বন, জার্মানি থেকে হামিদ মিরঃ ‘যুক্তরাষ্ট্রই আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার অন্তরায়’

জার্মানির বনে অনুষ্ঠিত গত সোমবারের সম্মেলনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আফগানিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র। এ সম্মেলনে অনেক কিছু আলোচিত হলেও অংশগ্রহণকারীরা একটি বিষয়ে একমত হয়েছেন, পাকিস্তানের অংশগ্রহণ ছাড়া এ বিষয়ে কোনো কিছু অর্জন সম্ভব নয়। বন সম্মেলনে আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই স্পষ্ট বলেছেন, পাকিস্তানই হচ্ছে আফগানিস্তানের সব সমস্যার মূল।

তবে সম্মেলনে অংশ নেওয়া মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ অন্য নেতারা পাকিস্তান সম্পর্কে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতার পরিচয় দিয়েছেন। হামিদ কারজাই আশা করেছিলেন বন সম্মেলনে ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে তীব্র ভাষায় নিন্দা জানানো হবে, কিন্তু তাঁর এ আশা পূরণ হয়নি। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন সম্মেলনের আগের রাতে কারজাইয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। সেই বৈঠকে তিনি সম্মেলনের সময় পাকিস্তানের বিপক্ষে কোনো বিরূপ মন্তব্য না করার জন্য আফগান প্রেসিডেন্টকে অনুরোধও জানিয়েছিলেন। হামিদ কারজাই ও কয়েকজন আফগান সাংবাদিকের সঙ্গে বৈঠকের অব্যবহিত পরেই বান কি মুন কথা বলেছিলেন এ প্রতিবেদকের সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন, আমরা পাকিস্তানকে ছাড়া কোনো বিষয়েই অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হব না। তিনি আরও বলেন, ‘আমি আশা করি, বন সম্মেলনে যেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে পাকিস্তান সেগুলোকে সম্মান জানাবে।’ জাতিসংঘের মহাসচিব হতবাক হয়েছিলেন যখন আফগান একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ড. হুসেইন ইয়াসা হামিদ কারজাইয়ের বিরুদ্ধাচরণ করে বলছিলেন, আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য হামিদ কারজাই মোটেও যোগ্য ব্যক্তি নন।
অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, বন সম্মেলন বয়কট করার পর পাকিস্তান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে হয়ে পড়বে। তবে একটি বিষয়ে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মহলে বার্তা পৌঁছে দিয়েছে, যথেষ্ট হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া কোনো কিছুর সঙ্গে তারা আর নেই। অনেক ইউরোপীয় কূটনীতিকই বন সম্মেলনে পাকিস্তানের অনুপস্থিতিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, ইরানের পাশে আরও একটি ‘ইরানে’র জন্ম হতে যাচ্ছে।
বন সম্মেলনে আফগানিস্তানে শান্তির রোডম্যাপ প্রণয়নে জড়িত কয়েকজন ইউরোপীয় কূটনীতিক এ সম্মেলন থেকে অনেক বড় কিছু অর্জনের প্রত্যাশা করছিলেন; কিন্তু মোহমান্দে ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনাটি এর পিঠে ছুরিকাঘাত করেছে। তালেবানেরা বন সম্মেলনের পরপরই ন্যাটোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। তাদেরকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল, পাকিস্তান ছাড়া যেকোনো একটি মুসলিম দেশে কূটনৈতিক দপ্তর প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তাদের অনুমতি দেওয়া হবে। জার্মান কর্মকর্তারা এ শান্তি আলোচনার সুবিধার্থে নিয়োগের জন্য কয়েকজনের নাম নিয়েও আলোচনা শুরু করেছিলেন। তালেবানদের শান্তি আলোচনায় রাজি করানোর ব্যাপারে পাকিস্তান অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সপক্ষে তালেবানদের বিভিন্ন বিষয়ে আশ্বস্তও করে রেখেছিল।
