তহবিলের ওপর জোর দিচ্ছে বাংলাদেশ

কিয়োটো প্রটোকলের দ্বিতীয় ধাপের নবায়ন না করা ও কার্বন নিঃসরণে চুক্তির বিষয়টি ২০২০ সাল পর্যন্ত স্থগিত রাখার বিষয়ে শিল্পোন্নত দেশগুলো অনড় অবস্থান নিয়েছে। ফলে গ্রিন ফান্ড ছাড়া আর কোনো আশার আলো নেই স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সামনে। মন্দের ভালো হিসেবে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো এখন সরাসরি অর্থ পাওয়ার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশ ২০২০ সাল পর্যন্ত বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের গ্রিন ফান্ড থেকে ২০১৩ সালের


মধ্যে অর্থ দাবি করেছে। বাংলাদেশের এ অবস্থানের পর অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশও দ্রুত টাকা পাওয়ার জন্য তহবিলের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। এরই মধ্যে পাকিস্তান, কলম্বিয়াসহ বেশ কিছু দেশ তহবিল থেকে অর্থ দাবি করেছে। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ২০০৭ সালে বালি সম্মেলনে শিল্পোন্নত দেশগুলো ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন সম্মেলনে একটি আইনগত
চুক্তি করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন তারা ২০২০ সালের আগে চুক্তি না করার প্রস্তাব দিয়েছে। ভারত, চীন, সৌদি আরব, রাশিয়া, কানাডা, জাপানের সমর্থন নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের এমন প্রস্তাবে বিরোধ জমে উঠেছে। স্বল্পোন্নত ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো এ প্রস্তাবের চরম বিরোধিতা করছে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কঠোর মনোভাবের প্রতি ইঙ্গিত করে সৌদি আরব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা কোনো আইনগত চুক্তিতে যেতে চায় না। কার্বন কমানোর বিষয়ে ২০২০ সালের আগে কোনো আইনগত চুক্তি হলেও তা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এদিকে একমাত্র আইনগত ভিত্তি কিয়োটো প্রটোকলও ভেস্তে যেতে বসেছে। শিল্পোন্নত দেশগুলো দ্বিতীয় ধাপ নবায়ন না করে অন্য ফরম্যাটে স্বল্প মেয়াদে কিয়োটো চাইছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রস্তাব মেনে নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলোকে আর আইনের মধ্যে আনা যাবে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্বন নিঃসরণ না কমালে শুধু অর্থ দিয়ে কোনো লাভ হবে না।
আজ মঙ্গলবার থেকে সম্মেলনের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক শুরু হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, আজ আলোচনা থেকে বেরিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত আসতে শুরু করবে। ডারবানে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পেঁৗছতে আজ জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবেন। পরে সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে বান কি মুন সম্মেলনের অগ্রগতি জানাবেন। এ বিষয়ে ইউএনএফসিসির সেক্রেটারি ক্রিস্টিনা ফিগুইরা বলেন, ডারবানে বেশ কিছু সুখবরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা সম্মেলনে একটি সমঝোতায় পেঁৗছতে বিশ্বের কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের সরকারপ্রধানকে নতুন করে আলোচনায় আনার চেষ্টা করছে। গতকাল অন্য এক সংবাদ সম্মেলনে কপ-১৭-এর সভাপতি মাইটে নোয়ানা মাসাবেনে বলেন, কানাডা, রাশিয়া ও জাপান কিয়োটো প্রটোকল থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘটনায় হতাশা ছড়িয়ে পড়লেও ডারবানে কিয়োটোর দ্বিতীয় ধাপের নবায়ন হবে বলে তিনি আশা করেন। তিনি বলেন, আফ্রিকান গ্রুপ, জি-৭৭ চায়না ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে হলেও কিয়োটোর দ্বিতীয় ধাপ নবায়ন করা হবে।
