ঢাকায় মহররমের ঐতিহ্য-হোসেনি দালানের সৌন্দর্যে ইরানি নান্দনিকতা by নওশাদ জামিল

হররমের মাস এলে শুধু ঐতিহাসিক হোসেনি দালান নয়, গোটা মহল্লা সাজে নতুন রূপে। কিন্তু ওই সাজে আলোর রোশনাই নেই, আছে শোকের প্রতীক। আশপাশের বাড়িঘর, দোকান ও ছাদে শোকের প্রতীক হয়ে ওড়ে কালো নিশান। চানখাঁরপুল পার হয়ে পশ্চিম দিকে সরু গলি ধরে কিছুটা এগুলেই শোনা যায় শোকের মাতম। এ গলিই নয়, এখন আশপাশের সব জায়গায় চলছে শোকের মাতম। সেখানের ঐতিহাসিক হোসেনি দালান ঘিরে হাজারো শোকার্ত


নর-নারী মর্সিয়া গাইছেন, হায় হোসেন! হায় হোসেন! মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা.)-এর স্মরণে নির্মিত এ স্থাপনার নাম তাঁর নামানুসারেই 'হোসেনি দালান ইমামবাড়া'। সরু ওই গলির নামও হোসেনি দালান রোড।
সম্প্রতি এ ঐতিহাসিক স্থাপনার সংস্কারকাজ শেষ হয়েছে। এতে হোসেনি দালানে ভেতরের ও বাইরের অঙ্গসজ্জা ও সংস্কারে ফুটে উঠেছে ইরানের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাশৈলী রূপ। সৌন্দর্যবর্ধনের এ কাজ করেছে ঢাকার ইরানি দূতাবাস। জানা যায়, ইরান সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় এতে ইরানের স্থপতিবিদ ও শিল্পীরা অংশ নেন। তাঁরা গত সাত মাস ধরে এ সংস্কারের কাজ করেন। তবে প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদরা সংস্কারের নামে হোসেনি দালানের সৌন্দর্যহানির অভিযোগ করেছেন। তাঁরা এ স্থাপনার আদি রূপ ফিরিয়ে আনারও দাবি জানিয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, সংস্কারের আগে ভেতরে রং-বেরঙের নকশা করা কাচের মাধ্যমে যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে বিভিন্ন আয়াত ও মুদ্রা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। একইভাবে এর পূর্বদিকের ফটকে এবং উত্তর দিকের চৌকোনা থামগুলোয় আয়াত ও সুরা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। টাইলসগুলো ইরান থেকে আমদানি করা এবং এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইরানের ধর্মীয় শিল্পকলা ক্যালিগ্রাফি। ইরানের বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনায় এ ধরনের টাইলস রয়েছে বলে জানা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ইরানের ধর্মীয় স্থাপনার বাহ্যিক রূপ ও নান্দনিকতা এ সংস্কারকাজের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
ইরান সরকারের উদ্যোগে এ স্থাপনার সংস্কার কাজ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট স্থপতি এবং ঢাকার হেরিটেজ রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা তাইমুর ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'হোসেনি দালানের ভেতরে ও বাইরে টাইলস লাগানো হয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও কিছু সংস্কার করা হয়েছে। এতে এর আদি চেহারায় পরিবর্তন এসেছে। কাজটি করা ঠিক হয়নি। তবে এতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসেনি বলে তিনি জানান।
প্রায় সাড়ে ৩০০ বছরের পুরনো এ স্থাপনা মোগল আমলের ঐতিহ্যের নিদর্শন। এর নির্মাণকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ইমামবাড়ার দেয়ালের শিলালিপি থেকে জানা যায়, শাহ সুজার সুবেদারির সময় তাঁর এক নৌ-সেনাপতি মীর মুরাদ ১৬৪২ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মাণ করেছিলেন। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর 'বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ' বইয়ে ভবনের দেয়ালে লাগানো শিলালিপির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রত্নতাত্তি্বকরা পরীক্ষার পর দেখেছেন ওই শিলালিপিটি নকল নয়। শিলালিপিতে উল্লেখ রয়েছে নির্মাতা হিসেবে মীর মুরাদের নাম। ঐতিহাসিক এম হাসান দানীও বলেছেন, 'মীর মুরাদই এখানে প্রথম ছোট আকারের একটি ইমামবাড়া স্থাপন করেছিলেন। পরে এটি ভেঙে যায় এবং নায়েব-নাজিমরা নতুন করে তা নির্মাণ করেন।
কথিত আছে, মীর মুরাদ স্বপ্নে আদৃষ্ট হয়ে হোসেনি দালান ইমামবাড়া নির্মাণ করেছিলেন। তবে সেটির আদিরূপ বজায় নেই। ইতিহাসবিদ জেমস টেলর তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেন, ১৮৩২ সালেও আদি ইমামবাড়া টিকে ছিল। ইস্ট-ইন্ডিয়া কম্পানির আমলে দুই দফায় ইমামবাড়ার সংস্কার হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়। নবাব আহসানউল্লাহ এক লাখ টাকা খরচ করে ইমামবাড়ার আমূল সংস্কার করেন। সেই ভবনটিই এখন টিকে আছে। একটি উঁচু মঞ্চের ওপর ভবনটি নির্মিত। দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি বর্গাকৃতির পুকুর। সম্প্রতি পুকুরটিও সংস্কার করা হয়েছে। এর আগে প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের উদ্যোগে ১৯৯৫ সালে পুকুরটি সংস্কার করা হয়েছিল। তখন পুকুরের চারপাশের দেয়াল কংক্রিট দিয়ে বাঁধাই করে দেওয়া হয়। পশ্চিম ও উত্তর দিকে পুকুরে নামার প্রশস্ত সিঁড়ি রয়েছে। চারদিক লোহার গ্রিল দিয়ে সংরক্ষিত। পাড়ে দূর্বা ঘাস বুনে লাগানো হয়েছে নানা ধরনের গাছ। পুকুরের টলটলে পানিতে শ্বেতশুভ্র ইমারতের ছায়া পড়ে ভেসে ওঠে হোসেনি দালানের সৌন্দর্য।
প্রসঙ্গত, ৬১ হিজরির ১০ মহররম ইমাম হোসেন (রা.) ইরাকের কারবালা প্রান্তরে ফোরাততীরে ইয়াজিদ বাহিনীর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে সপরিবারে শহীদ হন। পাশেই প্রবাহিত ফোরাত নদ, অথচ তৃষ্ণা নিবারণের জন্য একফোঁটা পানিও তাঁরা পাননি। প্রাণ উৎসর্গ করে তাঁরা সত্য ও ন্যায়ের আদর্শ চিরভাস্বর করে রেখে গেছেন। মুসলিম বিশ্ব ওই হৃদয়ভাঙা বেদনাকে স্মরণ করে আজ ১০ মহররম কারবালার শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনায় ইবাদত-বন্দেগি করেন। তবে শিয়াসম্প্রদায় এ ঘটনা স্মরণ করে তাদের নিজস্ব রীতিতে। মহররম মাসের প্রথম দিন থেকে আশুরা পর্যন্ত ১০ দিন ধরে ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি তারা মর্সিয়া, মাতম, তাজিয়া মিছিলসহ বিভিন্ন আয়োজনে স্মরণ করে কারবালার শহীদদের।

No comments

Powered by Blogger.