সুন্দর ফুটবলের পূজারি মানবদরদি এক প্রাণ

ফুটবলে জয়টাই সব কিছু নয়। শিল্প আর সৌন্দর্য খেলাটার অবিচ্ছেদ্য অংশ। খারাপ খেলে জয়ের চেয়ে ভালো খেলে হেরে গেলে কোনো অনুতাপ থাকত না আমার'_সক্রেটিসের অমর বাণী। গ্রিক মহান দার্শনিক সক্রেটিস নন, ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার সক্রেটিসের কথা এটা। পুরো নাম সক্রেটিস ব্রাসিলেইরো সাম্পাইয়ো ডি সুজা ভিয়েইরা ডি অলিভেইরা। মা-বাবা হয়তো দর্শনেরই ভক্ত ছিলেন, তাই হয়তো এত বড় নামের শুরুটা 'সক্রেটিস' দিয়ে।


এ দর্শনটাই তিনি এনেছিলেন ফুটবল মাঠে। ছিলেন ডাক্তার আর বেশ বড় মাপের শিল্পী। পুরো মাঠ নিয়ন্ত্রণের অসাধারণ ক্ষমতা ছিল বলেই তো পেলে তাঁর সেরা ১২৫ খেলোয়াড়ের তালিকায় রেখেছেন সক্রেটিসকে। ওয়ার্ল্ড সকারও রেখেছে সেরা ১০০-তে।
উচ্চতা ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি। মুখে দাড়ি। মাথায় হেডব্যান্ড। ফর্সা সুন্দর মুখটা দেখে অনেকে তাঁর চেহারায় যিশুখ্রিস্ট্রের সঙ্গেও মিল খুঁজে পেতেন!
ব্যক্তিজীবনে সক্রেটিস ছিলেন বেশ বেপরোয়া। ধূমপান করতেন প্রচুর। আর অতিরিক্ত মদপান করে দফারফা করে ছেড়েছিলেন পাকস্থলীটার। অন্ত্রে সংক্রমণের কারণে ভর্তি হয়েছিলেন সাও পাওলোর একটি হাসপাতালে। স্ত্রীর দাবি অনুযায়ী খাদ্যে বিষক্রিয়া আর ডাক্তারদের মতে 'সেপটিক শক'-এ সেই হাসপাতাল থেকেই না-ফেরার দেশে চলে গেছেন ১৯৮২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের স্বপ্নের দলের অধিনায়ক। মাত্র ৫৭ বছর বয়সে এ কিংবদন্তি পৃথিবীর ওপারে পাড়ি জমানোয় শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছে পুরো ফুটবলবিশ্ব।
কিছু কিছু খেলোয়াড়ের নাম শুনলে ফুটবল দক্ষতার পাশাপাশি অন্য গুণগুলোও ভেসে ওঠে চোখের সামনে। যেমন স্ট্যানলি ম্যাথুজ। তাঁর 'নাৎসি স্যালুট' না দিতে চাওয়ার প্রতিবাদী ছবিটা ভোলা যায় না কোনোভাবেই। প্রতিবাদী ছিলেন সক্রেটিসও। ব্রাজিলের সামরিক জান্তার বিপক্ষে প্রতিবাদ জানাতে করিন্থিয়ান্সে খেলার সময় জার্সিতে লিখতেন 'ডেমোক্রেসি'। ১৯৮২ সালের কিছু ম্যাচে সক্রেটিসের করিন্থিয়ান্সের খেলোয়াড়রা জার্সির পেছনে লিখেছিল, 'আমি আমার প্রেসিডেন্টকে ভোট দিতে চাই।' ভক্ত ছিলেন চে গুয়েভারা, জন লেনন আর ফিদেল কাস্ত্রোর। কাস্ত্রোকে এত বেশি পছন্দ করতেন যে ছয় সন্তানের নামই রেখেছেন কাস্ত্রো! স্ত্রীর প্রচণ্ড আপত্তির মুখে এমন সিদ্ধান্তের পেছনে যুক্তি তুলে ধরে বলতেন, 'ভেবে দেখো এক কাস্ত্রো কিভাবে বদলে দিয়েছে কিউবাকে। তোমার তো ছয় ছয়জন কাস্ত্রো, তোমাকে কখনোই মাথা নিচু করে থাকতে দেবে না ওরা।'
