একক প্রার্থী মাঠে রাখাই আওয়ামী লীগের চ্যালেঞ্জ by সাবি্বর নেওয়াজ,

কুমিল্লা শহরের টমছম ব্রিজ এলাকার দুধ ব্যবসায়ী আওরঙ্গজেব মোল্লা (৫২)। গ্রামের বাড়ি লাকসামে হলেও কুমিল্লা শহরে তিনি ২০ বছরের বেশি সময় ধরে গরুর দুধ বিক্রি করেন। 'কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে কার পাল্লা ভারী' জানতে চাইলে সরলভাবে বলেন, সরকারি দল জিতবো যদি নিজেরা পাড়াপাড়ি (দ্বন্দ্ব) না করে। একই অভিমত দেন কুমিল্লা স্টেডিয়াম মার্কেটের ফার্নিচার ব্যবসায়ী রাজীবুল আহসান হিমেল।
তার মতে, ভোটাররাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তারা জানে, সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থী বিজয়ী হলে এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত হয়।সরেজমিনে গিয়ে কুমিল্লা শহরের নানা স্থানে সাধারণ মানুষকে একই কথা বলতে শোনা গেল। তাদের মতে, আওয়ামী লীগের জন্য 'ঘরের শত্রু বিভীষণ' হয়ে যেতে পারে। জেলার একজন হুইপ ও অপর এক এমপি নিজেরাই বিদ্রোহী দুই প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন_ এমন অভিযোগ সাধারণ নেতাকর্মীদের মুখে মুখে। কুমিল্লা জেলা ও শহর আওয়ামী লীগ অ্যাডভোকেট আফজল খানকে সমর্থন দিলেও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে অনড় রয়েছেন সাবেক দুই ছাত্রনেতা। গুঞ্জন রয়েছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক ভিপি নূর উর রহমান মাহমুদ তানিমের পক্ষে সমর্থন রয়েছে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সংসদ সদস্য লোটাস কামালের (আ হ ম মোস্তফা কামাল)। আর দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আনিছুর রহমান মিঠুর পক্ষে সমর্থন রয়েছে জাতীয় সংসদের হুইপ ও চৌদ্দগ্রাম থেকে নির্বাচিত
সংসদ
সদস্য মুজিবুল হক মুজিবের।