বাংলাদেশের প্রধান চার দাবি : গতকাল সোমবার ডারবানে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেছেন পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। মন্ত্রী বলেন, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ চাচ্ছে বিশ্ব একটা গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় আসুক। লিখিত বক্তব্যে মন্ত্রী বলেন, ডারবানে বাংলাদেশ চারটি প্রধান দাবি তুলে ধরেছে। এর মধ্যে প্রথমে রয়েছে, গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডকে কার্যকর করা; দ্বিতীয়ত অভিযোজন নীতিমালা ও অভিযোজন কমিটি কার্যকর করা। জলবায়ুর প্রযুক্তিকেন্দ্র সম্পর্কিত বিষয় ও এর বিস্তৃতি সম্পর্কে সম্মত হওয়া। তৃতীয়ত, কিয়োটা প্রটোকলকে বাঁচিয়ে রাখতে দ্বিতীয় পর্যায়ের কমিটমেন্ট পিরিয়ড কার্যকর করা। চতুর্থত, সময়োপযোগী, সমন্বিত ও আইনসম্মত নীতিমালা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়ে প্রটোকলকে আইনগত একটা চুক্তিতে রূপান্তর করা, যেটা ২০১২ সালের ডিসেম্বর থেকে কার্যকর করা যায়। সংবাদ সম্মেলনে ড. কাজী খলীকুজ্জমান, ড. আইনুন নিশাত, ড. আতিক রহমান. ড. আসাদুজ্জামান ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সচিব মেসবা-উল-আলম উপস্থিত ছিলেন।
বিক্ষোভ অব্যাহত : কার্বন নিঃসরণ কমানো ও কিয়োটো প্রটোকলের দ্বিতীয় ধাপের দাবিতে ডারবানে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল আট থেকে ১০ কিলোমিটারব্যাপী বিক্ষোভ মিছিলে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষমতাসীন দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এনসিএ) যুবকরা হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিক্ষোভকারীরা এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, এনসিএর যুব কমিটির নেতা ও ডারবানের মেয়রের সমর্থকরা এ হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীরা ইউএনএফসিসির স্বেচ্ছাসেবকের পোশাক পরে এ হামলা চালায় বলেও দাবি করা হয়।
বিলম্বিত চুক্তি গণহত্যার শামিল : কার্বন নিঃসরণ কমাতে বিলম্বিত চুক্তিকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছে বাংলাদেশের ছয়টি সংগঠন। গতকাল ডারবানে এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, স্বল্পোন্নত দেশগুলো গ্রিন ফান্ডসহ অর্থের দিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশগুলো বুঝতে চাচ্ছে না অর্থ দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না। সিএসআরএলের সদস্য সচিব জিয়াউল হক মুক্তার সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বাপার আবদুল মতিন, ইকুইটি বিডির রেজাউল করিম চৌধুরী, ড. আহসান উদ্দিন আহম্মেদ ও এনসিসিবির মিজানুর রহমান বিজয়। জিয়াউল হক মুক্তা বলেন, কপ-১৭ কোনো সমঝোতায় পেঁৗছতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের মতো গরিব এবং জলবাযু পরিবর্তনের ফলে বিপন্ন দেশগুলোতে বিপর্যয় নেমে আসবে, পরে অভিযোজনের জন্য যত অর্থায়নই করা হোক না কেন তা হবে অকার্যকর। ড. আহসান উদ্দিন বলেন, সমঝোতা তৈরিতে দীর্ঘসূত্রতা আর নিজেদের এ প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে নেওয়ার ধনী দেশগুলোর হুমকি প্রকারান্তরে গরিব দেশগুলোর প্রতি এক ধরনের জলবায়ু-সন্ত্রাস চালানো।
বন ও পরিবেশমন্ত্রীকে প্রবাসীদের সংবর্ধনা : দক্ষিণ আফ্রিকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা পরিবেশ ও বনমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে পূর্ণ মন্ত্রিত্ব পাওয়ায় সংবর্ধনা দিয়েছেন। রোববার সন্ধ্যায় ডারবানের একটি হোটেলে এ সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ছাড়াও জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা, এনজিও ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিকসহ প্রায় দু'শতাধিক ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.