ লাভ করবে, তা হচ্ছে কানেকটিভিটি। অনেকটা জুজুর ভয়ে আমরা দীর্ঘদিন ধরে আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহ দেখিয়েছি। জুজুর ভয় থেকেই আমরা অতীতে এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যোগদান থেকে বিরত থেকেছি। কী এক ভ্রান্তি থেকে আমাদের নীতিনির্ধারকরা সবসময় আঞ্চলিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতে চেয়েছে। এই যুগে যে বিচ্ছিন্ন থেকে উন্নতি সম্ভব নয়, আমরা বুঝতে চাইনি। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে একটি সুদৃঢ় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। আমরা তো এক সময় একই দেশ ছিলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে ভারত যখন ভাগ হয়, তখনও কিন্তু সীমান্তের দুই পাশে যোগাযোগ অটুট ছিল। বিশেষ করে নিয়মিত রেল চলেছে। নৌপথে জাহাজ চলেছে। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আর রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সম্প্রতি সীমিতভাবে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।
আমাদের দেশে সবসময় ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু যোগাযোগ অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা কিংবা বাড়ানোর ব্যাপারে উদ্যোগ ছিল না। দুই দেশের মধ্যে কানেকটিভিটি না থাকলে বাণিজ্য কীভাবে বাড়বে? বাণিজ্য বাড়াতে হলে যোগাযোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
আমাদের অজানা নয়, কী কারণে এতদিন দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। এতদিন ঘটেনি বলে বসে থাকা যাবে না। এখন এগিয়ে যেতে হবে। আমরা দেখেছি, গত বছর জানুয়ারিতে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে গিয়ে এর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে এসেছেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর যৌথ ঘোষণায় সম্ভাব্য সব বিষয়ে সহযোগিতার কথা বলা হয়েছিল। মনমোহন সিংয়ের এবারের সফরের মধ্য দিয়ে সেসব প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন শুরু হলো। সমৃদ্ধ ভারত ও বাংলাদেশ এবং বৃহত্তর অর্থে সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তুলতে হলে পারস্পরিক সহযোগিতার বিকল্প নেই। আমরা দেখেছি, ইউরোপে যেসব দেশ দশক দশক ধরে, দফায় দফায় যুদ্ধ করেছে, তারা আজ পরস্পরকে সব ধরনের সহযোগিতা করছে। ইউরোপ একটি অর্থনৈতিক ইউনিয়নে পরিণত হয়েছে_ এক দেশের নাগরিক আরেক দেশে বিনা বাধায় যেতে পারে, চাকরি করতে পারে, ব্যবসা করতে পারে। আর বাংলাদেশ-ভারত তো একই সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ধারণ করে। ইউরোপের দেশগুলোর মতো আমরা কখনও যুদ্ধরতও ছিলাম না। তাহলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে অসুবিধা কোথায়?
ড. মনমোহন সিংয়ের এবারের সফর সফল হোক। ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা ও যোগাযোগ বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানের সম্পর্কও নতুন মাত্রা পাবে আশা করি। ইতিমধ্যে দক্ষিণ এশিয়া ইউনিয়ন গঠনের ব্যাপারে সার্ক দেশগুলো নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর সেক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ : অর্থনীতিবিদ
চেয়ারম্যান পিকেএসএফ

No comments

Powered by Blogger.