জানা গেছে, কুমিল্লা আওয়ামী লীগের রাজনীতির দীর্ঘদিনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আফজল-বাহার। আফজল মেয়র প্রার্থী আর অন্যজন হাজি আকম বাহাউদ্দিন বাহার কুমিল্লা সদরের সংসদ সদস্য। এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তিন ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক ধারার নেতৃত্বে সংসদ সদস্য হাজি বাহার, অপর ধারায় হুইপ মুজিব ও অন্যটিতে আফজল খান অবস্থান নেন। ক্ষমতায় আসার পরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের ধারায় বিভক্তি থাকলেও তা সহাবস্থান পর্যায়ে ছিল। কিন্তু দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে এ তিন ধারার দ্বন্দ্ব আবারও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হুইপ মুজিব জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ শীর্ষ পদগুলো তার পছন্দের প্রার্থীদের দিয়ে দখল করে নেন। এতে বঞ্চিত ছাত্রলীগ কর্মীরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। এ নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী রাজনীতি সহিংস হয়ে উঠেছিল। বঞ্চিত ছাত্র নেতাদের পক্ষাবলম্বন করেন হাজি বাহার। জেলা ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব আবার বেড়ে গেছে। এরপর শুরু হয় পক্ষে-বিপক্ষে লড়াই। এরই মাঝে সামনে চলে এসেছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এবার নির্বাচনকে নিয়ে ওই নেতৃত্বের লড়াই থেমে থাকবে, নাকি চলমান হবে, এমন প্রশ্ন যখন সবার মুখে মুখে তখন নতুন চমক নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমেছেন ওই দুই সাবেক ছাত্রনেতা। তাদের একজন মিঠু বৃহস্পতিবার ও তানিম শেষ দিন শুক্রবার মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
সংসদ সদস্য লোটাস কামালের সমর্থন বিষয়ে জানতে চাইলে তানিম বলেন, আমার প্রতি কোনো ব্যক্তিবিশেষ বা সম্প্রদায়ের সমর্থন নেই। আমি কুমিল্লার সাধারণ মানুষ সমর্থিত প্রার্থী। 'একাধিক প্রার্থীর কারণে দল ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি-না' এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কুমিল্লার মানুষ নারায়ণগঞ্জের মানুষের চেয়েও সচেতন। কুমিল্লায় শিক্ষার হার সর্বোচ্চ। তারা দল দেখে নয়, মানুষ দেখে ভোট দেবেন। প্রার্থীদের বিগত দিনের আমলনামা দেখে বিচার-বিশ্লেষণ করে ভোট দেবেন। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে নতুন নেতৃত্ব দরকার।
অপর বিদ্রোহী প্রার্থী অ্যাডভোকেট আনিছুর রহমান মিঠু তার পক্ষে হুইপ মুজিবের সমর্থন আছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি ২২ বছর ধরে হুইপ মুজিবের পাশে থেকে রাজনীতি করছি। ওনার সঙ্গে আমার হৃদয়ের সম্পর্ক। দলে একাধিক প্রার্থী হলে কোনো ক্ষতি হয় না বলে মনে করেন মিঠু। তিনি বলেন, পৌর চেয়ারম্যান পদে এক সময় আফজল খান ও হাজি বাহার দু'জনই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। ওই সময় জাপা ও বিএনপি মাঠে ছিল। তখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী পাস করেছিল। এমনকি বিগত পৌর নির্বাচনেও বিএনপির দুই প্রার্থী থাকার পরও একজন পাস করেছেন।
এদিকে আফজল খানকে দলীয় সমর্থনের বিষয়ে অনুষ্ঠিত ২৯ নভেম্বরের শেখ হাসিনার ধানমণ্ডি কার্যালয়ের সভায়ও তানিম ও মিঠুর পক্ষাবলম্বন নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় জেলার সব সংসদ সদস্য এবং কুমিল্লা উত্তর ও দক্ষিণ জেলা নেতৃবৃন্দ অংশ নেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর আসনের সংসদ সদস্য হাজি আকম বাহাউদ্দিন বাহার সমকালকে বলেন, আমি দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। তানিম ও মিঠুর প্রার্থিতা বিষয়ে তিনি বলেন, এর জবাব লোটাস কামাল ও হুইপ মুজিব দেবেন। তাদের ইন্ধনে এ দু'জন মাঠে নেমেছেন। মিঠু নির্বাচনী কাজে হুইপ মুজিবের চেম্বার ব্যবহার করছে। আফজল খানের প্রার্থিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আফজল খান দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন। আমার সমর্থন তার পক্ষে থাকবে।
বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে দলের ভূমিকা বিষয়ে জানতে চাইলে বাহার বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের পদবিধারী হচ্ছেন ৪ জন। তারা হলেন আহ্বায়ক লোটাস কামাল, যুগ্ম আহ্বায়ক হুইপ মুজিব, আফজল খান ও সফিক শিকদার। বাকিরা সদস্য। দীর্ঘদিন দলের সম্মেলন না হাওয়ায় এভাবেই চলছে। নিজের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি সদরের সংসদ সদস্য। অথচ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য নই। জেলা আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম আহ্বায়ক সফিক শিকদার বলেন, দলের সিদ্ধান্ত সবার মেনে নেওয়া উচিত। জাতীয় সংসদের হুইপ মুজিবুল হক বলেন, আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়েছেন অ্যাডভোকেট আফজল খান। তিনি জেলার নেতৃবৃন্দেরও সমর্থন পেয়েছেন। তিনি বলেন, দলে একাধিক প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই।
নির্বাচন বানচালের চেষ্টা প্রতিহত
করা হবে :সাখাওয়াত
এদিকে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে নির্দলীয় নির্বাচনকে কোনো দল বা গোষ্ঠী বানচালের চেষ্টা করলে তা কঠোর হাতে প্রতিহত করা হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। গতকাল সোমবার নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে তিনি এ কথা বলেন।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দুটি রাজনৈতিক দল কুমিল্লায় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে গণমাধ্যমে বক্তব্য দিচ্ছে। কিন্তু এটি নির্দলীয় নির্বাচন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বা না হওয়া সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। দলীয়ভাবে কেউ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে ইসি। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তদন্তে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্বাচনের আগে এসব অপরাধ গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। যার শাস্তি ২ থেকে ৭ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। তিনি রাজনৈতিক দলের এ ধরনের বক্তব্যে ভোটারদের প্রভাবিত না হওয়ার আহ্বান জানান।
সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করতে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চলছে। সীমান্ত এলাকায় বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে বিজিবিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জেলা পুলিশ সন্ত্রাসী ও যাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে তাদের প্রতি বিশেষ নজর রাখছে। আগামী ১২ ডিসেম্বরে আইন-শৃঙ্খলা বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

No comments

Powered by Blogger.