প্রতিবাদী মানুষটির হৃদয়টা ছিল কোমল। তাই চালাতেন দাতব্য চিকিৎসালয়। বিনে পয়সায় রোগী দেখতেন রোজ সকালে। নিজের শরীর ভালো না থাকলেও অসুস্থ স্ত্রীর শুশ্রূষার জন্য সেবিকা না রেখে সেবা করতেন নিজেই। গানও গাইতেন সক্রেটিস। তাঁর কয়েকটি গান এখনো মুখে মুখে ফেরে ব্রাজিলিয়ানদের।
৫০ বছর বয়সে ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের নর্দার্ন ফুটবল ইস্ট ফুটবল লিগের ক্লাব গারফোর্থ টাউনের হয়ে খেলেছিলেন একটা ম্যাচে। ম্যাচটিতে ১২ মিনিট মাঠে থাকার পেছনের উদ্দেশ্য ক্লাবের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। সক্রেটিসকে এক নজর দেখতে গ্যালারি ভরে উঠলেও এ জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেননি এ কিংবদন্তি। তাই সক্রেটিসের আত্মার শান্তি কামনা করে গারফোর্থ চেয়ারম্যান সাইমন ক্লিফোর্ড জানালেন, 'ওর উপস্থিতিটা ছিল জাদুর ছোঁয়ার মতো। সবাই চিৎকার করছিল ওর নাম ধরে। অথচ একটা পয়সাও আমাদের কাছ থেকে নেয়নি সক্রেটিস।'
ব্যক্তি সক্রেটিসের মতো ফুটবলার হিসেবেও তিনি অনন্য। ব্রাজিলের ফুটবল অধিনায়ক হওয়াটা এক জীবনের সেরা প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে। সেখানে জিকো-ফ্যালকাও-জুনিয়র-এডারের মতো ফুটবলারদের নেতা হয়ে গিয়েছিলেন ১৯৮২ বিশ্বকাপে। ৪-২-২-২ ছকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছিলেন দর্শকদের। প্রথম ম্যাচেই সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে দুই ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ৩০ গজ দূর থেকে নেওয়া শটে অসাধারণ গোল করে মন কেড়ে নিয়েছিলেন সক্রেটিস। সেই ম্যাচে ২-১ গোলে জয়ের পর স্কটল্যান্ডকে ৪-১ ও নিউজিল্যান্ডকে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত করে সক্রেটিসের দল। দ্বিতীয় রাউন্ডে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ৩-১ গোলে জয়ের পর সেমিফাইনালের জন্য শেষ ম্যাচে ইতালির বিপক্ষে ড্র করলেই চলত ব্রাজিলের।
১২ মিনিটে সক্রেটিস করেছিলেন অসাধারণ একটা গোল। ডান দিক থেকে উঠে যেখান থেকে সেন্টার করা বা পাস দেওয়ার কথা, সক্রেটিস সেখান থেকে দিনো জফের মতো গোলরক্ষককে পরাস্ত করেছিলেন প্রথম বার দিয়ে বল জালে পাঠিয়ে! এমন মুগ্ধ করা গোলেও কাজ হয়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে নাম লেখানো ইতালি পাওলো রসির হ্যাটট্রিকে পেয়ে যায় ৩-২ গোলের জয়। আর কোটি দর্শকের বুক ভেঙে বিদায় নেয় সক্রেটিসের স্বপ্নের ব্রাজিল, যাদের আবার বলা হয় বিশ্বকাপ না-জেতা সর্বকালের সেরা দল। বলা হয়ে থাকে সেই দলটা তখন খেলছিল পরের শতাব্দীর ফুটবল!
