মিয়ানমার চেম্বারের নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রী-অবাধ বাণিজ্য দু'দেশের চাহিদা মেটাতে পারে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে 'অবাধ বাণিজ্যে' তার সমর্থন জানিয়ে বলেন, আলোচনার মধ্য দিয়ে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে সীমান্তবাণিজ্য বৃদ্ধি করা সম্ভব। মিয়ানমারের রাজধানী নে পেই তাওয়ের ইয়াদনার তেইনগাহা হোটেলে ইউনিয়ন অব মিয়ানমার ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ইউএমএফসিসিআই) আয়োজিত নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা


বলেন। তিনিবলেন, অবাধ বাণিজ্যের মাধ্যমে দু'দেশের অব্যাহত চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের রাজধানী নে পেই তাওয়ে পেঁৗছলে তাকে লালগালিচা অভ্যর্থনা দেওয়া হয়।
নৈশভোজে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে শিল্পের জন্য বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং কাঁচামালের ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি চাল, ডাল ও সয়াবিন তেলের চাহিদা রয়েছে; যা মিয়ানমার থেকে আমদানি করা যেতে পারে।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশ মিয়ানমারকে তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার, ওষুধ, সিরামিক সামগ্রী, পাটজাত ও অন্যান্য পণ্য সরবরাহ করতে পারবে; যার মান বিশ্বের সমকক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় এসব পণ্যের বাজার রয়েছে বলে তিনি জানান।
ইয়াদনার তেইনগাহা হোটেলে নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমার বাংলাদেশের সহজাত বাণিজ্য অংশীদার। তিনি এ দু'দেশের ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ করেন তারা যেন তার সরকারের উদার বাণিজ্যনীতির সুবিধা নিয়ে সম্মিলিতভাবে লাভবান হন।
প্রধানমন্ত্রী ২০১২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় শিল্পপণ্য নিয়ে অংশ নেওয়ার জন্য মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এ মেলায় অংশ নিয়ে মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরা ইউরোপ ও আমেরিকার শিল্পপতিদের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগসূত্র গড়তে পারেন।
নৈশভোজে মিয়ানমারের শিল্প বণিক সমিতির সভাপতি ইউ উইন অং এবং সে দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অনুপ চাকমা ও এফবিসিসিআই সভাপতি এ. কে. আজাদ বক্তৃতা করেন।
লালগালিচা অভ্যর্থনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারে তিন দিনের সরকারি সফরে গতকাল বিকেলে সে দেশের নতুন রাজধানী নে পেই তাও পেঁৗছেছেন। স্থানীয় সময় বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইট নে পেই তাও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। সেখানে তাকে লালগালিচা অভ্যর্থনা দেওয়া হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ ওয়ান্না মং লুইন এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমা বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানান। ছোট্ট একটি শিশু প্রধানমন্ত্রীকে ফুলের তোড়া উপহার দেয়।
বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে শেখ হাসিনাকে মোটর শোভাযাত্রা সহকারে মিয়াত তাও উইন হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। মিয়ানমার সফরকালে তিনি এ হোটেলে অবস্থান করবেন।
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জাতীয় পতাকা ও শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে লেখা ব্যানার দিয়ে রাজধানীর রাস্তাঘাট সুসজ্জিত এবং বিভিন্ন সড়কের দুই পাশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থিন সেইনের ছবিসংবলিত বিশাল বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের মধ্যে রয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ এম জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব শেখ এম ওয়াহিদ উজ জামান, পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এবং এফবিসিসিআই সভাপতি এ. কে. আজাদের নেতৃত্বে একটি বাণিজ্য প্রতিনিধি দল।
মিয়ানমার চেম্বারের নৈশভোজ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের সঙ্গে পুরনো সীমান্তবাণিজ্য জোরদার এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে এক নতুন যুগ সূচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও প্রাচীন বাণিজ্যের ভিত্তিতে চমৎকার সম্পর্ক বিরাজ করছে। দুটি দেশের মধ্যকার বাণিজ্য জোরদার করা এখন দুটি দেশেরই নতুন দাবি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল এখানে একটি হোটেলে ইউনিয়ন অব মিয়ানমার ফেডারেশন অব চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ইউএমএফসিসিআই) উদ্যোগে আয়োজিত এক নৈশভোজসভায় এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী পারস্পরিক সমৃদ্ধি অর্জনে সহযোগিতার জন্য সড়ক, রেল, নৌ ও বিমান যোগাযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও জোরদার করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের এ অঞ্চলের তিনশ' কোটি মানুষের জন্য একটি অভিন্ন বাজার গড়ে তোলার প্রত্যাশায় আমরা ভারত, নেপাল, ভুটান ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছি।
