যুদ্ধাপরাধের বিচার-বিএনপির দাবি অযৌক্তিক

কাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বন্ধের দাবি জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। শনিবার দলের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শীর্ষস্থানীয় নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ট্রাইব্যুনালকে সরকারের 'আজ্ঞাবহ রাবার স্ট্যাম্প' অভিহিত করেছেন। সংসদ সদস্য মওদুদ আহমদের বক্তব্য ছিল লিখিত এবং এ কারণে এ অভিমত ব্যক্তিগত নাকি


দলীয় এবং তা যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে কি-না সে বিষয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। বিএনপি তার রাজনৈতিক অবস্থান সঠিকভাবেই তুলে ধরেছে। কিন্তু বিভ্রান্তি হতে পারে এ দলটির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। দলটি তাদের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে 'স্বাধীনতার ঘোষক' হিসেবে দাবি করে। অথচ তারা এখন দাবি তুলছে, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিল, যাদের হাত মুক্তিযোদ্ধা এবং নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুর রক্তে রঞ্জিত, যারা বিজয়ের প্রাক্কালে ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শিক্ষক-সাংবাদিক ও অন্য পেশাজীবীদের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল তাদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করার। তাদের রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সহযোগী জামায়াতে ইসলামী এতদিন এ ধরনের দাবি জানিয়ে আসছিল। বিএনপি কেবল ট্রাইব্যুনালের গ্রহণযোগ্যতা, বিচারের মান, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মানবাধিকার রক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে বক্ত্ব্য দিয়ে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য কিছুটা হলেও বজায় রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের চলি্লশতম বার্ষিকীর মাসে তারা সরাসরি মানবতাবিরোধীদের পক্ষ অবলম্বন করল, যা শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়, দেশবাসীর প্রত্যাশার বিরুদ্ধেও সরাসরি অবস্থান গ্রহণ। ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা এবং বিচার কাজের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার দাবি তোলায় অন্যায় কিছু নেই। এই বিচার গণহত্যার অপরাধে জড়িতদের বিচারের জন্য বিশ্বের সর্বত্র যেন মডেল হিসেবে গণ্য হতে পারে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা যেন সচেতন থাকে, সেটা কাম্য। ট্রাইব্যুনালের তরফে স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচার কাজ বন্ধ রাখার দাবি উত্থাপন কীভাবে সম্ভব? এ দাবি তোলার মধ্য দিয়ে বিএনপি তাদের মিত্র জামায়াতে ইসলামীর প্রতি সহানুভূতি-সহমর্মিতার মনোভাব হয়তো জোরালো করল, কিন্তু যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের বিচার আয়োজনের যে দাবি দেশবাসী মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই জোরালোভাবে তুলে ধরছে তার প্রতি প্রকাশ করা হলো চরম অবজ্ঞা। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের এটা ভুলে যাওয়ার কথা নয় যে, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের জন্য দলের ভেতর থেকেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে জোট বাঁধাকে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। নির্বাচনের প্রচারাভিযানকালে বিশেষভাবে তরুণ প্রজন্ম এ বিচার কাজ শুরুর জন্য জোরালো দাবি তোলে এবং বিজয়ী মহাজোট তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিচার কাজ শুরু করে। এ থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই এবং তার দাবি তোলাও অন্যায়। এ বিচার বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ করার যে আহ্বান বিএনপি জানিয়েছে সেটাও কিন্তু রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার নজির হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ঘটেছে প্রকাশ্যে এবং এর সঙ্গে জড়িতরা চিহ্নিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেন তার বিচার বন্ধে হস্তক্ষেপ করবে এবং সেটা করলেই-বা আমরা কেন মেনে নেব?

No comments

Powered by Blogger.