জার্মান কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে ভারতের সঙ্গেও আলোচনা শুরু করেছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, ভারত যেন আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে পাকিস্তানের ভূমিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না তোলে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সম্প্রতি জার্মানি সফর করে জার্মান পার্লামেন্টের সাউথ এশিয়া ফ্রেন্ডশিপ গ্রুপের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। ভারতীয় সেই সেনা কর্মকর্তা বৈঠকে আফগানিস্তানে শান্তি প্রক্রিয়ার রোডম্যাপ তৈরিতে পাকিস্তানের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। অনেক কিছুই প্রায় চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। মোহমান্দ এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার পর পাকিস্তান কেবল যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষমা চাইতে বলেছিল। কারণ, ঘরোয়া রাজনীতির ক্ষেত্রে পাকিস্তান সরকারের মুখরক্ষার জন্য তার দরকার হয়ে পড়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমা চাইতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে বন সম্মেলনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা এখন নৈরাশ্যে পরিণত হয়েছে।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান-বিষয়ক বিশেষ জার্মান দূত মাইক স্টেইনার রোববার রাত পর্যন্তও আশাবাদী ছিলেন, বন সম্মেলনে নিদেনপক্ষে জার্মানিতে অবস্থানকারী পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত অংশগ্রহণ করবেন। পাকিস্তানের ঘরোয়া রাজনীতিতে সরকারের মুখ রক্ষার জন্য কিছু করার ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্রকে অনুরোধ জানিয়েছিল জার্মানি। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারে কিছুই করেননি। তিনি কেবল পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারিকে টেলিফোন করে মোহমান্দের ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনায় স্টেইনার বলেন, বন সম্মেলনে পাকিস্তানের অনুপস্থিতি শান্তি প্রক্রিয়ায় একটি বিরাট ধাক্কা। তিনি আশা প্রকাশ করেন, পাকিস্তান খুব শিগগিরই এ শান্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যোগ দেবে।
জার্মান পার্লামেন্টের সদস্য পল লেহরিয়েডার আমাকে বলেছেন, তিনি গত সপ্তাহে বার্লিনে সাবেক তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াকিল আহমেদ মুতকালের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন। তাঁরা আফগানিস্তানে শান্তি প্রক্রিয়ার রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি জার্মান পার্লামেন্টের সাউথ এশিয়া ফ্রেন্ডশিপ গ্রুপের একজন সদস্য। ভারতীয় সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টিও আমাকে জানান তিনি। এ কর্মকর্তা হতাশার সুরে বলেন, মোহমান্দে যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলাই বন সম্মেলনের সব সম্ভাবনা শেষ করে দিয়েছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সহায়তা ছাড়া আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
আরেকজন জার্মান কূটনীতিক বলেন, তারা নাকি অনেক আগেই মোল্লা ওমরের একজন আত্মীয় ও সাবেক তালেবান নেতা তৈয়ব আগাকে এ ব্যাপারে সম্পৃক্ত করেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলা অনেক বিষয়েই জটিলতা তৈরি করেছে। সবচেয়ে বড় কথা এরপর আমরা কারজাই ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা হারিয়েছি। তৈয়ব আগা একজন জার্মান কর্মকর্তাকে বলেছেন, পাকিস্তান নাকি শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কারণেই ২০০১ সালে তালেবানদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছে। এবং এ কারণে তাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। ১০ বছর পর দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান সেই যুক্তরাষ্ট্রকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তাহলে তালেবানরা কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করবে, প্রশ্ন রাখেন তিনি। বন সম্মেলনে এ ব্যাপারে খুব পরিষ্কার একটি বার্তা তুলে ধরেছে। সেটি হলো, পাকিস্তান বন সম্মেলন বয়কট করায় আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ায় একটি স্থবিরতা তৈরি হলো। এবং আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ায় পাকিস্তানকে সম্পৃক্ত করতে না পারাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক বিরাট ব্যর্থতা। বন সম্মেলন বয়কট করে পাকিস্তান যদিও বিরাট এক ঝুঁকি নিয়েছে, তার পরেও তারা শেষ পর্যন্ত একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে যে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম। মূল ইংরেজি থেকে অনূদিত।

No comments

Powered by Blogger.