এতে অন্যান্যের মধ্যে ইউএমএফসিসিআই সভাপতি উ উইন অং, এফবিসিসিআই সভাপতি এ. কে. আজাদ এবং মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত অনুপ কুমার চাকমাও বক্তৃতা করেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং বিশিষ্ট আইটি বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশে বাণিজ্য সুবিধার উলেল্গখ করে দু'দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য এ ধরনের একটি ইভেন্টের আয়োজন করার জন্য ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, এ অঞ্চলের সবচেয়ে পুরনো বাণিজ্য সংগঠন ইউএমএফসিসিআই এবং ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) একে অপরের সহযোগিতার ক্ষেত্রে উভয়েই লাভবান হবে।
জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার জন্য দুটি ফেডারেশনের মধ্যে এমওইউ স্বাক্ষরের উলেল্গখ করে তিনি বলেন, দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ উদ্যোগ নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ সালের পর থেকে দুটি দেশের মধ্যে যৌথ বাণিজ্য কমিশনের একাধিক বৈঠকের কথা উলেল্গখ করে বলেন, 'আমরা যৌথ কমিশন গঠন সংক্রান্ত বিষয়ে আবার চুক্তি স্বাক্ষরে পদক্ষেপ নিয়েছি।
শেখ হাসিনা বলেন, দু'দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এশীয় ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের অধীনে দ্রুত পেমেন্ট প্রক্রিয়া ও সরাসরি ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সুযোগ খুঁজে দেখতে যৌথভাবে কাজ করতে পারে।
মিয়ানমার যাত্রার প্রাক্কালে
এর আগে তিনদিনের সরকারি সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার মিয়ানমারের রাজধানীর উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যান। এদিন দুপুর ২টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি বিশেষ ফ্লাইটে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মিয়ানমারের উদ্দেশে রওনা হন।
বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় জানাতে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, বাণিজ্যমন্ত্রী জিএম কাদের।
আজ প্রেসিডেন্ট অফিসে প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার দেওয়া হবে এবং পরে তিনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থিন সেইনের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন। এ সময় দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকে অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। আজ রাতে প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেবেন।
প্রধানমন্ত্রী সে দেশের পার্লামেন্ট ভবন (পিথু হলুট্টাও) এবং ঐতিহাসিক উপাতাথান্দি প্যাগোডা ও সাদা হাতি দেখবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ ওয়ান্না মং লুইনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ ওয়ান্না মং লুইনের সঙ্গে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ জানান, সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর হোটেল স্যুটে তার সঙ্গে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউ ওয়ান্না মং লুইনের বৈঠককালে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এ বিষয়টিও স্থান পায়।
আজাদ বলেন, তারা দু'দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমারের সঙ্গে বিমান ও সড়কপথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এবং মিয়ানমার থেকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের উদ্যোক্তারা ঢাকার উদার বিনিয়োগ নীতিমালার সুযোগ গ্রহণ করতে এবং বাংলাদেশ থেকে উন্নতমানের পাট, সিরামিক, গার্মেন্ট, নিটওয়্যার ও ওষুধ আমদানি করতে পারেন।
বাজার অর্থনীতি বিষয়ক মিয়ানমারের নতুন নীতিমালা প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ওয়ান্না মং বলেন, তার দেশ দক্ষিণ এবং পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সেতুবন্ধ তৈরি করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, অ্যাম্বাসাডর অ্যাট লার্জ এম জিয়াউদ্দিন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব শেখ এম ওয়াহিদ উজ জামান, পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস ও প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী আগামীকাল ৭ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বালির উদ্দেশে রওয়ানা দেবেন এবং ওইদিন সন্ধ্যায় সেখানে পেঁৗছাবেন। বালিতে ৮ থেকে ৯ ডিসেম্বর ওয়েস্টিন রিসোর্ট নুসা দুয়ায় 'দ্য বালি ডেমোক্রেসি ফোরাম (বিডিএফ)-৪' শীর্ষক দু'দিনের আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশ নেবেন। এতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পাপুয়া নিউগিনি, তিমুর, বাংলাদেশ, ব্রুনাই দারুসসালাম, কাতার, শ্রীলংকাসহ ৫৪টি দেশ অংশ নেবে। এর মধ্যে ১৫টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের যোগদানের কথা রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.