১৯৮৬ বিশ্বকাপে অধিনায়ক ছিলেন না। তবে ছিলেন ব্রাজিলের ট্র্যাজেডির নায়ক। সেবার গ্রুপ পর্বে স্পেনের সঙ্গে আর শেষ ১৬-এর ম্যাচে পেনাল্টি থেকে গোল করেছিলেন পোল্যান্ডের বিপক্ষে। কিন্তু ফ্রান্সের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে মিস করে বসেন টাইব্রেকার। অনেকের মতে নির্ধারিত সময়ে ১-১ গোলে সমতা থাকা ম্যাচটা ছিল শতাব্দীর অন্যতম সেরা। টাইব্রেকারে গড়ানোর পর মাত্র এক পা এগিয়ে অলস ভঙ্গিতে নেওয়া সক্রেটিসের শটটা ঠেকিয়ে দেন ফ্রান্সের গোলরক্ষক জোয়েল বাতস। ফ্রান্সের হয়ে প্লাতিনি পেনাল্টি মিস করলেও শেষ পর্যন্ত ৩-৪ ব্যবধানে হেরে যায় ব্রাজিল। তারপর ৬০ ম্যাচে ২২ গোল করে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে নেন তিনি।
'৮২ ও '৮৬ বিশ্বকাপের মতো সক্রেটিসের সঙ্গে ফ্ল্যামেঙ্গোতেও খেলেছিলেন জিকো। অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন দুজন। সক্রেটিসের প্রয়াণের পর ব্রাজিলের একটি দৈনিকের কলামে জিকো লিখেছেন, '১৯৮২ ও '৮৬ বিশ্বকাপে একসঙ্গে খেলেছি আমরা। ১৯৮৬ সালে ফ্ল্যামেঙ্গোয় ও আসার পর আরো কাছাকাছি আসি দুজন। কঠিন জিনিসগুলো কত সহজে করতে পারত ও। আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম সক্রেটিসের ট্রেডমার্ক ব্যাকহিলগুলো দেখে। সেই ব্যাকহিলে কত নামি ডিফেন্ডারকে যে বোকা বানিয়েছে, ভাবাই যায় না। ওর এক ছেলে এখন আছে আমার ফুটবল একাডেমীতেই। আশা করি বাবার নাম উজ্জ্বল করবে ছেলেটা।'
ফুটবল থেকে অবসর নেওয়ার পর রাজনীতি, অর্থনীতি আর ফুটবল নিয়ে অসাধারণ সব কলাম লিখেছেন সক্রেটিস। ২০১০ বিশ্বকাপের আগে একটা কলামে জানিয়েছিলেন, 'আমি চাই ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতুক। কিন্তু যে রক্ষণাত্মক খেলাটা এখন ওরা খেলছে এটা ব্রাজিলিয়ান সাম্বা ফুটবল নয়। এভাবে খেলে চ্যাম্পিয়নও হওয়া যায় না। ব্রাজিলের আগের সেই মনকাড়া ফুটবলটাই এখন স্পেন খেলছে। ওরা চ্যাম্পিয়ন হলে খুশি হব আমি।' শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে স্পেনই।
কুর্নিশ সক্রেটিস, শান্তিতে ঘুমাও তুমি।

* সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এক সময় মাঠে নেমেছেন জার্সিতে 'ডেমোক্রেসি' লিখে।
* ফিদেল কাস্ত্রোর ভক্ত সক্রেটিস তাঁর ছয় সন্তানের নামই রেখেছেন কাস্ত্রো!
* ছিলেন পাস করা ডাক্তার। শিক্ষাটাকে কাজে লাগিয়েছেন গরিবের সেবায়। বিনে পয়সায় রোগী দেখতেন রোজ সকালে।
* মাঠে নজর কাড়ত তাঁর রাজকীয় চলাফেরা। এক পা এগিয়ে অলস ভঙ্গিতে পেনাল্টি নিতে গিয়ে যেমন বিশ্বকাপে হয়েছেন ব্রাজিলের ট্র্যাজিক হিরো, তেমনি ব্যাক হিলে বিভিন্ন সময় এমন সব গোলও করেছেন যেসবের জন্য ফুটবল তাঁকে মনে রাখবে বহুকাল।

No comments

Powered by Blogger.