সহজ-সরল-আমি কোথায় পাব তারে? by কনকচাঁপা

ফেলে আসা দিনগুলো বড়ই মধুর হয়। মধুর মতো সোনালি ও মিষ্টি হয়। এটা খুবই নির্জলা সত্য। আর আমার অতীত? সত্যিই একটা মধুময় সোনালি অতীতের অধিকারী ছিলাম। সেখানে ছিল না বিলাসিতা, কিন্তু কোনো কিছুর অভাবও ছিল না। আমার শৈশব শুরু হয় সত্তরে। বাবার বাড়িটা ছিল একটা একাকী বাড়ি_একলা বাড়ি। বর্ষাকালে তা দ্বীপ হয়ে যেত। কারণ আশপাশ টলটলে পানি-মাছ-কচুরিপানার বেগুনি ফুলে রূপসী হয়ে উঠত আমাদের দ্বীপবাড়ি।


মাঝিরা লগি-বৈঠা চালিয়ে ছপছপাছপ গান গেয়ে চলে যেত বাড়ির পাশ ঘেঁষে। আমাদের ৩০-৩২টা হাঁস পদ্মফুল হয়ে বাড়ির চারপাশে প্যাঁক প্যাঁক করে কান ঝালাপালা করে দিত। পানিতে নানা কিছু খেয়েও আশ মিটত না_দল বেঁধে তাদের টিফিন খাবার জন্য লাইন দিত হেলেদুলে। পানিতে সাত-আট রকম জালের অধিকারী আব্বা আমার দিনভর (অফিসের সময় বাদে) মাছ ধরতেন। আম্মা কপট রাগে ঝাল ঝাড়তে ঝাড়তে তরকারিতে বেশি ঝাল দিয়ে ফেলতেন। নানা রকম সাপ দেখে ভয় না পেয়ে মুগ্ধ হয়ে যেতাম। সুযোগ পেলেই দিতাম ডুবসাঁতার। বর্ষার পানি শুকিয়ে গেলে বাড়ির সামনে গভীর খালের ওপর একটি বাঁশের সাঁকোতে সার্কাসের জোকারের মতো হাতল না ধরেই দৌড়ে যাওয়া-আসা খেলতাম ছোট ভাই মনির সঙ্গে। শীতকালে কুয়াশামাখা ভোরে সবজি ক্ষেতে পানি দিতাম। হাঁসগুলো সন্ধ্যাবেলা ঘরে তুলতে এই কনক 'রাখাল'-এর জুড়ি ছিল না। আবার ভোরবেলা ওদের ঘরভর্তি ডিম ঝুড়িতে তুলতাম তৃপ্তিভরে। সন্ধ্যাবেলা হারিকেনের আলোয় পড়তে বসতাম। পড়ায় ফাঁকি দিতে নিত্যনতুন ফন্দি আঁটতে ওস্তাদ ছিলাম। মার কাছে ধরা খাওয়ার চেয়ে বেশি ধরা পড়তাম রত্নাপার কাছে। নিজের পড়ায় মন নেই_সারা দিন আমার পিছে লেগে লেগে মার খাওয়ানোর বুদ্ধি আঁটত, আবার নিজেই আমাদের মানে আমাকে ও মনিকে গোসল, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সব করত। বিনিময়ে পাড়ার নায়কের কাছে (এখন দুলাভাই) চিঠি পেঁৗছে দিতে হতো নিয়মিত। সে নায়ক আবার গরু চড়ানোর উছিলায় গরুর দড়ি ধরে বাড়ির আশপাশে ঘুরত। বড় আপা নানাবাড়িতে থেকে পড়তেন, তাই আপা ছুটি-ছাটায় এলে আমাদের ঈদ হয়ে যেত। কিন্তু পারুল আপা কেমন মেহমান মেহমান ভাব করে থাকত। আম্মা আমাদের তুই তুই বললেও আপাকে তুমি বলায় সেটা আরো বেশি মনে হতো। প্রশ্ন আসতে পারে এর মধ্যে গান কোথায়? আরে গানই তো আগে। আর এতক্ষণ যা বললাম তা অনেক পড়ে! ভোরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে