রংপুর মেডিকেল কলেজঃ সরকারি হাসপাতালে রোগ নির্ণয় করে ডায়াগনস্টিক সেন্টার! by আরিফুল হক

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাঁচটি বিভাগে রোগ নির্ণয়ের ৪২টি যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে আছে। এই অজুহাতে অনেক রোগীকে রোগ নির্ণয়ের জন্য চিকিৎসকেরা বেসরকারি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে পাঠাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেসরকারি রোগনির্ণয় কেন্দ্রের লোকজন হাসপাতালে এসে রোগীর শরীর থেকে রক্তের নমুনা নিচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানদের সহযোগিতায় রোগনির্ণয় কেন্দ্রের লোকজন হাসপাতালে অনুপ্রবেশ করছেন।

চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানরা হাসপাতালের চাকরির পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন রোগনির্ণয় কেন্দ্রে সময় দিচ্ছেন বলেও জানা যায়। বাইরের লোক এসে হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে রোগীর রক্ত নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম বলেন, ‘রোগীদের দুর্ভোগ কমাতে এটা করা হতে পারে।’ গত সোমবার দুপুর ১২টায় হাসপাতালের হূদেরাগ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, এখানে ভর্তি হওয়া লালমনিরহাটের মর্জিনা বেগমকে (৫৫) রক্ত ও মলমূত্র পরীক্ষার জন্য (র‌্যানডম ব্লাড সুগার বা আরবিএস) পুপলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বলা হয়েছে। যদিও হাসপাতালেই এই পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। কিছুক্ষণ পর পপুলারের একজন কর্মচারী এই ওয়ার্ডে এসে রোগীর রক্তের নমুনা নেন।
হাসপাতালের ৩ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে গত রোববার সকালে ভর্তি হয়েছেন মিঠাপুকুরের রাশিদা বেগম (৫০)। তাঁর ব্যবস্থাপত্রে আরবিএস করানোর কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি রোগনির্ণয় কেন্দ্রের লোক এসে রাশিদারও রক্তের নমুনা নেন। রাশিদা বলেন, ‘বাইরোত থাকি আসিয়া ওয়ার্ডের ভিতরোত শরীর থাকি মোর রক্ত নিয়া গেলো।’ কোথায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে, তা রাশিদা জানেন না।
জানা যায়, গত রোববার সকাল ১০টায় শহরের কামালকাছনার গৃহিণী রেহানা সরকার (৫৫) ২ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে ভর্তি হন। ভর্তির পর এই বিভাগের চিকিৎসক আবুল কালাম আজাদ তাঁকে দেখে সিটিস্ক্যান ও আরবিএস পরীক্ষার পরামর্শ দেন এবং পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বলেন। এ ব্যাপারে চিকিৎসক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘এখানকার যন্ত্র খারাপ বলেই তো বাইরে থেকে করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের তিনজন টেকনিশিয়ান মনোয়ারুল ইসলাম, জ্যোতিষ চন্দ্র ও পঙ্কজ চৌধুরী পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিকেল থেকে চাকরি করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে তাঁরা কেউ মুখ খোলেননি। এই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আলতাফ হোসেন দাবি করেন, ‘সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পর বাইরে চিকিৎসা দিতে সরকারি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।’
পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপক আবদুল আহাদ এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, রেডিওলজি বিভাগে ২১টি এক্স-রে যন্ত্র আছে। এর মধ্যে ১১টিই নষ্ট। এসব যন্ত্রের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ওয়াটসন ৩০০ এমএ, পিকার ১৫ এমএ, মোবাইল এক্স-রে, পোর্টেবল এক্স-রে, মেডিরোল ৫০০ ও ১০০ এমএ যন্ত্রগুলো ১২ থেকে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে নষ্ট। এই বিভাগে মস্তিষ্ক ও সূক্ষ্ম রোগ নির্ণয়ের সিটিস্ক্যান যন্ত্রটি এক বছর, দেহের হাড় ও মস্তিষ্কের রোগ নির্ণয়ের এমআরআই যন্ত্রটি তিন মাস এবং আল্ট্রাসনোগ্রামের দুটি যন্ত্র এক বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। নিউরোসার্জারি বিভাগে একটি আল্ট্রাসনোগ্রাম ও একটি এনডোসকোপি যন্ত্র এক বছর ধরে নষ্ট। ফলে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হচ্ছে না।
নাক-কান-গলা বিভাগে অস্ত্রোপচারের জন্য একটি মাইক্রোস্কোপ-সার্জারি যন্ত্র থাকলেও এটিও দুই বছর ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে। এই বিভাগের চিকিৎসক এ এম আল রব্বানী জানান, যন্ত্রটির অভাবে কানের পর্দা লাগানোসহ সূক্ষ্ম অনেক অস্ত্রোপচার করা যাচ্ছে না। মেডিসিন বিভাগে দুটি কিডনি ডায়ালাইসিস যন্ত্রের মধ্যে একটি যন্ত্র দুই বছর ধরে নষ্ট।
হূদেরাগ বিভাগের ২৪টি ইসিজি যন্ত্রের মধ্যে ২০টিই অচল। চারটি সচল থাকলেও যন্ত্রগুলো পরিচালনা করতে চারটি তারের প্রয়োজন হয়। রয়েছে মাত্র একটি। যন্ত্র ভালো থাকলেও তারের অভাবে তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এই বিভাগের করোনারি ইউনিটে সংকটাপন্ন রোগীদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য চারটি মনিটরের মধ্যে তিনটি অচল। মাত্র একটি দিয়ে চলে চিকিৎসা কার্যক্রম। ‘এই বিভাগে চিকিৎসা নিতে এসে যন্ত্রের অভাবে অনেক রোগীর সঙ্গে হামাকও বেগ পাওয়া লাগছে।’ বললেন পঞ্চগড়ের আউয়াল মিয়া। এমনি দুর্ভোগ ও ভোগান্তির কথা বললেন আরও অনেক রোগী। হূদেরাগ বিভাগের চিকিৎসক গোলজার আহমেদ বলেন, যন্ত্রগুলো বিকল হয়ে পড়ে থাকায় রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয়।
এদিকে বিকল ৪২টি যন্ত্রের আনুমানিক মূল্য ১১ কোটি টাকা। এর মধ্যে সিটিস্ক্যান যন্ত্রের দাম সাড়ে তিন কোটি টাকা, এমআরআই যন্ত্র সাড়ে ছয় কোটি, কিডনি ডায়ালাইসিস যন্ত্র ১০ লাখ, হূদেরাগ বিভাগে ২০টি ইসিজি যন্ত্রের মূল্য সাত লাখ, রেডিওলজি বিভাগে কম্পিউটেড রেডিওগ্রাফি ২০ লাখ, ১১টি এক্স-রে যন্ত্র ৩৩ লাখ টাকা। এ ছাড়া গত বছর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (আইসিইউ) জন্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা মূল্যের রোগ নির্ণয়ের যন্ত্র এলেও এসব এখনো চালু হয়নি। হূদেরাগ বিভাগে চালু না হওয়া ইটিটি যন্ত্রটির মূল্য প্রায় ১২ লাখ টাকা।
রোগ নির্ণয়ের জন্য এতগুলো যন্ত্র বছরের পর বছর ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে থাকার কথা নিশ্চিত করে হাসপাতালের পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এসব যন্ত্র ভালো করার জন্য একাধিকবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগে পত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এযাবৎ কোনো সাড়া মেলেনি।
নতুন আনা যন্ত্রগুলো চালু না করার ব্যাপারে তৌফিকুল ইসলাম বলেন, আইসিইউ এখনো চালু হয়নি বলে যন্ত্রগুলো পড়ে আছে। শিগগির এই বিভাগ চালু করা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.