আব্বা-আম্মা নিজেরা উঠে আমাদের ডেকে দিতেন। নামাজ পড়ে গাছে পানিটানি দিয়ে হাঁস-মুরগি ছেড়ে খাবার দিতে দিতে ভোরের আলো ফুটত_আমার রেওয়াজের সময় হতো। কমপক্ষে আধা ঘণ্টা। এরপর নাশতা করতে করতে রেডিও শোনা। গান-খবর ইত্যাদি বিনোদনের একমাত্র অনুষঙ্গ। ৭টার খবর হওয়ার আগে আব্বাকে দুটি গান শোনাতে হবেই। হারমোনিয়ামের দুই দিকের দুই হাতলে ঠুকঠুক তাল ঠুকে চোখ বন্ধ করে মগ্ন হয়ে আব্বা গান দুটি শুনতেন। ১০ দিন ধরে এক গান শুনলেও একই রুটিন। গান শুনে তবেই তাঁর অফিস যাওয়া। আব্বার অফিসের ফাঁকেই আমার স্কুল শেষ। কোচিংয়ের বালাই আমার বা আমাদের একেবারেই ছিল না। অফিস থেকে এসেই বিকেলের গলাসাধা শুনতে হবে। এর থেকে কোনো নিস্তার আমার ছিল না। সন্ধ্যাকালীন পড়াশোনার পর রাতের ভাত খাওয়ার পর, যত রাতই হোক, আবার দুটি গান শুনতেই হবে। তার মধ্যে ভুল শুধরে দেওয়া, কারুকার্যগুলোর দানা গোল গোল করা, ধার দেওয়া, এগুলো নিপুণ কারিগরের মতো দক্ষ হাতে করে যেতেন বিরতি ছাড়াই। বড় মামা (জনাব আজিজুল বারী) আমাদের বাড়ি এলে সেদিন গানের বন্যা বয়ে যেত। কী কী গান নতুন শিখলাম, কোনটা বেশি ভালো_এগুলো নিয়ে কী গবেষণা! আর ছোট মামা মিন্টু ছিলেন পাগলভক্ত। তাঁর জ্বালায় আমার ঘুম, খাওয়া, গোসল_সব বন্ধ করে দিতে হতো। হাঁসগুলোর খোঁজ নিতে পারতাম না! এক গান পাঁচবার করে শুনতে নানা বায়নাক্কা তৈরি হতো। আর ছিল সপ্তাহান্তে ওস্তাদজি বশীর আহমদের বাসায় গিয়ে কঠোর সাধনা। সেখানে তো গানের আওয়াজ ছাড়া দমও নেওয়া বারণ ছিল। গান, হাঁস-মুরগি, বিড়াল, পড়াশোনা, ডুবসাঁতার_এর বাইরে কোনো জীবন ছিল না আমার। এখনো তাই। গান-বাসা-রান্না-সেলাই-বাগান-প্রার্থনা এবং আবারও গান। কিন্তু আমি এখন গান ফেরি করার জন্য গানকে ধরে রাখি। আমার গানপাগল বাবার জন্য বরাদ্দ 'সকালে দুটি রাতে দুটি' বাড়তি গান আমাকে গাইতে হয় না। আমার গানওয়ালা বাবা তাঁর মুঠো করা হাতে আমার সোনালি শৈশবকে ও একমুঠো নির্ভেজাল গানকে সঙ্গে করে নিয়ে চলে গেছেন কোথায় না কোথায়! তাঁকে আমরা কোথাও খুঁজে পাই না_না আমি, না মা, না মনি, না তানভীর, না আমার দুই বোন। ওরা কিভাবে আব্বাকে খোঁজে জানি না_আমি রাতভর স্বপ্নভেলায় লগি ঠেলে ঠেলে আমার সোনার গানওয়ালাকে খুঁজে বেড়াই। কিন্তু তাঁকে কোথায়_কোন পথের শেষে খুঁজে পাব তা কি আমি জানি? আমাদের মতো বাবাও কি আমাদের মনে রেখেছেন?

লেখক : সংগীতশিল্পী

No comments

Powered by Blogger.